ঢাবির টিএসসিতে ধর্ষণ, জানে না প্রশাসন
- লিটন ইসলাম
- প্রকাশ: ২৯ মার্চ ২০২২, ০৭:৩৭ PM , আপডেট: ২৯ মার্চ ২০২২, ০৮:০১ PM
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের (টিএসসি) একটি কক্ষে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ করেছেন রাজধানীর স্বনামধন্য কলেজের এক ছাত্রী। গত বছরের ৩ এপ্রিল রাতে এই ঘটনা ঘটে। ওই ছাত্রী আকিফের সংগঠন ছাত্র ইউনিয়নের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চলচ্চিত্র সংগঠন বরাবর অভিযোগ পত্র দেন। প্রায় এক বছর আগে ঘটে যাওয়া এই ঘটনার সত্যতা স্বীকার করেছেন অভিযুক্ত আকিফ আহমেদও।
অভিযোগ পাওয়ার পর দুই সংগঠন থেকেই বহিষ্কার করা হয় আকিফকে। ঘটনাটি নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সমালোচনার ঝড় ওঠে। তবে অভিযোগের বিষয়ে এখনো কিছুই জানেন না বলে জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ও প্রো-ভিসি।
সম্প্রতি আকিফ আহমেদ ছাত্র ইউনিয়ন ঢাবি শাখার প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক ছিলেন। পদ পাওয়ার পরই অভিযোগ করেন ওই ছাত্রী। অভিযোগ পত্রে ছাত্রীটি উল্লেখ করেন, ‘আমি বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের কর্মী নই কিন্তু বিভিন্ন সময়ে ছাত্র ইউনিয়নের সাথে একত্রে ধর্ষণ বিরোধী, স্বৈরাচার বিরোধী, ছাত্রদের অধিকার আদায়ের বিভিন্ন আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে যুক্ত থেকেছি।’
‘সম্প্রতি ১৩ মার্চ, ২০২২ তারিখে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তি থেকে ঢাবি সংসদের ৩৪ তম কার্যনিবার্হী কমিটি গঠনের খবর পাই। কমিটির সদস্যদের তালিকায় দেখতে পাই যে, "আকিফ আহমেদ" ( তথ্য বিজ্ঞান ও গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনা বিভাগ; সেশনঃ ২০১৮-১৯ , ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়) এই কমিটিতে প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদকের পদপ্রাপ্ত হয়েছে। বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের অবগতির জন্য জানাচ্ছি যে, আপনার সংগঠনের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক পদে থাকা ছাত্রনেতা "আকিফ আহমেদ" এর বিরুদ্ধে আমি ধর্ষণের অভিযোগ আনছি। গতবছর ৩ এপ্রিল ২০২১ তারিখ রাত সাড়ে এগারোটায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে, ছাত্র ইউনিয়ন সংশ্লিষ্ট সংগঠন সাংস্কৃতিক ইউনিয়নের রুমে অবস্থানরত সময় সে আমাকে ধর্ষণ করে। দুইজনের সম্মতিতে শারীরিক সম্পর্ক হলেও পরে আমি অনীহা প্রকাশ করি। সেসময় আকিফ জোরজবরদস্তি করে। এতে আমি আঘাতপ্রাপ্ত হই। ওই ছাত্রী দাবি করেন, আকিফের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কে বিরতি চাইলে সে মাতাল অবস্থায় এই কাজ করে।’
আরও পড়ুৃন- ৪০তম বিসিএসের ফল হতে পারে চলতি সপ্তাহে
অভিযোগের সত্যতা স্বীকার করে আকিফ বলেন, ‘ঘটনার দিন ভিক্টিম আমার সাথে দেখা করতে আসে। ঘটনার কিছুদিন আগে তার সাথে আমার সম্পর্কে থাকা না থাকা নিয়ে একটি ঝগড়া হয়। তার (ছাত্রী) ভাষ্য মতে, সে কনফিউশনে ছিলো আমার এবং তার প্রাক্তন প্রেমিকের মধ্যে। যেখানে সে আমার থেকে সম্পর্কে বিরতি চায়। কিন্তু দেখা করতে আসার কারণ ছিলো সে আমার সাথে সম্পর্কে থাকতে চায়, সাথে সাথেই বিষয়টির স্বচ্ছতা দান করতে চায়। সে যখন দেখা করতে আসে আমি তখন মাতাল অবস্থায় ছিলাম।’
আকিফ আরও বলেন, ‘ঘটনাটি গতবছর লকডাউনের সময়ের। তখন টিএসসিতে মানুষের খুব বেশি যাতায়াত ছিলো না। আমার কাছে সাংস্কৃতিক ইউনিয়নের একটি চাবি থাকতো। হল বন্ধ থাকার কারণে আমি মাঝে মাঝে সেখানে থাকতাম যেহেতু আমার থাকার জায়গার একটি সমস্যা ছিলো। ঘটনার দিন ভিক্টিম উক্ত স্থানে আসে। দুইজনের সম্মতিতে শারীরিক সম্পর্কে জড়ালেও অনিচ্ছা স্বত্বেও আমার দ্বারা বলপ্রয়োগের একটি ঘটনা ঘটে যার দরুণ ভিক্টিম আঘাত পায়। ঘটনার পর দিনই ভিক্টিম আমাকে আমার গতরাতের আচরণ বলার পর আমি আমার ভুল স্বীকার করি এবং আমার আচরণের জন্য অনুতপ্ত হয়ে ক্ষমা চাই। এরপর প্রায় দুই মাস আমাদের মাঝে উক্ত ঘটনা নিয়ে দেখা ও কথা হয়। একটা সময় আমি তাকে আমার অবস্থা বোঝাতে পারি। আমি যে ভুল করেছি এবং সেটা স্বীকার করি সে তার জায়গা থেকে এই বুঝে এবং আমরা আবার সম্পর্কে যাই যেটি প্রায় ছয় মাস ছিলো। এই সময়ে উক্ত বিষয় নিয়ে আমাদের মধ্যে আর কথা হয়নি। একসময় বিভিন্ন কারণে সম্পর্কটি ভাঙ্গে যার সাথে এই ঘটনার কোন সম্পর্ক নেই। পরবর্তীতে সে যোগাযোগ করতে চাইলেও আমি আমার আর্থ-সামাজিক অবস্থার কারণে ব্যস্ত থাকায় তার সাথে যোগাযোগ রাখতে পারিনি।’
আরও পড়ুন- চবিতে ডিন নির্বাচন করছেন রাবিপ্রবি ভিসি
আকিফ বলেন, ‘এমন ঘটনা দেশের প্রচলিত আইনে ‘ধর্ষণ’ বলে গণ্য না হলেও আমি আমার দর্শনের জায়গা থেকে ঘটনাটি ধর্ষণ বলে জানি ও বিশ্বাস করি। তবে অভিযোগ দেয়ার বিষয়ে কয়েকজন লোকের ইন্ধন রয়েছে বলে দাবি করেন তিনি।’
এ বিষয়ে ছাত্র ইউনিয়ন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা তাদের ফেসবুক পেইজে বিস্তারিত জানিয়ে আসছিলো। প্রথম দফার পোস্টে ‘ভিক্টিম ব্লেইমিংয়ের’ সুযোগ সৃষ্টি হওয়ায় পরবর্তীতে তারা সেই পোস্ট তুলে নিয়ে নতুন করে আরেকটি পোস্ট দেয়। আগের পোস্টের জন্য দুঃখ প্রকাশ করে সংগঠনটি। তাদের এমন কর্মকাণ্ডের জন্য ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটি ঢাবি শাখার কার্যক্রম স্থগিত করে। যদিও সেটি মানতে নারাজ বিশ্ববিদ্যালয় শাখা। তাদের দাবি, যারা বহিষ্কার করেছেন তারা সংগঠনের অন্য একটি পক্ষ।
অভিযোগের বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক আদনান আজিজ চৌধুরী বলেন, ‘অভিযোগ পাওয়ার পর যাচাই করে আকিফকে সংগঠনকে থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। ভিক্টিমকে বলেছি, আইনি পদক্ষেপ নিলে সেখানে আমরা সহায়তা করবো। কিন্তু ভিক্টিম চাননি। তিনি আরও বলেন, আমরা নিজেদের জন্য একটা ফ্রেম ওয়ার্ক তৈরি করছি। যাতে পরবর্তীতে এই ধরনের ঘটনা যেন না ঘটে।’
আরও পড়ুন- রমজানে লোডশেডিং না দেওয়ার নির্দেশ
আকিফ আহমেদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চলচ্চিত্র সংসদেরও সদস্য ছিলেন। অভিযোগ পাওয়ার পর তাকে সংগঠন থেকে বহিষ্কার করে অবাঞ্চিত ঘোষণা করা হয়। এ বিষয়ে সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক আবু তাহের জাহাদী বলেন, ‘লিখিত অভিযোগ পাওয়ার পর এক কার্যদিবসের মধ্যেই আমরা অভিযুক্তকে বহিষ্কার করি। অভিযোগকারী আমাদের সংগঠনের সঙ্গে জড়িত না।’
ঘটনাটি ঘটে টিএসসির ২০৫ নম্বর কক্ষে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ‘ছাত্র ইউনিয়নের সাংস্কৃতিক উইং ‘সাংস্কৃতিক ইউনিয়ন’ দীর্ঘদিন ধরে কক্ষটি ব্যবহার করে আসছে। তবে এখানে আগে টিএসসির সাউন্ড সিস্টেমের যন্ত্রপাতি রাখা হতো। পরে ছাত্র ইউনিয়ন কক্ষটি নিজেদের দখলে নেয়। এটি তাদেরকে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বরাদ্দ দেয়নি।’
এ বিষয়ে ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের (টিএসসি) পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) সৈয়দ আলী আকবর বলেন, `ছাত্র ইউনিয়নের যে ঘটনা এই বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেউ আমাদের এখনও কিছু জানায়নি। এখানকার সংগঠনগুলো ২০/২৫ বছর আগে থেকেই এভাবে আছে। এখন তারা এসব রুম কীভাবে নিয়েছে সেটা তখনকার কর্তৃপক্ষ জানে। এছাড়া কক্ষগুলো উপাচার্য অনুমোদন দিয়ে থাকেন।'
কক্ষ বরাদ্দের বিষয়ে মন্তব্য করতে চাননি ছাত্র ইউনিয়নের ঢাবি শাখার সাধারণ সম্পাদক আদনান আজিজ চৌধুরী।
এদিকে ঘটনা জানাজানির এক সপ্তাহের চেয়ে বেশি সময় অতিবাহিত হলেও প্রশাসন বলছে তারা এ বিষয়ে কিছুই জানেন না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান বলেন, বিষয়টি আগে শুনিনি। অভিযোগও কেউ করেনি। কক্ষ বরাদ্দের বিষয়টি খোঁজ না নিয়ে বলা যাবে না।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভিসি (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ সামাদ বলেন, এমন কোনো অভিযোগের কথা শুনিনি। তবে এধরনের ঘটনা ঘটে থাকলে সেটি অনাকাঙ্খিত।