অনিয়ম-অব্যবস্থাপনায় জর্জরিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সুইমিংপুল
- জুবায়ের হোসাইন, ঢাবি প্রতিনিধি
- প্রকাশ: ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ০৬:১৭ PM , আপডেট: ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ০৬:৩৩ PM
নানা অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা, সংকট-সমাধানসহ বিভিন্ন সমস্যায় জর্জরিত অবস্থায় রয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) সুইমিংপুল। প্রতিষ্ঠার পর প্রায় চার দশক পার করলেও এখনও একটি আদর্শ সাঁতার কাটার সব সুবিধা চালু করা যায়নি এ সুইমিংপুলে। পুলটির সার্বিক তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তাদের উদাসীনতা, ব্যবহারকারী শিক্ষার্থীদের নানা অনিয়ম আর খামখেয়ালিপনা এবং রাজনৈতিক প্রভাবের ফলে সব ধরনের অনিয়মই সম্ভব হয় এখানে। নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা প্রহরীদের হুমকি দিয়ে শিক্ষার্থী এবং ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা সুইমিংপুলে প্রবেশ করেন মাঝ রাতেও। আর সুইমিংপুলের আধুনিকায়নের পরিকল্পনাটি এখনও পুল অফিসের দেয়ালে ঝুলে থাকা ছবিতেই সীমাবদ্ধ রয়েছে।
আর এতো সব অনিয়ম আর অব্যবস্থাপনার কারণে সুইমিংপুলে ঘটছে শিক্ষার্থীদের মৃত্যুর মতো ঘটনাও। গত সোমবার ঢাবির দর্শন বিভাগের শিক্ষার্থী মো. সোহাদ হক ও তার বন্ধুরা পুলে সাঁতার কাটতে গেলে সাঁতারের এক পর্যায়ে মারা যান সোহাদ হক। এর আগে সুইমিংপুলের গভীর অংশে ঢাবির আরেক শিক্ষার্থীর মৃত্যু হলে সেখানে উপর থেকে লাফ দেওয়া নিষিদ্ধ করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
আরও পড়ুন: সাঁতার জানার পরও কেন সুইমিংপুলে ডুবে মারা গেলেন ঢাবি ছাত্র সোহাদ?
সোহাদের মৃত্যুর পর সুইমিংপুলের সার্বিক অবস্থা পর্যবেক্ষণে সামনে আসে নানা অব্যবস্থাপনা। ঢাবির সুইমিংপুলে রয়েছে দুইটি অংশ। একটি অংশের গভীরতা ২০ ফুট অপর অংশের গভীরতা ৪ ফুট থেকে ৭ ফুট। দুই অংশ মিলে মোট ধারণ ক্ষমতা সর্বোচ্চ ১২০ জনের। কিন্তু গরমের সময় সেখানে একই সাথে সাঁতার কাটতে যান ৩০০ থেকে ৪০০ জন শিক্ষার্থী। দুপুর ১২.০০টা থেকে বিকাল ৩.০০টা পর্যন্ত সময়সীমা থাকলেও তা মানেন না শিক্ষার্থীরা।
এছাড়াও শিক্ষার্থীদের সাঁতারসহ পুলের তাদের সার্বিক তদারকির জন্য রয়েছেন মাত্র মাত্র দুইজন লাইফ গার্ড। এর বাইরে শিক্ষার্থীদের সুরক্ষা নিশ্চিতে এখানে লাইফ গার্ড হিসেবে কাজ করেন বাগানের মালি, ম্যানেজিং কর্মকর্তাসহ অন্যান্য কর্মচারীরা। আর নিয়মিত কাজের পাশাপাশি তারা এ দায়িত্ব পালন করেন ঢাবির সুইমিংপুলে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সুইমিংপুল। ছবি: টিডিসি ফটো।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সুইমিংপুল অফিসের তথ্য বলছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের সুইমিংপুলের সার্বিক ব্যবস্থাপনায় রয়েছে পর্যাপ্ত লোকবলের ঘাটতি। ফলে পুলের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তাদের একই সাথে একাধিক দায়িত্ব পালন করতে হয়। এছাড়াও শিক্ষার্থীদের নিয়ন্ত্রণ করতে না পারাসহ পাশাপাশি রয়েছে দায়িত্বরত কর্মকর্তা কর্মচারীদের দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগও। এর বাইরে পুল ব্যবহারের নানা নিয়ম আর নির্দেশিকা থাকলেও তা মানানো যায় না শিক্ষার্থীদের। ফলে ছোট বড় নানা দুর্ঘটনার পাশাপাশি এখানে ঘটে মৃত্যুর মতো ঘটনাও।
সুইমিংপুল অফিসের তথ্যমতে, ঢাবির নিয়মিত শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরের শিক্ষার্থীদেরও এখানে সুযোগ রয়েছে সাঁতার শেখার। সে উদ্যোগের অংশ হিসেবে সুইমিংপুলে সাঁতার শেখার জন্য ভর্তি করা হয় ১৫০ থেকে ২০০ জন শিক্ষার্থীকে। তাদের সাঁতার শেখার জন্য সকাল ৯ টা থেকে দুপুর ১২ টা পর্যন্ত নির্ধারিত হলেও ভর্তিকৃত এসব শিক্ষার্থীকে প্রবেশের সুযোগ দেওয়া হয় নিয়মিত শিক্ষার্থীদের সাঁতারের সময়ও।
আরও পড়ুন: বন্ধুদের সঙ্গে সুইমিংপুলে গোসল করতে গিয়ে ঢাবি ছাত্রের মৃত্যু
এছাড়াও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সুইমিংপুল ব্যবহারের জন্য একটি ফরম পূরণপূর্বক একটি কার্ড বানানোর বিধান থাকলেও তা করা হয় না। কার্ড না বানানোর ফলে শিক্ষার্থীদের পূর্ব অবস্থা এবং সাঁতার পারা-না পারার দক্ষতা এবং শারীরিক নানা জটিলতার তথ্য থেকে যাচ্ছে অগোচরেই। এছাড়াও কার্ড দেখে শিক্ষার্থীদের প্রবেশের কোনো উদ্যোগও নেই পুল কর্তৃপক্ষের, ফলে ঘটছে শিক্ষার্থীদের মৃত্যুর মতো ঘটনাও।
বিপরীতে সুইমিংপুল কর্তৃপক্ষ ও নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা দারোয়ানদের অভিযোগ, শিক্ষার্থীরা এখানে কোনো নিয়ম মানে না। সবাই এসে গণহারে ঢুকে পড়ে। কোনো ধরনের নিয়ম তারা মানে না। সুইমিংপুলের প্রতিটি জায়গায় নির্দেশনা দেয়া আছে। এগুলা তারা মানে না। তাদের যা মন চায় তাই করে। বাধা দিলে তাঁদের রোষানলে পড়তে হয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সুইমিংপুলে নানা অব্যবস্থাপনা রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজে যাদেরকে দেওয়া হয় তাদের মধ্যে কাজ করার মানসিকতা থাকে না। যার ফলে এত সীমাবদ্ধতা এত অব্যবস্থাপনা—অধ্যাপক মুহাম্মদ সামাদ, উপ-উপাচার্য (প্রশাসন), ঢাবি।
নানা হুমকি-ধামকির পাশাপাশি ছাত্রলীগ পরিচয়ে পুল বন্ধের সময় রাত ২টার সময়ও শিক্ষার্থীরা এসে হুমকি-ধামকি দেয় বলেও অভিযোগ নিরাপত্তারক্ষীদের। তারা বলছেন, আমরা আতঙ্কে থাকি অনেক সময়। আমাদের তখন কিছু করার থাকে না। প্রশাসন যদি আমাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে আমরা তাহলে শিক্ষার্থীদেরকে নিয়মের মধ্যে আনতে পারবো।
ঢাবির সুইমিংপুলের ফিল্টারিং অফিসার মোস্তাফিজুর রহমান পালন করেন একাধিক দায়িত্ব। বর্তমানে তিনিই আবার সুইমিংপুলের সার্বিক ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে রয়েছেন। সামগ্রিক বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, আমাদের এখানে লোকবলের অভাব রয়েছে। বাগান মালিসহ অন্যান্যরা এখানে লাইফ গার্ডের দায়িত্ব পালন করেন। তারা সম্পূর্ণ দক্ষ দাবি করে তিনি বলেন, এর পাশাপাশি এখানে দুজন নিয়োগপ্রাপ্ত লাইফ গার্ড আছেন। যার মধ্যে একজন ছেলে একজন মেয়ে। আমরা নিয়মতান্ত্রিকভাবে ধারণ ক্ষমতা অনুযায়ী সংখ্যাভিত্তিক ভাবে শিক্ষার্থী দের প্রবেশ করাতে পারলে দুর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা কম থাকতো বলে মনে করেন তিনি।
সুইমিংপুলের সার্বিক তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে থাকা এই কর্মকর্তা বলেন, এখানে শিক্ষার্থীরা মাঝ রাতে এসে সাঁতার কাটতে চায়। তাদের থামানো যায় না। তারা নিরাপত্তারক্ষীদের মেরে ফেলার হুমকি দেয়। নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা প্রহরীরাও অনেক সময় অসহায় হয়ে পড়ে শিক্ষার্থীদের কাছে।
ঢাবির সুইমিংপুলের পানিসহ প্রযুক্তিগত অবস্থা মোটামুটি বাংলাদেশের মধ্যে অন্যতম সেরা জানিয়ে পুলের নির্বাহী প্রকৌশলী (বিদ্যুৎ) মিজানুর রহমান দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে জানান, সেখানে সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা থাকলেও নেই পানি উষ্ণ করার কোনো ব্যবস্থা। তিনি জানান, সেজন্য আবেদন করা হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে। তবে খরচ বেশি হওয়ায় সেটি হচ্ছে না। এছাড়াও নানা প্রযুক্তিগত উন্নয়ন দরকার বলেও জানান তিনি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সুইমিংপুল ব্যবহারে রয়েছে নানা নির্দেশনাও। যদির তা মানানো যায় না শিক্ষার্থীদের। ছবি: টিডিসি ফটো।
মিজানুর রহমান বলেন, এর বাইরে এখানে লোকবলা বাড়াতে হবে। পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের নিয়মশৃঙ্খলা মানতে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। এখানে পুলের প্রযুক্তিগত উন্নয়ন করার অনেক জায়গা রয়েছে। আমাদের এখানে শিক্ষার্থীদের তুলনায় প্রশিক্ষকের পরিমাণ অনেক কম। প্রশিক্ষক আরও বাড়ানো যেতে পারে।
অন্যদিকে শিক্ষার্থীদের নিয়ম না মানার কারণে সুইমিংপুল ম্যানেজিং কমিটিতে সম্প্রতি যুক্ত করা হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক মাকসুদুর রহমানকে। তিনিও অব্যবস্থাপনার বিষয়টি স্বীকার করেছেন।
প্রক্টর বলছেন, আমি সম্প্রতি যুক্ত হয়েছি। মিটিংয়ে আমি বার বার বলেছি একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ শিক্ষার্থীকে একটি সময় বেঁধে দেওয়া উচিত। এতে দুর্ঘটনার আশঙ্কা কমবে। আর কেউ জোর করে প্রবেশ করতে চাইলে আমাদের জানানোর নির্দেশনা রয়েছে। কিন্তু এত বড় ঘটনা ঘটে গেলেও এর আগে কোনো ধরনের অভিযোগ আমাদের কাছে করা হয়নি।
তিনি জানান, পুলে ধারণ ক্ষমতার বাইরে শিক্ষার্থী ঢুকছে তাদেরকে বাধা দেওয়া হচ্ছে না বা আমাদেরকেও জানানো হয় না। না জানলে আমরা ব্যবস্থাও নিতে পারি না। তাই আমাদেরকে আগে জানাতে হবে। দায়িত্বে কঠোর না হলে সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। একই সাথে শিক্ষার্থীদেরকেও নিয়মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। শিক্ষার্থীদের নিয়ম না মানার যে স্বভাব বা নিয়ম ভঙ্গ করার যে স্বভাব সেটিও দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ বলেও মনে করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক মাকসুদুর রহমান।
আরও পড়ুন: ঢাবির সুইমিংপুলে শিক্ষার্থীর মৃত্যুর ঘটনায় তদন্ত কমিটি
জানতে চাইলে ঢাবির শারিরীক শিক্ষা কেন্দ্রের পরিচালক মো. শাহজাহান আলী দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, আমাদের কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। আমরা সেগুলো কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছি। এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা যাতে আর না ঘটে সেজন্য যথাযথ ব্যবস্থা নিবে প্রশাসন।
অব্যবস্থাপনা ও দায়িত্বে অবহেলা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, দায়িত্বে আমরা আমাদের সর্বোচ্চটা দেওয়ার চেষ্টা করি। সোমবারের ঘটনায়ও আমরা সারাদিন মেডিকেলে দৌড়াদৌড়ি করেছি। কিছু কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা অনেক সময় ঘটে যায়। শিক্ষার্থীরা দলে দলে আসে আমরা চাইলেও নিয়ম শৃঙ্খলা রক্ষা করতে পারি না।
তবে প্রক্টর অফিসে না জানিয়ে কেন ছাত্রলীগ নেতাদের জানানো হয়—এমন বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি কোনো জবাব দিতে পারেননি।
পুর্বে সুইমিংপুল ও শারীরিক শিক্ষা কেন্দ্রটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক মুহাম্মদ সামাদের অধীনে থাকলেও পরবর্তীতে সেটির দায়িত্ব গ্রহণ করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক মমতাজ উদ্দিন আহমেদ। তিনি সুইমিংপুল ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি। জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা খুবই মর্মান্তিক ঘটনা। আমি দেশের বাইরে থাকায় ভালো মত খোঁজ খবর নিতে পারিনি।
তবে সীমাবদ্ধতা ও অব্যবস্থাপনার কথা স্বীকার করে তিনি দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে জানান, দেশে এসে এ বিষয়ে কী ব্যবস্থা গ্রহণ করা—তা নিয়ে মিটিং করবো এবং যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার চেষ্টা করবো যাতে করে ধরনের মর্মান্তিক ঘটনা আর না ঘটে।
সার্বিক বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) বর্তমান রুটিন দায়িত্বে থাকা উপাচার্য অধ্যাপক মুহাম্মদ সামাদ দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, এই শিক্ষার্থীর মৃত্যুতে আমি অত্যন্ত মর্মাহত। তিনিও অব্যবস্থাপনার বিষয়টি স্বীকার করেন এবং বলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো কাজে যাদেরকে দায়িত্ব দেওয়া হয় তাদের মধ্যে কাজ করার মানসিকতা থাকে না। শাস্তি নিশ্চিত না করায় কেউই ঠিক মতো কাজ করে না। যার ফলে এত সীমাবদ্ধতা এত অব্যবস্থাপনা। তবে উপাচার্য দেশে আসলে তার সাথে আলোচনায় বসব এবং যতদূর সম্ভব সমস্যার সমাধান করার চেষ্টা করব বলেও জানান তিনি।