চাঁদের অভিজ্ঞতা অ্যাপসে: নাসা জয়ে নেপথ্যের গল্প
- হাবিব রহমান, শাবিপ্রবি
- প্রকাশ: ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ০১:২০ PM , আপডেট: ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ০৫:৫৭ PM
আচ্ছা, পৃথিবীতে এমন কি কোন মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে; ছোটবেলায় যার চাঁদে যাওয়ার স্বপ্ন ছিলনা? সংশয় থাকলেও কিছুটা নিশ্চিত করেই বলা যায়, ‘যাবে না’। বাঙালি জাতিতে তো না-ই। কারণ, চাঁদে থাকা বুড়ির গল্প শুনেই যে তাদের শৈশব কেটেছে; ‘মামা’ ডেকে আপন করে নিয়েছে কল্পনার চেয়েও দূরে থাকা পৃথিবীর একমাত্র এই গ্রহকে।
তবে কল্পনা এবার হাতের মুঠোয়। দেশের অহংকার সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের চার তরুণ বলছে, ‘বাংলাদেশের পক্ষেও চাঁদে যাওয়া সম্ভব’। শুধু সম্ভবই নয়, ইতোমধ্যে সাফল্যও দেখিয়েছে তারা। সেই সাফল্যের সূত্র ধরে ডাক পেয়েছে মহাকাশ নিয়ে গবেষণাকারী প্রতিষ্ঠান নাসা’য় কাজ করার। সে গল্পই আজ তাদের মুখ থেকে শোনা যাক-
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে গল্পটা শোনাতে গিয়ে ‘বাংলাদেশের সকলকে চাঁদে নিয়ে যেতে চাই’ বলেই হেসে দিলেন বিজয়ীদের একজন রাফি। পুরো নাম এসএম রাফি আদনান। ক’দিন আগেই রাফি তার দুই বন্ধু এবং এক জুনিয়রকে নিয়ে দেশের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিখাতে নতুন ইতিহাস রচনা করেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় মহাকাশ সংস্থা নাসা’র উদ্যোগে আয়োজিত ‘নাসা স্পেস অ্যাপস চ্যালেঞ্জ’ এর আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অংশ নিয়ে প্রথমবারের মতো বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করেছে তাদের দল ‘সাস্ট অলিক’। প্রতিযোগিতায় মোট ছয়টি ক্যাটাগরির মধ্যে ‘বেস্ট ইউজ অব ডাটা’ ক্যাটাগরিতে ক্যালিফোর্নিয়া, কুয়ালালামপুর ও জাপানের তিনটি দলকে পেছনে ফেলে সাস্ট অলিক।
এর আগে বিশ্বের ৭৯ টি দেশের বাছাইকৃত ২ হাজার ৭২৯ টি দলের সঙ্গে লড়াই করে চ্যাম্পিয়ন হয় দলটি। সাস্ট অলিকের সদস্যরা হলেন - শাবিপ্রবি'র সিএসই বিভাগের সহকারি অধ্যাপক বিশ্বপ্রিয় চক্রবর্তী (মেন্টর), পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের ২০১৩-১৪ সেশনের শিক্ষার্থী এসএম রাফি আদনান, ভূগোল ও পরিবেশ বিদ্যা বিভাগের ২০১৩-১৪ সেশনের শিক্ষার্থী কাজী মাইনুল ইসলাম, একই বিভাগের ২০১৩-১৪ সেশনের শিক্ষার্থী আবু সাদিক মাহদী ও একই বিভাগের ২০১৫-১৬ সেশনের শিক্ষার্থী সাব্বির হাসান। বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হওয়ায় নাসা’র সদর দপ্তরে ডাক পেয়েছে টিম সাস্ট অলিক। কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে এমন অর্জনে যেন আনন্দের জোয়ার বইছে টিম সাস্ট অলিকের প্রতিটি সদস্যের মনে।
বিশ্বপ্রিয় চক্রবর্তী (সাস্ট অলিক’র মেন্টর)
আমাদের শুরুটা অনেক ছোট ছিল। একটা স্বপ্ন ছিল যে সাস্টের জন্য একটা ভিআর অ্যাপ তৈরি করা; যেখানে কেউ সাস্টে না এসেও এখানকার অভিজ্ঞতা বাইরে থেকে নিতে পারবে। ওখান থেকেই আমরা কাজ শুরু করি। সেটা ছিল আমাদের সেকেন্ড মেজরের অ্যাপ। আমাদের শাবিপ্রবিতে যেকোন বিষয়ে পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা একটা সেকেন্ড মেজরের সুযোগ পায়। সেখানে মাইনুল এবং মাহদী কাজ করে। ওদের নিয়ে আমরা সাস্ট ভার্চুয়াল ট্যুর নামে একটি অ্যাপ তৈরি করি। এভাবেই আমাদের ভার্চুয়ালিটির কাজটা শুরু হয়। পরবর্তীতে রাফি এবং সাব্বির আমাদের সাথে যুক্ত হয়।
আমাদের প্রকল্পের নাম ছিলো ‘লুনার ভিআর’ যা একটি ভার্চুয়াল রিয়েলিটি অ্যাপ। এই অ্যাপ ব্যবহার করে যে কেউ চাঁদে না গিয়েও চাঁদের অভিজ্ঞতা নিতে পারবে। নাসার অনেক ডাটা আছে যা সাধারণ মানুষ ব্যবহার করতে পারে না। তাই নাসা প্রদত্ত বিভিন্ন ডাটা ব্যবহার করে এই অ্যাপটি তৈরি করা হয়েছে। আমরা অপটিমাল ওয়েতে সর্বোচ্চ সংখ্যক ডাটা ব্যবহার করায় ঐ ক্যাটাগরিতে চ্যাম্পিয়ন হতে পেরেছি।
অ্যাপটির মাধ্যমে নাসা অ্যাপোলো ১১ মিশন-এর ল্যান্ডিং এরিয়া ভ্রমণ, চাঁদ থেকে সূর্যগ্রহণ দেখা এবং চাঁদকে একটি স্যাটেলাইটের মাধ্যমে ভার্চুয়ালভাবে আবর্তন করা যাবে। আমাদের অ্যাপের মাধ্যমে আমরা একটা ৩৬০ ডিগ্রী ভিউ দিতে পারি যেন তারা বুঝতে যে চাঁদে গেলে ব্যাপারটা এমন বা জিনিসটা এমন। চাঁদের তাপমাত্রার উপর নির্ভর করে যে কিছু পরিবর্তন হয়; কালার দেখে তা বুঝতে পারা যায়- সেটাও অ্যাপের একটি ফিচারের মাধ্যমে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। আমরা যে চ্যাম্পিয়ন হব, শুরুতে সেটা আশা করিনি। তবে আমার শিক্ষার্থীদের অনেক চেষ্টা, মেধা আর পরিশ্রমের ফলেই এ অর্জন।
‘লুনার ভিআর’; যা একটি ভার্চুয়াল রিয়েলিটি অ্যাপ দেখতে ক্লিক করুন: বিশ্বজয়ী অ্যাপ
এসএম রাফি আদনান
শাবিপ্রবিতে ভর্তি হওয়ার পর শুরু থেকেই অ্যাস্ট্রনমি সম্পর্কিত কোপার্নিকাস অ্যাস্ট্রনমিকাল মেমোরিয়াল অব সাস্ট, যা ক্যামসাস্ট নামে পরিচিত; সেই সংগঠনে তিন জনের পরিচয় এবং এক সাথে কাজ করা শুরু। আমরা মূলত চারজন মিলে এখানে কাজ করি। আমরা তিনজন একই ব্যাচের; আর আমদের একজন জুনিয়র। নাম সাব্বির। বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার পর মূলত আমরা ক্যামসাস্ট সংগঠনের সাথে সম্পৃক্ত ছিলাম। তারপর একসাথে কাজ করা হয়। এর আগে ২০১৬ সালে অ্যাপ চ্যালেঞ্জেও আমরা অংশ নিয়েছিলাম। তবে সে সময় ফলাফল এতটা ভাল হয়নি। এবারের কম্পিটিশনে যখন যাই; তখন আমরা সাস্ট ভার্চুয়াল অ্যাপ নিয়ে কাজ করছিলাম। এই কাজের প্রেক্ষিতে একটা কমন বিষয় পাওয়া গেল যে, ভার্চুয়াল রিয়েলিটি ওদের প্রবলেম ছিল একটা, স্পেস এক্সপ্লোরেশন এই টাইপের একটা সমস্যা ছিল। যেখানে বলা হয় মার্স বা মুনের একটা হোস্টিং লেভেলের রিয়েলিটি এনভারমেন্ট তৈরি করা। আমরা এটাই বেছে নিয়েছি। কারণ এ বিষয়ে ধারণা থাকায় বেশ সহজ মনে হয়েছে আমাদের কাছে।
আমাদের অ্যাপে লুনা নামে একটি ভয়েস অ্যাসিসটেন্ট আছে; যা ইংরেজিতে কথা বলে। আমাদের ইচ্ছা আগামীতে এর বাংলা সংস্করণ বের করা; যেন বাংলাদেশের সকলেই ভার্চুয়াল রিয়েলিটি সাথে পরিচিত হতে পারে। সবাই যেন চাঁদে যেতে পারে। এ প্রতিযোগিতা সম্পর্কে দেশের অনেকেই জানে না; বিধায় আমাদের সংখ্যাটা প্রত্যাশার চেয়ে কম। যেহেতু আমরা এর আগেও একবার অংশ নিয়েছিলাম; তাই ব্যাপারটা সহজ হয়েছে। আমাদের দেশে অনেক প্রতিভা আছে, যা আগামী দিনে বের হয়ে আসবে বলে প্রত্যাশা করি। আগামীতে গেইম ডেভেপমেন্ট নিয়ে কাজ করে আলো ভাল কিছু দেয়ার কথা জানান আদনান।
কাজী মাইনুল ইসলাম
এ ধরনের আরও অনেক অ্যাপ আছে। কিন্তু আমাদের অ্যাপটি ভিন্ন এ জন্যে যে আমরা নাসা প্রদত্ত ডাটাগুলো ব্যবহার করেছি। ফলে প্রকৃতপক্ষে চাঁদটা দেখতে কেমন তার অনেকটা বাস্তব অনুভূতি পাওয়া যায় এর মাধ্যমে। এখানে একটি বিশেষ অভিজ্ঞতা হচ্ছে লুনার ই-ক্লিপস। পৃথিবী থেকে তা বোঝা আসলেই সম্ভব নয়। সোলার ই-ক্লিপস চাঁদে কেমন হয়; এটা আমরা নিজেরা তৈরি করে দেখিয়েছি।
আমাদের ভয়েস অ্যাসিসটেন্ট লুনা খুবই ইউজার ফ্রেন্ডলি এবং পুরো ট্যুরে ভিউয়ারকে গাইড করবে। আসলে এই অ্যাপটি তৈরি আমরা খুব বেশি হলে দু’সপ্তাহ সময় পাই এবং এটা আমাদের প্রথম ধাপ ছিল। যার ফলে আমরা দেশে বিজয়ী হতে পেরেছিলাম। তারপর আন্তর্জাতিক পর্যায়ের প্রতিযোগিতায় এটাকে পলিস করার জন্য মাত্র এক মাস পাই। স্বল্প সময়ে কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে এ অর্জন হাতে পাওয়ায় ভাল লাগছে। আমার বিশ্বাস- যদি স্কুল কিংবা কলেজ পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের মাঝে এ ধরণের প্রতিযোগিতার আয়োজন করা যায়; তবে তাদের জন্য বিষয়গুলো আরও সহজ মনে হবে। এতে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সফলতা আরও বৃদ্ধি পাবে।
আবু সাদিক মাহদী
বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হওয়ার অনুভূতিটা আসলে বলে বোঝানো সম্ভব না। প্রথমে বিশ্বাস হতে চায় না যে আমরা এত দূর পৌঁছে গেছি। আমরা ধাপে ধাপে এগিয়ে এসেছি, যখন শেষ ধাপে পৌঁছাই; তখন খুবই আনন্দে ছিলাম যে মূল লক্ষ্য অর্জন করেছি। এখন খুব স্বল্প খরচেই মোবাইল আর অ্যাপের মাধ্যমে চাঁদের অনুভূতিটা নিতে পারছি। যেখানে আমরা চাইলেও চাঁদে যেতে পারছি না। যেহেতু বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশ, তাই আমরা সেখানে যেতে পারছিনা। আমাদের শিক্ষার্থীরা যা বই থেকে শিখছে এবং রাতের আকাশে যে চাঁদ দেখে; তা খুব সহজেই এই অ্যাপের মাধ্যমে জানতে পারবে। বইয়ের শিক্ষাটাকেই আমরা ভার্চুয়াল রিয়েলিটি অ্যাপের মাধ্যমে বাস্তবে শিক্ষার্থীদেরকে দেখাতে পারছি।
শিক্ষার্থীদের এমন বিশ্বজয়ী অর্জনে তাদের অভিনন্দন দিয়ে পাশে থাকার আশ্বাস দিয়ে শাবিপ্রবি উপাচার্য অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদ বলেন, শাবিপ্রবি শুধু দেশের প্রথম বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবেই নয়; পাশাপাশি বিভিন্ন অর্জনেও প্রথম। কম্পিউটার প্রোগ্রামিংয়ে আমরা টানা সাতবারের চ্যাম্পিয়ন। আমাদের ছাত্ররা আগামী মার্চে পর্তুগালের লিসবনে প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে যাচ্ছে। নাসা অ্যাপ চ্যাম্পিয়নদের অর্জনে আমি খুবই আনন্দিত এবং অভিভূত। আমরা তাদের আর্থিক ও অন্যান্য সহায়তা করছি। ভবিষ্যতেও এ ধরা অব্যাহত থাকবে বলে জানান অধ্যাপক ফরিদ।