ঢাবির শতবর্ষী মনুমেন্ট

প্রকল্পের মেয়াদ ৮ মাস বৃদ্ধি, ৫টি স্থাপনা ভাঙলেও কোনো আর্থিক ক্ষতি হয়নি!

দাবি কর্তৃপক্ষের

মল চত্বরে চলছে ঢাবির শতবর্ষী মনুমেন্টের কাজ
মল চত্বরে চলছে ঢাবির শতবর্ষী মনুমেন্টের কাজ  © ফাইল ছবি

শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও পরিবেশবাদীদের আপত্তি সত্ত্বেও নান্দনিকতা আর সৌন্দর্যবর্ধনের নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) মল চত্বর এলাকায় গড়ে উঠছে শতবর্ষী মনুমেন্ট। ২০২২ সালের ডিসেম্বর মাসে কাজটির উদ্বোধন হয়। পরের বছর ২০২৩ সালের জুনের মধ্যে শেষ করার পরিকল্পনা থাকলেও বারবার নতুন করে ডিজাইন পরিবর্তন করায় নির্ধারিত সময়ের ৮ মাস পার হলেও এখন পর্যন্ত পূর্ণ কাজ শেষ করতে পারেনি কর্তৃপক্ষ। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থ এবং সময় দুটোই ক্ষতি হয়েছে বলছেন সংশ্লিষ্টরা। যদিও কর্তৃপক্ষের দাবি এতে আর্থিক কোনো ক্ষতি হয়নি।

বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, ৭০ ফুট দৈর্ঘ্য, ৩০ ফুট প্রস্থ এবং ২৫ ফুট উচ্চতার ঢাবির শতবার্ষিক মনুমেন্টের নির্মাণ ব্যয় প্রায় ২১ কোটি টাকা। এই প্রকল্পকে কেন্দ্র করে বিশাল এলাকা নিয়ে এক কর্মযজ্ঞ চলছে বিশ্ববিদ্যালয়ের মল চত্বরে।

সরেজমিনে মল চত্বর ঘুরে দেখা যায়, শুরুরদিকে মোট ৩৬টি স্থাপনা থাকলেও বর্তমানে আছে ১টি প্রধান স্মৃতিস্তম্ভ, ২০টি বসার আসন, ১টি ঝর্ণা ও ৮টি খাড়া স্তম্ভ।   

নতুন করে প্রকল্পের নকশা পরিবর্তনের ফলে মল চত্বরের সামনের গোলাকার স্তম্ভ ভাঙা, সবুজায়নের জন্য ঢালাইকৃত কনক্রিটের স্থাপনা ভাঙা, মল চত্বরের প্রধান রাস্তা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় প্রধান ফটকের স্থাপনা ভাঙা, নতুন করে গাছ লাগানোর জন্য রডের ঢালাইকৃত স্থাপনা ভাঙা, ইন্টারন্যাশনাল হলের সামনের স্থাপনা ভাঙাসহ ৫টি স্থাপনা ভাঙা হয়েছে। এছাড়া ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অনেক জায়গায় ঢালাইকৃত কনক্রিট ভাঙা হয়েছে।

সর্বশেষ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ এস এম মাকসুদ কামাল (১৮ জানুয়ারি) ওমরাহ পালন করতে সৌদি আরব যাওয়ার আগের দিন সন্ধ্যায় মল চত্বরে পরিদর্শন করেন। সেসময় তিনি মলচত্বরে প্রবেশ পথে লোহার ফলকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় লেখা স্থাপনা সরিয়ে ফেলার নির্দেশ দেন। পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় লেখা লোহার ফলক সরিয়ে মল চত্বরের প্রধান ফটকের কনক্রিট স্থাপনা ভেঙে ফেলা হয়। 

মল চত্বর এলাকায় মনুমেন্টের কাজ পরিদর্শনে ঢাবি উপাচার্য (ফাইল ফটো)

এর আগে অধ্যাপক ড. মো. আক্তারুজ্জামান উপাচার্য থাকাকালীন শতবর্ষী মনুমেন্টের ডিজাইন করা হয় এবং সেই ডিজাইন অনুযায়ী প্রায় ১০ মাস এই ডিজাইন অনুযায়ী কাজ চলমান থাকে। পরবর্তীতে অধ্যাপক ড. এ এস এম মাকসুদ কামাল উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করার পর নতুন করে শতবর্ষী মনুমেন্টের ডিজাইনে পরিবর্তন করেন। এর ফলে পূর্বের ডিজাইনকৃত স্তম্ভ ভেঙে ফেলতে হয়। এই ধ্বংসযজ্ঞ চলে প্রায় ১৫ দিনব্যাপী। কনক্রিটের স্থাপনা তৈরিতে বিভিন্ন সময়ে গাছ কাটা, এমনকি গাছের শিকড় কেটে ফেলা হয়েছে, যারা ফলে অনেক স্থানে গাছ  উপড়ে পড়ে থাকতে দেখা যায়। 

বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বলছে, সবুজ এরিয়া বাদে বাকি কাজগুলো আগামী ফেব্রুয়ারি মাসে শেষ হবে।  সঠিক পরিকল্পনা প্রণয়নের অভাবে বারবার ডিজাইন পরিবর্তন করছে প্রশাসন। কোনো কাজ করার আগে পূর্ব পরিকল্পনা থাকা দরকার, যেটা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নেই বলে মনে করে শিক্ষার্থীরা।

শতবর্ষী মনুমেন্টের দায়িত্বরত ইঞ্জিনিয়ার কামরুল ইসলাম বলেন, এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া। ডিজাইন পরিবর্তনের কারণে ভিসি স্যার যদি মনে করেন স্থাপনা আরো ভাঙা লাগবে, তাহলে আরো ভাঙবেন। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমার কাছে নকশা আসে, সে অনুযায়ী আমি কাজ করি। এছাড়া আমি আপনাকে কোনো তথ্য দিতে পারবো না। আমরা কোনো তথ্য সাংবাদিকদের সাথে শেয়ার করতে পারবো না, এটা ভিসি স্যারের নির্দেশ।

লোহার ফলকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় লেখা এই স্থাপনাটি ভেঙে ফেলা হয় (ফাইল ফটো)

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী মো: ইব্রাহিম বলেন, শতবর্ষী মনুমেন্টের ডিজাইন পরিবর্তন করা হয়েছে, কিছু স্থাপনা ভাঙা হয়েছে গাছ লাগানোর জন্য। বিভিন্ন জায়গায় স্থাপনা ভাঙার ফলে ক্ষতির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের আর্থিক কোনো ক্ষতি হয়নি, মোট বাজেট ঠিক রেখেই ডিজাইন পরিবর্তন করা হয়েছে। 

সূর্যসেন হলের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী শারজিল সাজিদ বলেন, মল চত্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অনেক আবেগের জায়গা। সেটি নিয়ে রীতিমতো লীলাখেলা চলছে। একদিন দেখি একজায়গায় কংক্রিটের স্থাপনা তৈরি হচ্ছে তো আবার সেটা দু-দিন পর ভাঙা হচ্ছে। এখানে সুষ্ঠু পরিকল্পনার অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। বারবার ভাঙা গড়ার এই খেলায় লক্ষ লক্ষ টাকার অপচয়ের কফুলগুলো দিনশেষে শিক্ষার্থীদের উপরই বর্তাবে!

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় লেখা স্থাপনাটি ভাঙার পর (ফাইল ফটো)

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান বলেন, শতবর্ষী মনুমেন্টের ডিজাইনে অসংগতি থাকায় কিছু জায়গায় পরিবর্তন করা হয়েছে কিন্তু কোথাও ভাঙাগড়া করা হয়নি। মল চত্বরের মাঠে ঢালাইকৃত কনক্রিট উঠিয়ে ফেলা হয়ে সেখানে ঘাস লাগিয়ে সবুজায়ন করার কাজ চলছে। কাজ করার ক্ষেত্রে সংযোজন বিয়োজন যতটুকু করা দরকার সেটা অবশ্যই করতে হবে।

স্থাপনা গড়ে আবার ভাঙা হচ্ছে (ফাইল ফটো)

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসের এক সাক্ষাৎকারে ঢাবির বর্তমান উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ এস এম মাকসুদ কামালবলেছেন, ঢাবির মলচত্বর কনক্রিট দিয়ে মোড়ানো এরকম যেন মনে না হয় এবং নির্মিত শতবর্ষী  মনুমেন্ট যেন দৃষ্টিনন্দন হয় এ দুইটির সমন্বয়ে কাজ চলমান আছে। মলচত্বর সবুজায়ন রাখতে কনক্রিটের স্থাপনা সরিয়ে সেখানে ঘাস লাগিয়ে পূর্বের ডিজাইনে পরিবর্তন আনা হয়েছে।

কেন এই শতবার্ষিক স্মৃতিস্তম্ভ?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষ পূর্তিকে স্মরণীয় করে রাখতে বিশ্ববিদ্যালয়ের মলচত্বরে ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শতবার্ষিক স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হচ্ছে। এ স্থাপনাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের গৌরবান্বিত শতবর্ষের প্রকাশ হিসেবে ১০০টি বাতি থাকবে এবং ২০টি হিস্ট্রি প্যানেল নির্মাণ করা হবে। এখানে শিক্ষার্থীদের বসার ব্যবস্থা, সাইকেল স্ট্যান্ড, রিসাইকেল বিন, চার্জিং পয়েন্টসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা থাকবে। 


সর্বশেষ সংবাদ