জিপে উঠে আর ফেরেননি শহীদ হবিবুর
- রায়হান ইসলাম
- প্রকাশ: ১৫ এপ্রিল ২০২২, ০৩:৪৫ PM , আপডেট: ১৫ এপ্রিল ২০২২, ০৩:৫২ PM
সময়টা ১৯৭১ সালের ১৪ এপ্রিল। বিকেলবেলা। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পাক-হানাদার বাহিনীর ক্যাম্প। চারদিকে আতঙ্ক। বাহিরে সবকিছু এতটা নিস্তব্ধ যেন দুপুরকে মধ্যরাতের মতন মনে হচ্ছে। জনৈক প্রতিবেশীর ছেলেটি এসে ডাকতে থাকে। ওকে বেরুতে নিষেধ করলাম। কিছু শুনল না। বেরিয়ে গেল।...
খানিক পরে ফিরে এলো। চিন্তাক্লিষ্ট ও বিষণ্ন। আর্মির সঙ্গে দেখা করতে হবে। ভয়ের কিছু নেই।...পরের দিন (১৫ এপ্রিল) বিকেল হয়ে এসেছে। আসরের নামাজ পড়ব। নামাজে বসেছি এমন সময় একটি জিপ এসে থামল। ‘স্যান্ডেল পরে ওর দোতলা থেকে নেমে যাওয়ার শব্দ পাচ্ছি।...সালাম ফিরিয়ে দেখি ও ঘরে নেই, জিপ নেই, দূরে জিপ যাচ্ছে।... তারপর ‘আমার স্বামী আর ফিরে আসেননি।
শহীদ বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক হবিবুর রহমানের স্ত্রী ওয়াহিদা রহমানের লেখা ‘আমার স্বামী’ রচনা থেকে তৎকালীন ঘটনা সম্পর্কে এসব তথ্য জানা যায়।
পাক হানাদার বাহিনী ক্যাম্পাসে প্রবেশের পরবর্তী পরিস্থিতি বর্ণনায় ওয়াহিদা রহমান তাঁর রচনায় লিখেছেন, ‘...বোধহয় এপ্রিলের ১৩ তারিখ হবে। ও সকালে আমাকে বললো, “গ্রামে যাওয়ার জন্য তৈরি থেকো। আমাদের চলে যেতে হতে পারে।”...কিন্তু বিকেল নাগাদ পাকিস্তানি সৈন্যরা ক্যাম্পাসে ঢুকে পড়েছে। আমাদের আর যাওয়া হলো না।...ক্যাম্পাসে ৬/৭টি মাত্র পরিবার।
কেউ নেই চারি-পাশে। ওর পক্ষে এরপর পালানো সম্ভব হবে কি? তবু আল্লাহ ভরসা করে ওর পকেটে কিছু টাকা গুঁজে দিয়ে ওকে প্রায় জোর করে বের করে দিলাম ঘর থেকে।...‘পরের দিন আলো ফোটার আগেই পিছনের দরজা দিয়ে ও ঢুকলো। বললো পাশের পরিত্যক্ত ফ্লাটটিতে রাতে ছিল। ওর পক্ষে আমাদের ফেলে রেখে যাওয়া সম্ভবপর নয়। ও এসে এক গ্লাস দুধ খেয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল। তখন সারা ক্যাম্পাস শুনশান।
আরও পড়ুন- নামাজের পরপরই আল আকসায় ইসরাইলি বাহিনীর হামলা, আহত শতাধিক
মুক্তবুদ্ধি ও অসাম্প্রদায়িক জীবনবোধে বিশ্বাসী মানুষ ছিলেন শিক্ষাবিদ মুহাম্মদ হবিবুর রহমান। তিনি বাঙালির গুরুত্বপূর্ণ সকল আন্দোলন-সংগ্রামে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। ষাটের দশকের বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন, উনসত্তরের গণ-আন্দোলন ও বাংলাদেশের স্বাধীনতার আন্দোলনে ছিল তার প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ।
জানা যায়, এক সময় এম এন রায়ের র্যাডিকেল হিউম্যানিস্ট পার্টির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন শহীদ হবিবুর রহমান। ভারত ভাগের পর ঢাকায় হাজী ওসমান গনি রোডে (তখন মনোয়ার খান বাজার রোড) নিজ বাসায় ছিল এই দলের অফিস। সেখানে নিয়মিত যাতায়াত ছিল অধ্যাপক জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, অজিত গুহ, অশ্বিনী বাবু, সালাহ্উদ্দীন আহমদ, ডা. টি হোসেন, সাহিত্যিক আবদুল গনি হাজারী, বিভূতি সেন প্রমুখ।
শহীদ হবিবুর রহমান ছিলেন সত্যের জন্য এক নির্ভীক সৈনিক। অন্যায়ের কাছে কখন মাথানত করেননি তিনি। ২৬ মার্চ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে ক্যাম্পাসে অবস্থানরত পাকিস্তানি সেনারা তাঁর বাসায় উত্তোলিত কালো পতাকা নামিয়ে ফেলার নির্দেশ দিলে তিনি বলেন, ‘এ পতাকা নামানোর জন্য তোলা হয়নি।’
তৎকালীন সময়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গনিত বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় সভাপতি ছিলেন শহীদ বুদ্ধিজীবী হবিবুর রহমান। '৭১ সালের ১৫ এপ্রিল বিকেলে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি দল সামরিক জিপে মুহাম্মদ হবিবুর রহমানের বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের বাসায় এসে তাঁকে নিয়ে যায়। তাঁর আর খোঁজ পাওয়া যায়নি। কবে, কোথায় কীভাবে তাঁকে হত্যা করা হয়, তা পরিবারের সদস্যরা জানতে পারেননি। তাঁর মরদেহও পাওয়া যায়নি।
আরও পড়ুন- বিদ্যালয়ে ছাত্রদের তুলনায় ছাত্রী উপস্থিতি বেড়েছে
১৯২১ সালের ১ জানুয়ারি নোয়াখালী জেলার চাটখিল উপজেলার বালিয়াধার গ্রামের কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন শহীদ হবিবুর রহমান। তার পিতার নাম মৌলবি কলিম উদ্দিন ভূঁইয়া ও মাতার নাম সিদ্দীকা খাতুন। ছোটবেলা থেকেই শিক্ষার প্রতি ছিল তাঁর গভীর অনুরাগ। তিনি নিজের ইচ্ছায় বালিয়াধার গ্রাম থেকে পাশ্ববর্তী কয়েকটা গ্রামের পরে বটগ্রামের কাছে অবস্থিত প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। পরবর্তীতে প্রতিদিন প্রায় দেড়-দুই মাইল পথ পায়ে হেঁটে বিদ্যালয়ে পড়তে যেতেন এ শহীদ বুদ্ধিজীবী।
ছোটবেলা থেকেই অনেক মেধাবী ছাত্র ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শহীদ বুদ্ধিজীবী। পঞ্চম শ্রেণীতে বৃত্তি লাভের মাধ্যমে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করেন তিনি। ১৯৩৮ সালে নোয়াখালী জেলাস্থ চাটখিল উপজেলার দত্তপাড়া উচ্চ বিদ্যালয় থেকে পাঁচটি বিষয়ে লেটারসহ স্টারমার্ক পেয়ে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাশ করেন তিনি। পরবর্তীতে ১৯৪০ সালে তৎকালীন ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে থেকে আই.এস.সি. পাস করেন।
১৯৪৩ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে অনার্স ডিগ্রি লাভ করেন হবিবুর রহমান। ১৯৪৬ সালে আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রেকর্ড নম্বরসহ গণিতে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়ে এম.এস.সি. ডিগ্রি লাভ করেন তিনি। তার এই অসাধারণ ফলাফলে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য ও প্রখ্যাত গণিত বিশারদ স্যার জিয়াউদ্দীন বাংলার তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী এ. কে. ফজলুল হকের নিকট হবিবুরকে স্টেট স্কলারশিপ ও চাকরি দেওয়ার জন্য বিশেষ সুপারিশপত্র দেন।
কর্মজীবনে হবিবুর রহমান কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে গণিতের প্রভাষক পদে যোগদানের মাধ্যমে কর্মজীবন শুরু করেন। পরবর্তীতে কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে এবং ১৯৫২ সাল পর্যন্ত ঢাকা কলেজে কর্মরত ছিলেন। ১৯৫৪ সালের নভেম্বরে তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিত বিভাগের প্রভাষক পদে যোগদান করেন। ১৯৫৪ সালেই তিনি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিত শাস্ত্রে ট্রাইপস ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি ১৯৫৮ সালে গণিত বিভাগের রিডার পদে উন্নীত হন।
এছাড়া ১৯৬২ সালে ফলিত গণিতে উচ্চতর শিক্ষালাভের উদ্দেশ্যে যুক্তরাষ্ট্রে গমন করেন তিনি। ১৯৬৪ সাল থেকে ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের প্রধান হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৭ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের সৈয়দ আমীর আলী হলের প্রাধ্যক্ষ নিযুক্ত হন। ১৯৭০ সালে পুনরায় গণিত বিভাগের প্রধান নিযুক্ত হন এবং নিখোঁজ হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত এ পদেই নিয়োজিত ছিলেন শহীদ হবিবুর রহমান।
তৎকালীন শহীদ হবিবুর রহমানের ছাত্র ও সহকর্মী ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গনিত বিভাগের সাবেক অধ্যাপক সুব্রত মজুমদার। তিনি শহীদ এ বুদ্ধিজীবীর স্মৃতিচারণ করে বলেন, শহীদ হবিবুর রহমান ছিলেন অত্যন্ত কোমল ও বাস্তববাদী মানুষ। সর্বদা তিনি অসাম্প্রদায়িক ও মুক্ত চিন্তার লালন করতেন। তিনি ন্যায়ের পক্ষ যেমন ছিলেন কোমল, তেমনি অন্যায়ের বিরুদ্ধে বজ্রকঠিন। এমনকি ক্লাসে শিক্ষার্থী গুণগত মান উন্নতির জন্য সর্বদা পরিশ্রম করতেন। তাঁর আচার আচরণ সর্বদা শিক্ষার্থীদের মুগ্ধ করত।
হত্যার কথা তুলে তিনি বলেন, পাক হানাদার বাহিনী ক্যাম্পাসে এসে শিক্ষকের উপর নজরদারি করা শুরু করেন। সেজন্য তাঁর উপরও নজর ছিল হানাদারদের। কেননা তিনি অসাম্প্রদায়িক চিন্তাভাবনা লালন করতেন। পাক হানাদার ক্যাম্পাসে আসার পর অনেকে ক্যাম্পাস ছেড়ে গ্রামে কিংবা অন্যত্র চলে যেতে থাকেন। কিন্তু তিনি ক্যাম্পাস ছাড়েন নি। একপর্যায়ে ১৫ এপ্রিল তাঁকে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে যান পাক হানাদাররা। কিন্তু পরবর্তী তার আর কোন খবর পাওয়া যায়নি।
তিনি বলেন, শহীদ হবিবুর রহমানকে যখন নিয়ে যাওয়া হয়, তখন তাঁর স্ত্রী আসরের নামাজ পড়ছিলেন। নামাজ শেষে বারান্দা থেকে যখন বাহিরে তাকালেন ততক্ষণে তাঁকে জিপে করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। তিনি একবার বাড়ির দিকে তাকিয়েছিলেন। হয়তো বুঝতে পেরেছিলেন তিনি আর ফিরে আসবেন না। এমনকি তিনি স্ত্রী বলেও যেতে পারেন নি, আমি চলে যাচ্ছি।
এদিকে স্বাধীনতার অর্ধশত বছর পরে এসে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল শহীদের স্মরণে স্ব স্ব দিনটি শহীদ দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। ফলে প্রতিবছর বিশ্ববিদ্যালয়ে এ দিবস পালিত হবে। সেই ধারাবাহিকতায় আজ ১৫ এপ্রিল বিশ্ববিদ্যালয়ের গনিত বিভাগের পক্ষ থেকে শোক র্যালি বের হয়ে শহীদ হবিবুর রহমান হলের বিদ্যার্ঘ স্মৃতিস্তম্ভে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। এছাড়া সন্ধ্যা শহীদ হবিবুর রহমান হলে তাঁর রুহের মাগফেরাত কামনা করে দোয়া ও ইফতারের আয়োজন করা হয়েছে।
তথ্যসূত্র- শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মারক ডাকটিকিট (দ্বিতীয় পর্যায়) প্রকাশ উপলক্ষে প্রকাশিত স্মরণিকা (১৯৯৩) থেকে। গ্রন্থনা-রশিদুল ইসলাম ও উইকিপিডয়া।