চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘর্ষ

গভীর রাতে দারোয়ান-ছাত্রীর মারামারিতে শুরু, বেড়েছে বাগছাসের ‘হিরোইজম’ ও পুলিশ-প্রশাসনের রহস্যময় ভূমিকায়

০৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৩:৫৭ PM , আপডেট: ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৫:৪১ PM
স্থানীয়দের হামলায় আহত শতাধিক শিক্ষার্থী

স্থানীয়দের হামলায় আহত শতাধিক শিক্ষার্থী © সংগৃহীত

ছাত্রী হেনস্তাকে কেন্দ্র করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) শিক্ষার্থী ও স্থানীয়দের মধ্যে সংঘর্ষে উভয় পক্ষে অন্তত আট শতাধিক আহত হয়েছেন। ইতোমধ্যে গ্রেফতার করা হয়েছে আটজনকে। নজিরবিহীন এ সংঘাতে বিভিন্ন পক্ষের ইন্ধন আর উসকানিতে রহস্য দানা বেঁধে উঠছে সবার মনে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের অংশীজনরা বলছেন, বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদের (বাগছাস) নেতাদের অতি উৎসাহ এবং পুলিশ ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের রহস্যজনক ভূমিকায় ঘটনা রূপ নিয়েছে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে। পরে ইন্ধন জুগিয়েছে বিএনপি নেতা, আওয়ামী লীগ ও নিষিদ্ধঘোষিত সন্ত্রাসী সংগঠন ছাত্রলীগ। সংঘাতের ঘটনায় উস্কানি দেয়ার অভিযোগে ইতোমধ্যে বিএনপির এক নেতাকে  দল থেকে বহিস্কারও করা হয়েছে।

অপরাপর ছাত্র সংগঠনের নেতারা বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (চাকসু) নির্বাচনকে সামনে রেখে বাগছাসের কিছু নেতার অতি-উৎসাহী আচরণ সংঘর্ষ দানা বাঁধতে সহযোগিতা করে। একই মন্তব্য শোনা গেছে আহত শিক্ষার্থীদের কাছেও। একই সাথে এ সংঘাত চাকসু নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্র কিনা তা নিয়েও চলছে আলোচনা।

ঘটনার সূত্রপাত যেভাবে
বিশ্ববিদ্যালয়ের ২ নং গেইট পেরিয়ে মাছ বাজারের শেষ দিকের একটি বাসায় ভাড়া থাকেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষের ছাত্রী সাফিয়া খাতুন। প্রত্যক্ষদর্শী শিক্ষার্থীদের তথ্যমতে, ব্যক্তি মালিকানাধীন ওই বাসার ভাড়াটিয়াদের রাত ১১টার মধ্যে প্রবেশের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিন্তু শনিবার ওই ছাত্রী রাত দেরিতে বাসায় প্রবেশের চেষ্টা করেন। বাসার দারোয়ান গেইট খুলতে অস্বীকৃতি জানালে উভয়ের মধ্যে বাকবিতণ্ডা শুরু হয়। এক পর্যায়ে একে অপরকে মারধর করেন।

শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, দারোয়ান প্রথমে ওই ছাত্রীকে থাপ্পড় মারেন। তবে স্থানীয়দের অভিযোগ, ওই ছাত্রী প্রথমে দারোয়ানের গায়ে হাত তুললে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়। পরে ওই ছাত্রী তার কয়েকজন সহপাঠীকে ফোন দিলে তারা আসে এবং দারোয়ানের ওপর চড়াও হন। এ সময় স্থানীয় সিএনজি চালকসহ বেশ কয়েকজন দারোয়ানকে রক্ষা করতে গেলে উভয় পক্ষে মারামারি শুরু হয়। এতে এক শিক্ষার্থী আহত হলে তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল সেন্টারে নেওয়া হয়। এ খবর ক্যাম্পাসে ছড়িয়ে পড়লে আরও কিছু শিক্ষার্থী সেখানে জড়ো হন। তারা ওই বাসার দারোয়ানসহ তার সঙ্গীদের ধাওয়া করলে স্থানীয়রা একত্র হয়ে ইট–পাটকেল মারা শুরু করেন। তখন সংঘর্ষ ও পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটে।

আওয়ামী লীগের সংশ্লিষ্টতা, বিএনপি নেতার ইন্ধন ও বাগছাস নেতাদের অতি উৎসাহ
গত রবিবার দুপুরের পর এ ঘটনায় স্থানীয়দের পক্ষ নিয়ে বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য সাথী উদয় কুসুম বড়ুয়ার একটি বক্তব্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়। ওই ভিডিওতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ‘কুলাঙ্গার’ ডাকতে শোনা যায় সাথী উদয় কুসুম বড়ুয়াকে। এ ঘটনায় দল থেকে তাকে বহিষ্কার করা হয়েছে। এছাড়া যুবলীগের স্থানীয় নেতা হানিফ ও তার ভাই ইকবাল গং এ সংঘর্ষে স্থানীয়দের অস্ত্র সরবরাহ করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। রবিবার সন্ধ্যায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যৌথ বাহিনী ও ছাত্রসংগঠনগুলোর মিটিংয়ে বেশ কয়েকজন ছাত্রনেতা এই দাবি করেন। প্রশাসন ও শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে হানিফ গংকে দ্রুত গ্রেফতারের দাবি জানানো হয়।

এদিকে গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদের কয়েকজন নেতা ‘ফুটেজ খাওয়া’র লোভে ঘটনাকে বড় করেছেন বলে অভিযোগ করছেন আহত শিক্ষার্থী ও অন্যান্য সংগঠনের নেতারা।

‘বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের উপর হামলা করেছে এলাকাবাসী। এটার হিসাব আজকে বরাবর নিবে ছাত্ররা। সবাই ২ নং গেট আসেন’- আল মাসনূন, বাগছাস সদস্য সচিব, চবি (ফেসবুক পোস্ট)

খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, নারী শিক্ষার্থী হেনস্তার পর গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সদস্যসচিব আল মাসনূনের নেতৃত্বে একটি অংশ দারোয়ানকে ধরতে যায়। গ্রামের মধ্যে দারোয়ানকে তাড়া করলে কয়েকজন সিএনজি চালক তাদের বাধা দেয়। এতে  দু পক্ষের মধ্যে ধাক্কাধাক্কি শুরু হলে আইন বিভাগের শিক্ষার্থী ইমতিয়াজ আহত হয়।

এ ঘটনায় গ্রামবাসী শিক্ষার্থীদের উপর হামলা করেছে বলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে উসকানি দেন আল মাসনূন। রাত ১২টা ২৮ মিনিটে দেয়া একটি পোস্টে মাসনূন লিখেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের উপর হামলা করেছে এলাকাবাসী। এটার হিসাব আজকে বরাবর নিবে ছাত্ররা। সবাই ২ নং গেট আসেন। পরবর্তীতে ১২টা ৩৯ মিনিটে আরেকটি পোস্টে আহত শিক্ষার্থীর ছবি শেয়ার করেন মাসনূন। ওই ছবিতে ইমতিয়াজের চোখের নিচে আঘাতের চিহ্ন দেখা যায়। পোস্টে মাসনূন লিখেছেন,  দারোয়ানকে ধরতে গেলে সে পালায়। পরবর্তীতে তাকে কিছু দূরে ধরতে পারলে এলাকাবাসী আমাদের উপর হামলা করে তাকে ছিনিয়ে নিয়ে যায়।

পুলিশ ও প্রশাসনের মাধ্যমে আইনি উপায়ে সমাধান না করে ছোট ঘটনাকে গ্রামবাসী হামলা করেছে বলে ফেসবুকে আতঙ্ক ছড়িয়ে শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষে ডেকে আনায় মাসনূনের এই ভূমিকার সমালোচনা করছেন আহত শিক্ষার্থীরাও।

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন শিক্ষার্থী তৌহিদুল ইসলাম সোহান বাগছাস নেতা আল মাসনূনের বিতর্কিত ভূমিকা তুলে ধরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লিখেছেন, মাসনূনকে ধরলে ৩৬০ ডিগ্রি এঙ্গেলে সব কথা বের হবে। তিনি লিখেছেন, আমার এবং সকল ভাইদের এই দশার জন্য ফুটেজখোরের দায়ী। নিরস্ত্র ছেলেগুলোকে ২ নং গেট আসেন বলে নিয়ে যাওয়ার মানে কী? তাও এই চিপাচাপার ভিতরে? মানে হলো রাজনীতি।’

সংঘর্ষ বড় হতে বাগছাসের অতি-উৎসাহী ভূমিকা দেখছেন ছাত্রদলের আরেক নেতা মো. শাফায়াত হোসেন। তিনি দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, মাসনূন মোটরসাইকেলে এসে আমাদের বলে, ভাই স্থানীয়রা শিক্ষার্থীদের উপর হামলা চালিয়েছে। আমরা ওখানে যাই। পরবর্তীতে শুনি সে হলে গিয়েছে। একই সাথে ফেসবুকে ছড়িয়ে যাওয়ার কারণে শিক্ষার্থীরা আসতে শুরু করে। তিনি বলেন, বাগছাসের অনেক নেতাই উসকানি দিয়েছে, কিন্তু পরিস্থিতি যখন খারাপের দিকে গেছে, তখন তারা এই জিনিসটাকে কন্ট্রোলের চেষ্টা করেছে। কিন্তু তখন কেউ আর পাত্তা দেয় নাই তাদের।

শাফায়াত হোসেন বলেন, আমি আর ইয়াছিন (ছাত্রদল নেতা) ভাই উত্তেজিত শিক্ষার্থীদের থামানোর চেষ্টা করি। কিন্তু বেশ কিছু পোলাপান আমাদের ‘হিজড়া’ বলে সম্বোধন করে। তারা ইয়াছিন ভাইয়ের সঙ্গে বেয়াদবি করে দৌঁড়ে বাচা মিয়ার মোড়ের দিকে যায়। এ সময় তারা গ্রামবাসীদের উদ্দেশ্যে নোংরা স্লোগানের পাশাপাশি রাস্তার পাশের টিনের বাড়িঘরে বারি দিতে দিতে যায়। এতে স্থানীয়দের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। তিনি বলেন, আমরা হাজার হাজার শিক্ষার্থী ছিলাম, তারা খুব অল্প। কিন্তু অতি বিপ্লবী দেখাতে গিয়ে মার খেতে হয়েছে।

এ বিষয়ে গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের (বাগছাস) কেন্দ্রীয় সংগঠক রশিদ দিনার গণমাধ্যমকে দেয়া বক্তব্যে বলেন, প্রাথমিকভাবে বিষয়টি ছোট ছিল, কিন্তু মাসনূন ও তার অনুসারীরা শিক্ষার্থীদের এ ঘটনায় জড়িত হতে উৎসাহিত করে, যা তুচ্ছ ঘটনাকে বড় সংঘর্ষে পরিণত করেছে।

জানতে চাইলে চবি শাখা ছাত্রদলের সিনিয়র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ ইয়াছিন দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ঘটনা জানার পর আমি স্থানীয় কয়েকজন মুরুব্বিকে ডাক দেই। কিন্তু ওই বাসায় গিয়ে দেখি দারোয়ান ও কেয়ারটেকার নাই। এ সময় ক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা দারোয়ানকে ধরে নিয়ে আসবে বলে আরও গ্রামের ভিতরে প্রবেশ করতে চায়। তিনি বলেন, আমি শিক্ষার্থীদের ওদিকে যেতে বারবার নিষেধ করি। কিন্তু কেউ কেউ আমার সঙ্গে উদ্ধত আচরণ করে। তারা বলছে, ওদিকে আমাদের পোলাপান আটকে আছে, তাদের উদ্ধার করব। কিন্তু কেউ স্পেসিফিক কোনো তথ্য দিতে পারছিল না।

শাখা ছাত্রশিবিরের সেক্রেটারি মোহাম্মদ পারভেজ দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, বাগছাসের উস্কানির কারণে শিক্ষার্থীরা গ্রামে প্রবেশ করে। আমরা বাধা দিতে গেলে আমাদের অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করা হয়। কিন্তু ওই রাতে শিক্ষার্থীদের বিরত না রাখলে আরও ম্যাসিভ আকার ধারন করতে পারত।

চবি হামলা
চবিতে হামলায় আহত শিক্ষার্থীরা

 

বাগছাসের উস্কানিতে সংঘর্ষ গড়ায় দ্বিতীয় দিনে
জানা গেছে, সকালে গ্রামের বিভিন্ন মেস ও বাসা-বাড়িতে ভাড়া থাকা শিক্ষার্থীদের হুমকি দেয়ার অভিযোগ ওঠে। এক পর্যায়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. মো. কামাল উদ্দিন ও প্রক্টর অধ্যাপক ড. তানভীর মোহাম্মদ হায়দার আরিফ গ্রামে প্রবেশ করে মীমাংসা করেন। পরে আবার উস্কানি দেয়া হলে প্রো-ভিসি আরেকবার ঘটনাস্থলে যান। এর কিছুক্ষণ পরই বেলা ১২টার দিকে সংঘর্ষ শুরু হয়।

এ বিষয়ে বিকেলে এক সভায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টর নাজমুল হাসান নাম উল্লেখ না করলেও শিক্ষার্থীদের একাংশের উস্কানিমূলক ভূমিকার কথা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, আমরা যখন বিষয়টি নিয়ে কথা বলছিলাম, তখন দুয়েকজন শিক্ষার্থী অন্যদিকে গিয়ে উত্তেজিত হয়ে যায়। তারা রাস্তার উপর ইট ভাঙতে শুরু করে। আমি শিক্ষার্থীদের দোষ দিচ্ছি না। কিন্তু আমরা বিষয়টি আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে পারতাম। এতে আজ আমার এতজন শিক্ষার্থীর রক্ত ঝরতো না।

জানতে চাইলে সহকারী প্রক্টর নাজমুল হোসেন টিডিসিকে বলেন, দ্বিতীয় দিনে আমরা গ্রামবাসীদের সাথে আলোচনার পর ৩৪ জন ছাত্রকে নিরাপদে বের করে আনার চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু কয়েকজন ছাত্র প্রক্রিয়াটি নষ্ট করে দেয়। পরে সংঘর্ষ শুরু হয়।

এদিকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে দেয়া এক ভিডিও বার্তায় স্টুডেন্ট এলায়েন্স ফর ডেমোক্রেসির (স্যাড) আহ্বায়ক তৌহিদুল ইসলাম অভিযোগ করে বলেন, প্রো-ভিসি মীমাংসা করার সময় কিছু ছাত্রনেতা শিক্ষার্থীদের উস্কানি দিতে শুরু করে। তারা বলে, রক্তের বদলে রক্ত নিতে হবে।

তৌহিদ বলেন, আমরা গ্রামবাসীর সঙ্গে মিটমাট করে যখন ফিরে আসব, তখনই বাগছাসের উৎসাহী ছাত্রনেতা সাব্বির রিয়াদ ও রেজাউররা ইটপাটকেল ছুঁড়তে শুরু করে। এ ঘটনায় যদি আমি বিচার করি, এখানে জোবরার মানুষ ছিল পুরো ইনোসেন্ট। ওদের কোনো দোষ ছিল না। সমঝোতায় ওরা রাজি হয়েছিল। শিক্ষার্থীদের হামলাতেই প্রো-ভিসি অধ্যাপক ড. মো. কামাল উদ্দিন আহত হন বলে দাবি করেন তৌহিদুর ইসলাম।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের (বাগছাস) কেন্দ্রীয় যুগ্ম আহবায়ক মাহফুজুর রহমান দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ছাত্রনেতাদের উস্কানি থাকতে পারে। তবে এ বিষয়ে আমি ঢালাওভাবে কিছু বলবো না। প্রশাসন তদন্ত করে বের করবে কাদের উস্কানিতে এই সংঘর্ষ হয়েছে।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চবি শাখার সদস্যসচিব আল মাসনূনকে কল দেয়া হলে তিনি কথা বলতে রাজি হননি। তবে রবিবার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে দেয়া এক ভিডিও বার্তায় তিনি বলেন, একজন নারীকে হেনস্তা করায় এ ঘটনার সূত্রপাত হয়েছে। এটি আমাদের সবচেয়ে বড় কনসার্ন ছিল। আমরা ওখানে গিয়ে দেখি মেয়েগুলো আটকা। তারা চিৎকার করছে ওরা এখানে সেইফ না। আমরা তখন দেখি দারোয়ান পালাচ্ছে পিছন দিকে। আমরা যাই তাকে ধরতে। নিশ্চয় সে কিছু করেছে, না করে থাকলে পালাবে কেন?

এক পর্যায়ে দারোয়ানকে ধরতে সক্ষম হলে কিছু সিএনজিওয়ালা এসে তাকে ছাড়িয়ে নেয় বলে দাবি করেন মাসনূন। বলেন, এ সময় উভয় পক্ষে ধাক্কাধাক্কি শুরু হয়। এতে একজনের ছোখের নিচে আঘাত করা হয়। আরও তিনজনকে গ্যারেজে নিয়ে মারধর করা হয়।

বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে বারবার কল দিলেও পাওয়া যায়নি অভিযোগ করে ভিডিওবার্তায় তিনি বলেন, প্রশাসনকে ডেকে যখন পাওয়া যায়নি, তখন আমাদের একমাত্র সম্বল আমাদের শিক্ষার্থীরা। উপস্থিত সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ডাকা শুরু করে যে আসেন, আমাদের উপর হামলা করা হচ্ছে। প্রায় মারামারি হওয়ার কারণে শিক্ষার্থীরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে এতে সাড়া দেয় বলে দাবি করেন তিনি। একই সাথে এ ঘটনায় তাকে ও বাগছাসকে দায় দেয়া ব্যক্তিরা ‘ফ্যাসিস্টের মতো’ আচরণ করছে বলে দাবি করেন।

পুলিশ ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে যথাসময়ে পাওয়া যায়নি
ছাত্রদল নেতা মোহাম্মদ ইয়াছিন বলেন, ঘটনার শুরুতে প্রক্টরকে ফোন করলেও তাকে পাওয়া যায়নি। এটি ক্যাম্পাসের বাইরের হওয়ায় সাথে সাথে আমি হাটহাজারী থানার ওসিকে ফোন দেই। কিন্তু ওসি ফোর্স পাঠানোর মতো অবস্থা নাই বলে জানান। তিনি বলেন, ফোর্স যদি সময়মতো পাঠাতো। তাহলে শিক্ষার্থীরা আর ওদিকে যেত না। একই সাথে প্রক্টরিয়াল বডি সঠিক সময়ে আসলে ভালো হতো।

মোহাম্মদ ইয়াছিনের অভিযোগ, হাজার হাজার ছেলে মার খেয়ে যাওয়ার পর পুলিশ আসে। এর মধ্যে একটি পুলিশ ভ্যান খালি, আর পিছনের সিএনজিতে দুজন। আর প্রক্টরিয়াল বডি যদি দ্রুত সংঘর্ষস্থলে আসত, তাহলে এটি বড় হত না। এ বিষয়ে জানতে হাটহাজারী মডেল থানার ওসি আবু কাওসারকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি সাড়া দেননি।

সংঘর্ষের পর
দুদিনের সংঘর্ষে গুরুতর আহত হয়ে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে তিন শিক্ষার্থী। তারা হলেন—ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী নাঈমুল ইসলাম, সমাজতত্ত্ব বিভাগের ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী মো. মামুন ও একই শিক্ষাবর্ষের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষার্থী ইমতিয়াজ আহমেদ সায়েম। এর মধ্যে নাঈমুল ইসলামের অবস্থা বেশি গুরুতর হওয়ায় ঢাকায় চিকিৎসাধীন।

এদিকে রবিবার ১১টা থেকে সংঘর্ষ শুরু হয়। পরে বিকাল ৩টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তা দপ্তরে সংরক্ষিত অস্ত্র লুট হয়। লুট হওয়া দেশীয় অস্ত্রসমূহ যাদের কাছে আছে তাদেরকে আগামী ৪৮ ঘন্টার মধ্যে নিরাপত্তা দপ্তরে জমা দেওয়ার জন্য নির্দেশ দিয়েছে প্রক্টর অফিস। অন্যথায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।

অপরদিকে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার স্বার্থে জারি হওয়া ১৪৪ ধারা মঙ্গলবার রাত ১২টায় শেষ হয়েছে। সংঘর্ষের ঘটনায় হাটহাজারী মডেল থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম। তিনি জানান, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ৯৫ জনের নাম উল্লেখ ও ১ হাজার জনের নামে অজ্ঞাত মামলা করা হয়েছে।

এ ছাড়া মঙ্গলবার জরুরি সিন্ডিকেট সভায় ১৩টি সিদ্ধান্ত নিয়েছে প্রশাসন। সিদ্ধান্তগুলো হলো—শনি ও রোববার (৩১ আগস্ট, ১ সেপ্টেম্বর) বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের ওপর স্থানীয় দুষ্কৃতকারী কর্তৃক হামলার তীব্র নিন্দা ও উদ্বেগ প্রকাশ করে এবং উদ্ভূত পরিস্থিতিতে আহত সবার প্রতি গভীর সমবেদনা ও সহানুভূতি জ্ঞাপন করে। আহত সব শিক্ষার্থীর উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করা ও ব্যয়ভার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক বহন করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়; উদ্ভূত ঘটনায় আহত শিক্ষার্থীদের একটি তালিকা প্রস্তুতের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়; সাধারণ শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা বিধানের স্বার্থে দ্রুততম সময়ের মধ্যে একটি মডেল থানা স্থাপন, রেলগেটে নিরাপত্তাচৌকি স্থাপন এবং বিশ্ববিদ্যালয় শাটল ট্রেনে নিরাপত্তা নিশ্চিতে ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।

এ ছাড়া যেসব ভবন/কটেজে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বসবাস করেন, সেসব ভবন/কটেজের মালিকদের সঙ্গে আলোচনা করে শিক্ষার্থীদের ঘরভাড়াসহ অন্যান্য সমস্যাজনিত অসন্তোষ নিরসনে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়; বিশ্ববিদ্যালয় মেডিকেল সেন্টারকে আধুনিকায়নের লক্ষ্যে দ্রুততম সময়ের মধ্যে দুটি অ্যাম্বুলেন্স ক্রয় ও ৫০ শয্যাবিশিষ্ট আধুনিক হাসপাতালে রূপান্তরের জন্য ডিপিপি প্রণয়ন করে সরকারের কাছে দাখিলের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়; বিশ্ববিদ্যালয়কে পূর্ণাঙ্গ আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত করার লক্ষ্যে ১০ তলাবিশিষ্ট ৫টি ছাত্র হল এবং ৫টি ছাত্রী হল নির্মাণের লক্ষ্যে দ্রুততম সময়ের মধ্যে ডিপিপি প্রস্তুত করে সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরে দাখিলের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়; আবাসিক হলগুলো সংস্কার করে শিক্ষার্থীদের বসবাস উপযোগী করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। বিদ্যমান পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত স্ট্রাইকিং ফোর্স মোতায়েন রাখার ও টহল কার্যক্রম অব্যাহত রাখার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ জানানোর সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।

৩০ ও ৩১ আগস্ট সংঘটিত ঘটনা তদন্ত করে এর কারণ অনুসন্ধান, ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণসহ দোষীদের চিহ্নিত করার জন্য একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠনের জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলে অনুরোধ জানানোর সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়; শনি ও রোববার সংঘটিত ঘটনা তদন্ত করে এর কারণ অনুসন্ধান, দোষীদের চিহ্নিতকরণ ও ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নিম্নরূপে একটি কমিটি গঠন।

একই সাথে সংঘর্ষের ঘটনায় গত রবিবার থেকে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত সব পরীক্ষা স্থগিতের আদেশ দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। তবে ঘটনার দায় নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পদত্যাগ দাবিতে আন্দোলন করেছে শাখা ছাত্রদল ও গণতান্ত্রিক ছাত্রজোটের নেতাকর্মীরা। অপরদিকে সংঘর্ষে গ্রামবাসীর বাড়িঘর ও দোকানপাট ভাঙচুর এবং লুটপাটের অভিযোগ করছে গ্রামবাসী।

বাংলাদেশের হাইকমিশনারকে দিল্লি থে‌কে ঢাকায় জরুরি তলব
  • ২৯ ডিসেম্বর ২০২৫
খালেদা জিয়ার মৃত্যুতে চীনের প্রধানমন্ত্রীর শোক
  • ২৯ ডিসেম্বর ২০২৫
জকসু নির্বাচন স্থগিতের খবরে জবি ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের বি…
  • ২৯ ডিসেম্বর ২০২৫
ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত হাবিপ্রবি  শিক্ষার্থী লাবণ্য, চিক…
  • ২৯ ডিসেম্বর ২০২৫
জকসু নির্বাচন স্থগিতের খবরে জবি ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের বি…
  • ২৯ ডিসেম্বর ২০২৫
রাজনৈতিক সাফল্যের কারণেই খালেদা জিয়া প্রতিহিংসার শিকার হয়…
  • ২৯ ডিসেম্বর ২০২৫