সহপাঠীকে হারিয়ে শোকে বাকরুদ্ধ রুমমেটরা
গণরুমে আর কখনো লাগেজ ব্যাগ খুলবেন না ঢাবি ছাত্র সোহাদ
- জুবায়ের হোসাইন ও মুহাইমিনুল ইসলাম
- প্রকাশ: ২২ এপ্রিল ২০২৪, ১০:২৯ PM , আপডেট: ২২ এপ্রিল ২০২৪, ১১:২৮ PM
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলের ১০২০ নম্বর রুমে থাকেন প্রথম বর্ষের ১৩ জন শিক্ষার্থী। এখন থেকে এই গণরুমটির বাসিন্দা ১২ জন। রুমটির সবচেয়ে হাস্যোজ্জ্বল ও প্রাণবন্ত ছেলেটি চলে গেলেন অকালে। বলেছিলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী মো. সোহাদ হকের (১৯) কথা। আজ রবিবার দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের সুইমিংপুলে সাঁতার কাটতে গিয়ে পানিতে ডুবে মারা যান এই শিক্ষার্থী।
পরে বিকেলের দিকে হলের ওই রুমে গিয়ে দেখা যায়, প্রিয় বন্ধুকে হারানোর শোকে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছেন তার রুমমেটরা। শুধু ওই রুম নয়, এ ঘটনায় হলজুড়ে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। কেউই সোহাদের এই আকস্মিক মৃত্যু মেনে নিতে পারছেন না।
ওই রুমে মোট ৬টি চৌকি রয়েছে। সোহাদের শোয়ার চৌকিতে দেখা যায়, তার বই, খাতা, কলম— সব এলোমেলো হয়ে পড়ে আছে চৌকিতে। পাশে তার লাগেজ ব্যাগ এবং বস্তা রয়েছে। ঈদের ছুটি শেষে গ্রামের বাড়ি থেকে এসে তিনি এসব খুলেননি। সোহাদ গণরুমে কিংবা বাড়িতে গিয়ে আর কখনো এই লাগেজ ব্যাগ খুলবেন না।
হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলের ১০২০ নম্বর রুমে থাকতেন সোহাদ
হলের তার সহপাঠীরা জানায়, ঈদের ছুটি শেষে গতকাল রবিবার বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস শুরু হয়েছে। এর আগে বৃহস্পতিবার ভোরে তিনি গ্রামের বাড়ি বগুড়া জেলা থেকে ক্যাম্পাসে এসেছিলেন। তীব্র তাপদাগের কারণে আজ দুপুরে হল থেকে বন্ধুরা মিলে গোসলে গিয়েছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সুইমিংপুলে। সোহাদ সাঁতার জানতেন। তবে তাঁর শ্বাসকষ্ট ছিল, ইনহেলারও ব্যবহার করতেন। সুইমিংপুলে বন্ধুরা মিলেমিশে অনেকক্ষণ সাঁতার কাটেন। পরে আরেকবার লাফ দেওয়ার পর সাঁতার কাটার চেষ্টা করলে দেখা যায়, তিনি ডুবে যাচ্ছেন। তাঁকে ওপরে উঠিয়ে আনা হয় এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। পরে সেখানকার কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
সোহাদের ওই রুমটি গণরুম হওয়ায় সেখানে তার একাধিক বন্ধুও ছিল। তাদের সাথে কথা বলে জানা যায়, সোহাদ খুব হাস্যোজ্জ্বল ও প্রাণবন্ত একজন ছেলে ছিলেন। তিনি কারও সাথে কোনদিন ঝগড়া বিবাদে জড়াননি। তিনি ব্যক্তিগতভাবে ছিলো সাংগঠনিক। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনে সক্রিয়ভাবে কাজ করতে৷ পড়াশোনায়ও বেশ মনোযোগী ছিলেন, তাই ডিপার্টমেন্টে শ্রেণি প্রতিনিধিত্ব করতেন সোহাদ।
সোহাদের রুমমেট বেলাল হোসেন বলেন, সোহাদ খুব মিশুক একজন মানুষ ছিল সবার সাথেই চলাফেরা করতো। ছোট বড় সবার সাথেই ভালো সম্পর্ক ছিল। সবার বিপদে আপদে সব সময় ওকে পাওয়া যেত। বন্ধুদের সমস্যায়ও সোহাদ সাহায্য করার চেষ্টা করতো। সে হল ডিবেটিং ক্লাব, বিশ্ববিদ্যালয় ডিবেটিং ক্লাবসহ নানা কারিকুলামের সাথে সে যুক্ত ছিল। পাশাপাশি বিভাগের ক্লাস রিপ্রেজেনটেটিভ (সিআর) হওয়াতে বিভাগেও সবার সাথে তার ভালো সম্পর্ক ছিল।
আরেক রুমমেট বলেন, সোহাদের জামা কাপড়, বই-খাতা সব এখানে কিন্তু ও কোনো দিন আর আসবে না এটা আমাদের জন্য চরম বেদনাদায়ক। আমরা এটা কোনো ভাবেই মেনে নিতে পারছি না। আমরা ভাবতেও পারিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার এক বছর যেতে না যেতেই আমরা এমন ঘটনার সম্মুখীন হবো।
ঘটনার সময় সোয়াদের পাশে উপস্থিত থাকা তার এক সহপাঠী দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, সোয়াদ সাঁতার জানতো। সে সুইমিংপুলের একপাশ থেকে সাঁতার কেটে অন্যপাশে যাওয়ার সময় পানিতে হাবুডুবু খেতে থাকে। তার অ্যাজমার সমস্যা ছিল। আমি দ্রুত ওর কাছে গিয়ে ওকে তোলার চেষ্টা করলে ও আমাকে ধরেই নিচে চলে যাচ্ছিলো আমি অনেক চেষ্টা করেও ওকে তুলতে পারিনি। পরে সবাইকে ডেকে ওকে তুলে হাসপাতালে নিয়ে আসি কিন্তু বাঁচাতে পারলাম না।
বর্তমানে নিহত সোহাদের লাশ রাখা হয়েছে ঢাকা মেডিকেলের মর্গে। সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, সোয়াদের বন্ধু ও স্বজনদের আহাজারিতে ভারি ঢামেক চত্বর। ঘটনার পর তার বাবাকে জানানো হলে তিনি সাথে সাথে বাসে করে রওয়ানা দেন ঢাকার উদ্দেশে। কিন্তু ঢাকা থেকে বাড়ি অনেক দূরে হওয়ায় সোহাদের বাবা এখনও মেডিকেলে আসতে পারেননি। যার ফলে তার লাশ এখন পর্যন্ত মর্গেই রাখা হয়েছে।
মুহসিন হলের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী রায়হান বলেন, ব্যক্তিগতভাবে সে অনেক ভালো ও সাংগঠনিক। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন আত্ম উন্নয়ন ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনে সক্রিয়ভাবে কাজ করে৷ পড়াশোনায় ও বেশ মনোযোগী এবং ডিপার্টমেন্টে শ্রেণি প্রতিনিধিত্ব।
ঢাবির শারীরিক শিক্ষা কেন্দ্রের পরিচালক শাহজাহান আলী নিহত শিক্ষার্থীর সহপাঠীদের বরাত দিয়ে বলছেন, নিহত শিক্ষার্থী পুলে সাঁতার কাটার সময় ডুবে যেতে থাকলে তার সাথে থাকা সহপাঠীরা টেনে তোলে তাঁকে। এরপর তিনি এবং উপস্থিত কর্মকর্তারা মিলে নিহত শিক্ষার্থীর পেটে চাপ দিয়ে পানি বের করার চেষ্টা করে এবং প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।
শাহজাহান আলী বলেন, নিহতের সহপাঠীদের সাথে কথা বলে ওই শিক্ষার্থীর অ্যাজমা আক্রান্ত থাকার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে।
বিকেলের দিকে হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক ড. মাসুদুর রহমান দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, আমি মৃত্যুর সংবাদ শোনার সাথে সাথেই ঢাকা মেডিকেলে সোহাদকে দেখতে যাই। তদন্তের সময় থেকে এখন অবধি আমি তার পাশে আছি। বগুড়া থেকে তার বাবা-মা এসেছে তাদেরকে নিয়ে আমি শাহবাগ থানায় এসেছি। আমরা এবং তারা বাবা মা চাচ্ছে যাতে পোস্ট মর্টেম না করা হয়। তাই আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। তিনি বলেন, আমি যতটুকু শুনেছি, ছেলে হিসেবে সে অনেক ভালো ছিল।