করোনাকালে ঢাবি ছাত্রীর উদ্যোক্তা হওয়ার গল্প

  © টিডিসি ফটো

করোনাভাইরাসের প্রকোপে থমকে আছে গোটা বিশ্ব। অর্থনৈতিক ব্যবস্থাও ভঙ্গুর। মহামারি এই ভাইরাসের প্রকোপ দেশে ছড়িয়ে পড়ায় গত ১৮ মার্চ থেকে বন্ধ রয়েছে বিশ্বববিদ্যালয় থেকে শুরু করে সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। বসে বসে অলস সময় পার করতে হচ্ছে কয়েক কোটি শিক্ষার্থীকে।

বিরূপ এই পরিস্থিতিতেও থেমে থাকেননি কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া কিছু শিক্ষার্থী। যাঁরা নানা প্রতিকূলতাকে জয় করে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তার ভূমিকায় নিজেদের দাঁড় করিয়েছেন। এমন একজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) জাপানি ভাষা ও সংস্কৃতি বিভাগের ব্যবস্থাপনা বিভাগের ২০১৬-১৭ সেশনের ছাত্রী জান্নাতুন নাঈমা।

উদ্যোক্তা হওয়ার আগ্রহ কিভাবে তৈরি হলো— এই প্রশ্নের জবাবে নাঈমা জানান, চার বছর আগে থেকেই ইচ্ছা ছিলো গতানুগতিক চাকরির পিছনে না ছুটে নিজের স্বাধীনতায় কিছু একটা করবো। চাকরি ব্যাপারটা দোষের নয় কিন্তু ব্যাক্তি স্বাধীনতার অভাব রয়েছে। তাই করোনাকালীন সময় পড়াশোনা থেকে কিছুটা অবসর সময় পাওয়াতে এই কাজে হাত দেওয়া সহজ হয়ে গেছে। একদিন হুট করে মাথায় আসছে এই সুযোগ কাজে লাগাতে হবে। সেই ভাবনা থেকেই উদ্যোক্তা হিসেবে যাত্রা।

করোনার সময়ে প্রিয়-ঘর নামক ফেসবুক পেজ থেকে শুরু করেন ই-কমার্স প্লাটফর্ম। এখান থেকে বিভিন্ন ধরনের চা পাতা, আচার ও বাদামসহ সাতকড়া ফল বিক্রি শুরু করেন। ঘরে বসেই যেকেউ কিনতে পারবেন এসব পণ্য। ভেজালের দুনিয়ায় ভেজালহীন, ফ্রেশ, বিশুদ্ধ পণ্যের একটা প্লাটফর্ম করার ইচ্ছে নিয়ে এই উদ্যােগ নেন তিনি।

অল্প পুঁজি দিয়ে ব্যবসা শুরু করেন নাঈমা। এখন প্রতিমাসে ২৫-৩০ হাজার টাকার পণ্য বিক্রি হয়। ব্যবসার শুরু থেকে আড়াই মাসের মধ্যে আমার লাখ টাকার পণ্য বিক্রি হয়েছে। আর এখন তিনমাসেশেষে দেখা যাচ্ছে, প্রতিমাসে গড়ে ৪০ হাজারের উপরে বিক্রি হচ্ছে। এতো কম পুঁজি দিয়ে শুরু করে লাখ টাকার বিক্রিটা অনেক বড় প্রাপ্তি বলে মনে করেন এই ছাত্রী।

কখন, কিভাবে উদ্যোক্তা হিসেবে যাত্রা— এই প্রশ্নের জবাবে নাঈমা জানান, করোনা যখন অনেকটা স্থিতিশীল অবস্থায় চলে আসছে, আর লকডাউন উঠে গেছে। মূলত কোরাবানি ঈদের কয়েক সপ্তাহ আগে আমার উদ্যােগ শুরু করি। সিলেটের অন্যতম সিগনেচার পণ্য সাতকড়ার সিজনই হচ্ছে এই কোরবারির ঈদ। সিলেটিরা কোরবানীর ঈদে উৎসবের মতো করে ফ্রেশ মাংসের সাথে সাতকড়া ফল রান্না করে থাকে। এই কোরবানী ঈদে সাতকড়া খাওয়ার রীতি মূলত সিলেটের অন্যতম নিজস্ব সংস্কৃতি।

তিনি বলেন, আমার মূলধন ছিলো ৫০০ টাকার মতো, তারপর আস্তে আস্তে বাড়তে থাকে। মা-বাবা ও ভাইয়ের কাছ থেকে কিছু টাকা নিয়ে আমি ২ বস্তা সাতকড়া সেল দিয়েছিলাম। এসময় কিছু আচারও করেছিলাম। আমার আচারের সবেচেয়ে বেশি কাস্টমার নন সিলেটিরা, যারা একবার নেয়, তারা আবার নিতে আগ্রহ দেখায়। এমনও নন সিলেটি আছেন যিনি আমার কাছ থেকে তিন থেকে চারবার আচার নিয়েছেন। আমার এই আচার আমেরিকা, কানাডা ও ইংল্যান্ড পর্যন্তও গেছে।

‘এরপর থেকে আজ পর্যন্ত আমাকে ঘুরে তাকাতে হয়নি। সাতকড়ার সাথে সাথে কিন্তু আমার চা-পাতাও ছিলো। অনলাইনে দেখলাম চায়ের বিক্রেতা অনেক। তাই আমি চেষ্টা করছি একদম দূর্লভ চা পাতা রাখার; যেমন মধুপুরী হবিগঞ্জ এবং শ্রীমঙ্গলের মাত্র দুইটি চা-বাগানে পাওয়া যায়। তারপর মালনীছড়া চা বাগান হল উপমহাদেশের বৃহত্তম এবং সর্বপ্রথম প্রতিষ্ঠিত চা বাগান, যা সিলেট সদরে অবস্থিত। সেখানের সেরা চা পাতাটি রাখলাম। তারপর রাখলাম টিজি চা ,গোল্ডটি এগুলা এক্সপোর্ট পণ্য। গ্রিন-টি যারা স্বাস্থ্য সচেতন তাদের জন্য। এছাড়া শুধু রং চা লাভারের জন্য ক্লোন টিও রাখলাম।ধীরে ধীরে স্বাস্থ্য সচেতনতার কিছু খাবার এড করলাম ড্রাই-ফ্রুটস, হানি-নাট, মিক্স-নাটসহ বিভিন্ন জাতের বাদাম।’

তবে ব্যবসা শুরু করতে গিয়ে নানান চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করছেন এই ছাত্রী। তিনি জানান, সাতকড়া যেহেতু পচনশীল খাবার আর আমার কিছু প্রি-অর্ডার যেগুলো অনেক বড় অর্ডার ছিলো, তাই অর্ডার বাতিল হয়ে গেলে আমি একটু ঘাবড়ে যেতাম। তারপর প্রচার-প্রচারণা বাড়িয়ে দেওয়া আর কিছু বন্ধু-বান্ধুবের সহযোগিতায় যে ক্ষতির শঙ্কা ছিল সেটা আর হয়নি। বরং কোরবান ঈদের আগের দিন রাত পর্যন্ত আমার বাসায় এসে মানুষ সাতকড়া নিয়ে গেছে। এখানে পচনশীল দ্রব্য আর অর্ডার বাতিলের পর সবকিছু ঠিক করে চালিয়ে নেয়া তার জন্য অনেক বড় চ্যালেঞ্জ ছিল বলে জানান তিনি।

করোনাকালে নানা প্রতিকূলতাকে জয় করে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তার ভূমিকায় নিজেদের দাঁড় করিয়েছেন অনেক শিক্ষার্থী। তাদের উদ্দেশ্যে নাঈমা বলেন, শুরু করতে চাইলে এখনের চেয়ে ভালো সময় আর হয় না। যেহেতু এখন মোটামোটি পড়াশোনার চাপ থেকে সবাই একটু মুক্ত আছে আর এখন উদ্যােক্তার সিজন বলা যায়। যত দেরিতে শুরু করবেন, এগিয়ে যেতে সময় ততবেশি লাগবে।

যেসব পণ্য নিয়ে কাজ করছেন ঢাবি ছাত্রী নাঈমা:

টিজি চা- পাতা
মধুপুরী চা-পাতা
মালনীছড়া চা-পাতা
ক্লোন চা-পাতা
গোল্ড চা পাতা
রেগুলার গ্রিন-টি
স্পেশাল গ্রিন-টি

সাতকড়া ফল
শুকনা সাতকড়া
সাতকড়ার আচার

নাগা মরিচের আচার
রসুনের আচার
তেঁতুলের আচার
বরই এর আচার

ড্রাই-ফ্রুটস,হানি-নাট
মিক্স-নাট,নাট পাউডার
আর কয়েক জাতের বাদাম


সর্বশেষ সংবাদ