ঘিবলি-জ্বরে কাঁপছে স্যোশাল মিডিয়া, ঝুঁকিতে পড়ছেন কি

স্টুডিও ঘিবলি স্টাইল ছবি
স্টুডিও ঘিবলি স্টাইল ছবি  © সংগৃহীত

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম খুললেই ভেসে বেড়ায় আপনার পরিচিত মুখের বা বন্ধুর ‘কার্টুন অবতার’। বন্ধুতালিকার বন্ধুরা থেকে শুরু করে অপরিচিতজন, জনপ্রিয় তারকা, মেসি থেকে শুরু করে ডোনাল্ড ট্রাম্প, ফুটবল ক্লাবের কোচ, এই ট্রেন্ড থেকে বাদ যাচ্ছেন না কেউ। সেই ট্রেন্ড হলো ‘ঘিবলি’। কিন্তু আদতে বিষয়টা কী? কোথা থেকে এল এমন বিদঘুটে নাম? এ নামের অর্থই-বা কী? কেন এবং কীভাবে জনপ্রিয়তা পেল এই 'ঘিবলি শিল্প'? কতটা উপকারী বা ঝুঁকিপূর্ণ এই ছবি বানানো?

স্টুডিও ঘিবলি স্টাইল ছবিতে নিজেকে রূপান্তর করতে গিয়ে হয়তো অনেকেই আনন্দ পাচ্ছেন। চ্যাটজিপিটি আর গ্রক থ্রি দিয়ে এভাবে তৈরি করা ছবি সবাইকে মুগ্ধ করছে। গত সপ্তাহে ওপেনএআই চ্যাটজিপিটি ফোর ও ইমেজ জেনারেশন মডেল চালু করে। এর স্টুডিও ঘিবলি স্টাইলের ছবি মুহূর্তের মধ্যে ভাইরাল হয়ে যায়।

গত ১ এপ্রিল ওপেন এআইয়ের সিইও স্যাম অল্টম্যান বলেন, মাত্র এক ঘণ্টায় ১০ লাখ নতুন ব্যবহারকারী যোগ হয়েছে। এই ট্রেন্ড ইন্টারনেটে ঝড় তুলেছে। সোশ্যাল মিডিয়া এখন ঘিবলি-স্টাইলের ছবিতে ভরে গেছে। কিন্তু এর পেছনে লুকিয়ে রয়েছে ভয়াবহ নিরাপত্তাঝুঁকি। বর্তমানে এই ঝুঁকি নিয়ে ভাবতে হবে বলে জানান তিনি।

কিন্তু প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর পেছনে লুকিয়ে আছে নিরাপত্তাঝুঁকি। এই ইমেজ জেনারেটর ব্যক্তিগত ডেটা সংগ্রহের জন্য ব্যবহার হতে পারে। এটা পরিচয় নিশ্চিতকরণে সমস্যা তৈরি করতে পারে।

ঘিবলি কী?
ঘিবলি একটি অ্যানিমেশন স্টুডিওর নাম। ১৯৮৫ সালে জাপানের টোকিওতে এর জন্ম। জাপানের কিংবদন্তি অ্যানিমে নির্মাতা হায়াও মিয়াজাকি। 'স্পিরিটেড অ্যাওয়ে' কিংবা 'মাই নেবার টটোরো'—হায়াও মিয়াজাকির হাতে গড়া স্টুডিও ঘিবলির এসব অ্যানিমেশন বিশ্বের অগণিত দর্শকের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছে।

উজ্জ্বল জলরং অথবা অ্যাক্রেলিক রং দিয়ে হাতে আঁকা হতো ওই স্টুডিওর সব অ্যানিমেশন। খামখেয়ালি কল্পনায় আঁকা সেসব ছবি থেকে ফুটে বের হতো অজানা সুখানুভূতি। সম্ভবত সেই বিষয়টিই দর্শকদের মন টানে। জাপানের ওই অ্যানিমেশনের জনপ্রিয়তা জাপানের গণ্ডি পেরিয়ে পৌঁছায় আন্তর্জাতিক দুনিয়ায়। ওয়াল্ট ডিজনি অংশীদারির প্রস্তাব দেয় ঘিবলি স্টুডিওকে। এরপরই কার্টুন বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে ঘিবলি।

ঘিবলির জনপ্রিয়তা
ঘিবলির জনপ্রিয়তা কতখানি, তার একটি হিসাব দেখা গেছে। গত ৩৮ বছরে হাতেগোনা ২২টি ছবি তৈরি করেছে ঘিবলি স্টুডিও। টেলিভিশনের জন্য বানিয়েছে ৩টি ছবি। আর সেসব ছবির প্রতিটিই অ্যানিমেশন দুনিয়ায় আদৃত। জাপানের যে প্রথম দশটি ছবি আজও ব্যবসা দেয় এবং সর্বকালের সেরা ব্যবসা করেছে, তার মধ্যে চারটিই ঘিবলি স্টুডিওতে তৈরি। ঘিবলির ছবি অস্কার, গোল্ডেন বিয়ার, বাফতা, গোল্ডেন গ্লোব পুরস্কারও জিতেছে একাধিকবার। ২০২৪ সালের সেরা অ্যানিমেশন ছবির শিরোপা উঠেছে ঘিবলি স্টুডিওরই তৈরি ‘দ্য বয় অ্যান্ড দ্য হেরন’ ছবির মাথায়।

ঘিবলির তৈরি ছবি ‘স্পিরিটেড অ্যাওয়ে’ হলো প্রথম ‘নন-ইংলিশ’ অ্যানিমেশন ছবি, যা মূল বিভাগে অস্কার জেতে। ২০২১ সালে ঘিবলির জনপ্রিয়তা দেখে টোকিওতে ঘিবলি মিউজিয়ামও তৈরি হয়। ঘিবলির দৌলতে মিয়াজাকি ২০২৪ সালে এশিয়ার ‘নোবেল প্রাইজ’ র্যামন ম্যাগসাইসাই পুরস্কারও পান।

যেভাবে বানাবেন ঘিবলি ছবি
* প্রথমে জিপিটির ফোরও টুল খুলতে হবে * ওপেনএআইয়ে চ্যাটজিপিটি প্রিমিয়াম ভার্সনে এই সুবিধা দেওয়া হয়েছে * যে ছবিটি ঘিবলি করবেন, সেটিকে টুলে আপলোড করতে হবে * তারপর লিখুন ঘিবলি অ্যানিমেশন স্টাইল * এরপর সেকেন্ড এআইয়ের মাধ্যমে দুর্দান্ত ইমেজ তৈরি করা যাবে * এরপর সেভ করে সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করুন

এ ছাড়া গুগ্ল জেমিনি, এক্সএআইয়ের তৈরি চ্যাটবট গ্রক, লিয়োনার্ডো এআই এবং প্লেগ্রাউন্ড এআই থেকে ঘিবলি স্টুডিও ব্যবহার করা যাচ্ছে।

ঘিবলিতে জালিয়াতি ও ঝুঁকি
এআই টেক প্রাইভেসির সহ-প্রতিষ্ঠাতা লুইজা জারভস্কি এক্স-এ সতর্ক করে বলেছেন, এই ইমেজ জেনারেটর ব্যক্তিগত ডেটা সংগ্রহের জন্য ব্যবহার হতে পারে। এটা পরিচয় নিশ্চিতকরণে সমস্যা তৈরি করতে পারে।

তিনি বলেন, এই ছবি দিয়ে জাল নথি বানানো যায়। আমি চ্যাটজিপিটি দিয়ে একটা জাল রেস্তোরাঁর বিল বানিয়েছি। আরও প্রম্পট দিয়ে এটাকে আরও বাস্তবসম্মত সম্ভব। ওপেনএআইয়ের মতো এআই ইমেজ জেনারেটর জাল প্রমাণ তৈরি করা সহজ, সস্তা আর সবার জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছে। খারাপ উদ্দেশ্য নিয়ে যে কেউ মিনিটের মধ্যে এটা বানাতে পারে।

যেভাবে নিজেকে সুরক্ষিত রাখবেন
প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অজানা প্ল্যাটফর্মে ছবি আপলোডের আগে দুবার ভাবুন। যদি আপনি সময়ের সঙ্গে ঘিবলি ট্রেন্ড ফলো করতে চান, তাহলে এই কৌশলগুলো মানতে পারেন। সেগুলো হলো౼

* হাই-রেজল্যুশনের ছবি দেবেন না, যা এআই ট্রেনিংয়ে ব্যবহার হতে পারে।
* প্ল্যাটফর্মের গোপনীয়তা নীতি ভালোভাবে দেখুন।
* এমন প্ল্যাটফর্ম বেছে নিন, যারা আপনার ডেটা সংরক্ষণ করে না।
* অ্যাপ ডাউনলোড করলে ক্যামেরা ও গ্যালারির অ্যাক্সেস বন্ধ করুন।
* রিভার্স ইমেজ সার্চ করে দেখুন আপনার ছবি অপব্যবহার হচ্ছে কি না।
* এই নতুন ট্রেন্ডে যোগ দেওয়ার আগে গোপনীয়তার কথা মাথায় রাখুন। সতর্ক থাকলে মজাও করা যায়, ঝুঁকিও এড়ানো যায়।

যা বলছেন বিশেষজ্ঞরা
ঘিবলির সার্বিক বিষয়ে সাইবার ৭১-এর পরিচালক আবদুল্লাহ আল জাবের গণমাধ্যমকে বলেন, ঘিবলি ছবিতে এমনিতে কোনো ঝুঁকি নেই। তবে অনেকে প্রিমিয়াম সাবস্ক্রিপশন নিচ্ছে এবং তা শেয়ার করে অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করছে। এ ক্ষেত্রে নিরাপত্তাঝুঁকি দেখা দেয়। কেউ একটা ছবি আপলোড দিল, আবার অন্য একজন বন্ধুকে সেটা শেয়ার করা হলো। তখন দেখা গেল প্রিয়জনের সঙ্গে তৈরি করা একটা ছবি অন্যজনও পেয়ে যাচ্ছে। এতে অন্যরা চাইলে এআই দিয়ে ডিফরেন্ট কিংবা অ্যাডাল্ট কোনো কন্টেন্ট তৈরি করে ফেলতে পারবে।

ঘিবলির অপব্যবহার হওয়ার আশঙ্কা জানিয়ে তিনি বলেন, অনেকেই বিভিন্ন পেজে চ্যাটজিটিপির প্রিমিয়াম অ্যাকাউন্ট বিক্রি শুরু করেছে। সেটাতে রিস্ক আছে। এ ছাড়া ইনজেনারেল কোনো রিস্ক নেই। যাকে অ্যাকাউন্ট অ্যাকসেস দেওয়া হচ্ছে, তিনি চাইলে সব দেখতে পারবেন। অনেকে স্বামী-স্ত্রীর ছবি, বয়ফ্রেন্ড-গার্লফ্রেন্ডের ছবি বা পার্সোনাল ছবি কনভার্ট করছে। এতে এটা মিস ইউজ হওয়ার আশঙ্কা থেকে যাচ্ছে।

এ ছাড়া যেসব পেজে প্রিমিয়াম রেন্ডমলি সেল করা হচ্ছে, এগুলো আনঅথরাইজড। আবার একটা অ্যাকাউন্ট ১০ থেকে ১২ জনের কাছে সেল করা হচ্ছে। এখানে সবাই অপরিচিত, সবাই সবার প্রোফাইল দেখতে পারছে। ঝুঁকিটা এখানেই বেশি।


সর্বশেষ সংবাদ