২৬ জুন ২০২৫, ০৯:৫২

পিএইচডি ছাড়া শিক্ষক নিয়োগ নয়—চিন্তাতেই বন্দি, উদ্যোগ নেই

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়  © টিডিসি সম্পাদিত

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (ঢাবি) শিক্ষক নিয়োগে পিএইচডি ডিগ্রি বাধ্যতামূলক করার চিন্তা দীর্ঘদিনের। তবে এ ভাবনা কেবল নীতিগত আলোচনার মধ্যেই ঘুরপাক খাচ্ছে বছরের পর বছর। উচ্চশিক্ষার আন্তর্জাতিক মান রক্ষা, শিক্ষার মানোন্নয়ন ও গবেষণাধর্মী অ্যাকাডেমিক পরিবেশ নিশ্চিতের স্বার্থে এ ধরনের নীতিগত চিন্তা বহু আগেই নেওয়া হলেও, বাস্তবায়নে নেই কোনো কার্যকর ভূমিকা। বিগত প্রশাসনের আমলে এ নিয়ে সিন্ডিকেট সভায় আলোচনার প্রস্তুতি চললেও, প্রশাসনিক পরিবর্তনের পর থেমে গেছে সেই উদ্যোগ। অভ্যুত্থান পরবর্তী নতুন প্রশাসন এ নিয়ে আশ্বাস দিলেও বাস্তবে এখন পর্যন্ত কোনো দৃশ্যমান অগ্রগতি হয়নি।

বিশ্বের অনেক দেশেই বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে পিএইচডি ডিগ্রি অপরিহার্য। সেসব দেশে গবেষণাভিত্তিক শিক্ষা কাঠামো গড়ে তোলার ক্ষেত্রে যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এখনো মাস্টার্স ডিগ্রিধারী কেউ সরাসরি প্রভাষক পদে নিয়োগ পাওয়ার পর নিয়ম মেনেই অধ্যাপক পর্যন্ত পদোন্নতি পাচ্ছেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক সূত্র বলছে, শিক্ষক নিয়োগের পরপরই অনেকেই উচ্চতর ডিগ্রির জন্য বিদেশে চলে যান। তারা শিক্ষা-ছুটি নিয়ে বছরের পর বছর দেশের বাইরে থাকেন। কেউ কেউ বিদেশ থেকে আর ফেরেন না, কেউ ফিরলেও অল্প সময় পর আবার ছুটির আবেদন করেন। এই দীর্ঘ সময় তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের বেতন-ভাতা ও সুযোগ-সুবিধা নিয়মিত ভোগ করেন। ফলে প্রতিষ্ঠান যেমন শিক্ষক সংকটে ভোগে, তেমনি তৈরি হয় আর্থিক ক্ষতির বোঝা।

আরও পড়ুন: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে নিরাপত্তা জোরদারে নতুন সিদ্ধান্ত

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) ২০২১ সালের তথ্য বলছে, দেশে শিক্ষা কার্যক্রম চালু থাকা ৫০টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে মোট শিক্ষক ছিলেন ১৫ হাজার ২৪৫ জন। এর মধ্যে কর্তব্যরত ছিলেন ১১ হাজার ৬৯১ জন। বাকি ৩ হাজার ৫৫৪ জন ছিলেন বিভিন্ন ধরনের ছুটিতে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় অংশ, অর্থাৎ ২ হাজার ১০৬ জন শিক্ষক ছিলেন শিক্ষা-ছুটিতে, যারা মূলত বিদেশে উচ্চতর ডিগ্রির জন্য গিয়েছেন। ৮৫ জন প্রেষণে, ৯২ জন বিনা বেতনে, ৬৪ জন অনুমোদনহীন ছুটিতে এবং ১ হাজার ১৯৮ জন খণ্ডকালীন বা অন্যান্য ভিত্তিতে নিযুক্ত ছিলেন।

এই চিত্র আরও স্পষ্ট হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যানে। বিশ্ববিদ্যালয়টির ১ হাজার ৪৮৪ জন শিক্ষকের মধ্যে ২০২১ সালে ৩২৯ জনই ছিলেন শিক্ষা-ছুটিতে। তাদের মধ্যে অনেকে নির্ধারিত সময় পার হলেও কর্মস্থলে ফেরেননি। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগ ২০২২ সালে এমন ১৩ জন শিক্ষকের পদ শূন্য ঘোষণা করে। একই সঙ্গে তাদের কাছে বকেয়া পাওনার অর্থ পরিশোধের জন্য চিঠিও পাঠানো হয়। এমনকি বিভিন্ন সময় শিক্ষা-ছুটির শর্ত ভঙ্গের দায়ে বেশ কয়েকজন শিক্ষককে বরখাস্ত ও আর্থিক জরিমানাও করা হয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. কামরুল হাসান মামুন বলেন, অভ্যুত্থানের পরে আমরা একটা নতুন বাংলাদেশ পেয়েছিলাম। নতুন বাংলাদেশে নতুনত্ব শুরু হয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দিয়ে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নতুন নীতিমালা, প্রমোশন নীতিমালা, নতুন বেতন স্কেল হবে। অধ্যাপক ইউনুস পুরো বাংলাদেশে একটা আহ্বান জানাইতে পারতেন যে বাংলাদেশের যত স্কলার বিদেশে আছেন আপনারা সবাই ফিরে আসুন। ফিরে আসতে হলে এখানে পজিশন দিতে হবে না? উনি আহ্বান জানাইতে পারতেন। তাহলে আমরা পরিবর্তনের আশা করতাম। আমিতো কোনো পরিবর্তন দেখি না।

আরও পড়ুন: ঢাবিতে ইউনেস্কো চেয়ার: ১২৫টি দেশের সঙ্গে অ্যাকাডেমিক সংযোগ

তিনি বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ বা প্রমোশন নীতিমালার কোনো পর্যায়ে পোস্ট-ডক্টরাল অভিজ্ঞতা জানতে চায় না। কারো থাকলেও সেটার মূল্যায়ন করা হয় না। তাহলে কীভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে নিয়ে এই জাতি বিশ্বমানের ছাত্র শিক্ষক তৈরি করবে বলে আশা করব? এখনও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক পদে নিয়োগের ন্যূনতম যোগ্যতা পিএইচডি হলো না। আন্তর্জাতিক মানের হতে হলে, টিকে থাকতে হলে ক্রমাগত ভালো করতে হবে। ক্রমাগত ভালো করতে হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগ ও প্রমোশনের নীতিমালা প্রতিনিয়ত উন্নত করতে হবে। অর্থাৎ উন্নত হওয়ার জন্য বিবর্তনের বিকল্প নেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রেও পরিবর্তন কিছুটা হয়েছে তবে সেগুলো খারাপের দিকে।

তিনি আরো বলেন, এই বিশ্ববিদ্যালয় এক শ বছরের বেশি সময় পার করেছে। এখনও এসএইচসি ও এসএসসির জিপিএ দেখা হয়। আমেরিকার একটা বড় বিশ্ববিদ্যালয় যখন আমাকে পিএইচডি দেবে তখন আমার এসএইচসি, এসএসসি জিপিএ কী? কত ছিল? এগুলো কোনো ফেক্টর? আমরা যে একটা অসভ্য জাতি তার প্রমাণ হলো এগুলো। অথচ যা চাওয়ার কথা—যেমন সিভি, ৩ জন প্রতিথযশা শিক্ষক বা গবেষকের কাছ থেকে রেকমেন্ডেশন চাওয়া, টিচিং ও গবেষণা ফিলোসফির ওপর স্টেটমেন্ট ইত্যাদি চাওয়া হয় না।  

বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. সায়মা হক বিদিশা শিক্ষকদের পদায়ন, পদোন্নতি ও নিয়োগপত্র নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন দুটি কমিটি গঠনের কথা জানালেও তার সত্যতা পাওয়া যায়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিষ্ট্রার ভবন সূত্রে জানা যায়, শিক্ষকদের এসব নিয়ে শুধু একটি কমিটি করা হয়েছে। যেখানে শিক্ষকদের নিয়োগপত্রে বিধিমালায় পরিবর্তন, পরিমার্জনের বিষয়ে আলোচনা হয়। তবে সেখানেও কোনো নির্দিষ্ট সিদ্ধন্তে পৌছাতে পারেনি কমিটি।

আরও পড়ুন: জুলাইয়ে হামলাকারীদের ব্যাপারে তথ্য দেওয়ার সময় বাড়ালো ঢাবি

এ কমিটির অন্যতম সদস্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাসিউটিক্যাল কেমিস্ট্রি বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আব্দুর রশিদ বলেন, আমাদের মোট দুইটা মিটিং হয়েছে। আমরা মূলত এখনও কিছুই করতে পারিনি। শিক্ষকদের যে নিয়োগ দেয়া হয় সেখানে যে চিঠিটা দেওয়া হয় সেখানে কী কী মডিফিকেশন করা যায় সে নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। 

কমিটির মিটিংয়ে পিএইচডি নিয়ে কোনো আলোচনা হয়েছে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, প্রধানত নিয়োগের সময় যে চিঠিটা দেওয়া হয় সেটার পরিবর্তন হবে কি না? গবেষণা করতে  হবে, এত ঘণ্টা পাঠদান করতে হবে। এগুলো নিয়ে আমাদের কমিটি। পিএইচডি নিয়ে সম্ভাবত আরেকটা কমিটি হয়েছে। 

এক আলাপে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. সায়মা হক বিদিশা বলেন, আমার যতটুকু মনে পড়ে এ নিয়ে দুটি কমিটি হয়েছে। মিটিংও করেছি আমরা। প্রাথমিকভাবে আমরা ফাউন্ডেশন ট্রেইনিং এবং টিচিং আওয়ার, অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ বিষয় নিয়ে কথা বলছি। এসব বিষয়কে আরেকটু আধুনিক করা যায় কি না সেটা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। প্রমোশনের জায়গায় আমরা আরেকটু কঠোর হতে চাচ্ছি। ওখানে মেধাটাকে আরো বেশি গুরুত্ব দেওয়া উচিত।