নিয়ম ভেঙে চবির ‘নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি’ অনিবন্ধিত অনলাইন পত্রিকায়
- খাঁন মুহাম্মদ মামুন
- প্রকাশ: ২৫ জানুয়ারি ২০২৪, ০৪:০৭ PM , আপডেট: ২৫ জানুয়ারি ২০২৪, ০৪:৪৬ PM
সরকারি বিজ্ঞাপন প্রচার-সংক্রান্ত নীতিমালা লঙ্ঘন করে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রচার করার অভিযোগ উঠেছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চবি) কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে। গত বছরের অক্টোবরের শুরুতে এ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। চট্টগ্রামভিত্তিক দুটি অনলাইন পত্রিকায় প্রকাশিত নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি বাবদ মোট ২ লাখ ১৭ হাজার ৮০০ টাকা বিল (ভাউচার) করা হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. শিরীণ আখতারের নামে। যদিও সরকারি চাকরির নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি জাতীয় দৈনিক পত্রিকা (ছাপা) ছাড়া অন্য কোথাও প্রকাশের সুযোগ নেই সরকারের বিজ্ঞাপন ও ক্রোড়পত্র নীতিমালা-২০০৮ অনুযায়ী।
এর আগে বিজ্ঞাপন পাওয়া এসব পত্রিকা বিশ্ববিদ্যালয়টিতে চলমান উপাচার্যবিরোধী আন্দোলন এবং সংশ্লিষ্টদের জড়িয়ে অসত্য এবং উদ্দেশ্য প্রণোদিত সংবাদ প্রচার করেছে বলে দাবি করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষক সমিতির নেতারা। তারা দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে জানিয়েছেন, এসব পত্রিকায় শিক্ষকদের নিয়ে উদ্দেশ্যমূলক বিভিন্ন অসত্য সংবাদ প্রচার করা হয়েছে। ফলে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ পুরস্কারস্বরূপ বিজ্ঞাপনের নামে তাদের অর্থ প্রদান করছে।
আরও পড়ুন: চাপে পড়ে চবির বিজ্ঞাপনের খরচ কি উপাচার্যই দিচ্ছেন?
বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ সংক্রান্ত নথিগুলো বিশ্লেষণে দেখা গেছে, গত বছরের ১ অক্টোবর দু’টি অনলাইন পত্রিকায় ‘চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণি পদে চাকরির বিজ্ঞপ্তি’—শিরোনামে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিগুলো প্রচার করা হয়েছে। চট্টগ্রামভিত্তিক বেসরকারি ‘অ্যাড মিডিয়া অ্যান্ড প্রিন্টার্স’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান এ কাজের দায়িত্ব পায় এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. শিরীণ আখতারের নামে বিল করে প্রতিষ্ঠানটি। প্রতিটি বিজ্ঞাপনের জন্য বিল করা হয়েছে ১ লাখ ৮ হাজার ৯০০ টাকা করে এবং দু’টি প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপনের বিল হিসেবে মোট ২ লাখ ১৭ হাজার ৮০০ টাকা হিসেব করে চাহিদাপত্র প্রদান করা হয়েছে।
চট্টগ্রামভিত্তিক সংবাদ মাধ্যম দুটির মধ্যে একটি অনলাইন তাদের ওয়েবসাইটে তথ্য অধিদফতরের নিবন্ধন রয়েছে বলে দাবি করছে। বাকী অনলাইনটির নিবন্ধন সংক্রান্ত কোনো তথ্য তাদের ওয়েবসাইটসহ সংশ্লিষ্ট কোনো মাধ্যমেই পাওয়া যায়নি।
সরকারের ‘বিজ্ঞাপন ও ক্রোড়পত্র নীতিমালা-২০০৮ এর ২০১০ সংশোধিত নীতিমালা অনুযায়ী, বিজ্ঞাপনদাতা সকল বিজ্ঞাপন সরাসরি সংবাদপত্রে প্রকাশের জন্য জারি করবে। বিজ্ঞাপন যাদের উদ্দেশ্যে প্রকাশ বা প্রচার করা হচ্ছে তাদের কাছে পৌঁছানোর জন্য সংবাদপত্র বাছাইয়ের ক্ষেত্রে বাস্তবায়নকারী দপ্তর বা সংস্থা বা প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের সজাগ ও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে।
এছাড়াও ক্রয় বিজ্ঞপ্তি বা টেন্ডার অথবা দরপত্র ইত্যাদির জন্য বিজ্ঞাপন কমপক্ষে দুটি বহুল প্রচারিত জাতীয় দৈনিক সংবাদপত্রে (একটি বাংলা এবং একটি ইংরেজি) প্রকাশ করতে হবে (কার্যদিবস হলে ভাল)। বিজ্ঞাপন প্রকাশের তারিখে সংশ্লিষ্ট সংবাদপত্রের একাধিক সংস্করণ প্রকাশিত হলে বিজ্ঞপ্তিটি সকল (যেমন-নগর বা মূল বা প্রথম বা দ্বিতীয় ইত্যাদি) সংস্করণেই প্রকাশ করতে হবে। এক কোটি টাকা বা তদূর্ধ্ব মূল্যমানের টেন্ডার বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের জন্য বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের সেন্ট্রাল প্রোকিউরমেন্ট টেকনিক্যাল ইউনিটে পাঠাতে হবে বলেও জানানো হয়েছে সরকারের ওই নির্দেশনায়।
আরও পড়ুন: দুই মন্ত্রীকে শুভেচ্ছা জানিয়ে বিজ্ঞাপন, খরচ দেবেন চবি উপাচার্য
নিময় অনুযায়ী, জাতীয় এবং স্থানীয় পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করতে পারে প্রতিষ্ঠানগুলো। এর মধ্যে বাংলা ও ইংরেজি পত্রিকা অন্যতম। আর অনলাইনে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করতে চাইলে তা আগে অনুমোদন করতে হবে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেটে। তবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেটে এখন পর্যন্ত কোনো অনলাইন পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের কোনো সিদ্ধান্ত অনুমোদন করা হয়নি বলে দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে নিশ্চিত করেছেন উচ্চশিক্ষালয়টির সিন্ডিকেট সদস্য অধ্যাপক মোহাম্মদ শামীম উদ্দিন খান।
অনলাইনে প্রকাশিত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি
তিনি জানিয়েছেন, আগে কখনও বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি বা এ সংক্রান্ত কোনো বিজ্ঞপ্তি অনলাইন সংবাদ মাধ্যমে প্রচারের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে কিনা—তা আমি জানি না। আর আমাদের সময় সিন্ডিকেটে এরকম কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। কীভাবে অনলাইনে বিজ্ঞাপন প্রচার করা হয়েছে, তা আমি বলতে পারব না—জানান অধ্যাপক মোহাম্মদ শামীম উদ্দিন খান।
আরও পড়ুন: পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে দুই মন্ত্রীকে অভিনন্দন চবি ভিসির, ব্যয় জানতে চেয়েছে ইউজিসি
বিজ্ঞাপন পাওয়া চট্টগ্রামভিত্তিক সংবাদ মাধ্যম দুটির ওয়েবসাইট ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্ন মাধ্যমে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, একটি অনলাইন তাদের ওয়েবসাইটে তথ্য অধিদফতরের নিবন্ধন রয়েছে বলে দাবি করছে। বাকী অনলাইনটির নিবন্ধন সংক্রান্ত কোনো তথ্য তাদের ওয়েবসাইটসহ সংশ্লিষ্ট কোনো মাধ্যমেই পাওয়া যায়নি। এছাড়াও বিভিন্ন মাধ্যমে চেষ্টা করেও তাদের সাথে কোনো যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। তাদের নিবন্ধন সংক্রান্ত কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি দেশীয় গণমাধ্যমের নিবন্ধন তদারক ও হালনাগাদকারী প্রতিষ্ঠান চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তরেও।
সরকারি নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে ‘নিবন্ধনহীন’ পত্রিকায় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রচার অনৈতিক এবং অপরাধ বলে মনে করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চবি) শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক আব্দুল হক। তিনি দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে জানিয়েছেন, এ পত্রিকাগুলোর নিবন্ধন রয়েছে কিনা—তা নিয়ে আমাদের শুরু থেকেই সন্দেহ ছিল। এসব পত্রিকা বিভিন্ন সময়ে আমাদের শিক্ষকদের নিয়ে মিথ্যা ও বানোয়াট সংবাদ প্রচার করেছিল। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তারা তাদের এ বিজ্ঞাপন প্রদানের মাধ্যমে বড় অঙ্কের অর্থ দিয়ে তাদের উৎসাহ দিয়েছে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেটে এখন পর্যন্ত কোনো অনলাইন পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের কোনো সিদ্ধান্ত অনুমোদন করা হয়নি—অধ্যাপক মোহাম্মদ শামীম উদ্দিন খান, সিন্ডিকেট সদস্য, চবি।
অধ্যাপক আব্দুল হক বলেন, এতে অর্থের অপচয়ের পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়েরই টাকা ব্যবহার করা হয়েছে শিক্ষকদের বিরুদ্ধে। আমরা এতোদিন বিষয়টি নিশ্চিত ছিলাম না। এখন বুঝতে পারছি—এসব সংবাদ মাধ্যম কোন উদ্দেশ্যপূর্বক সংবাদ প্রচার করতো। এর সাথে সংশ্লিষ্টরাই তাদের দিয়ে এসব কাজ করিয়েছে এবং কাজের বিনিময় হিসেবে পত্রিকাগুলো বিজ্ঞাপনের নামে বিপুল পরিমাণ অর্থ পেয়েছে।
বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার (ভারপ্রাপ্ত) কে এম নূর আহমদ দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে জানান, বিষয়টি সম্পর্কে তিনি খোঁজ নিয়ে পরবর্তীতে জানাতে পারবেন। এটি কীভাবে করা হয়েছে—তা জানেন না বলেও জানিয়েছেন তিনি।
এছাড়াও বিষয়টি দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসের পক্ষ থেকে জানতে চাওয়া হয়েছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) সিন্ডিকেট সদস্য অধ্যাপক ড. খাইরুল ইসলামের কাছে। চবির সিন্ডিকেটে অনলাইন পত্রিকায় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রচার করা হবে কিনা—এ নিয়ে কোনো সিদ্ধান্তের বিষয়ে তিনি জানেন না বলে জানিয়েছেন।
এভাবে বিজ্ঞাপন প্রচারের নামে অর্থের অপচয়ের পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়েরই টাকা ব্যবহার করা হয়েছে শিক্ষকদের বিরুদ্ধে। এর সাথে সংশ্লিষ্টরাই তাদের দিয়ে এসব কাজ করিয়েছে এবং কাজের বিনিময় হিসেবে পত্রিকাগুলো বিজ্ঞাপনের নামে বিপুল পরিমাণ অর্থ পেয়েছে—অধ্যাপক আব্দুল হক, সাধারণ সম্পাদক, চবি শিক্ষক সমিতি।
বিষয়টি নিয়ে নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে দেশের উচ্চশিক্ষার তদারক সংস্থা বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) এক কর্মকর্তা দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে জানিয়েছেন, এ বিষয়ে এখনও কমিশন কোনো কিছু জানে না। কেউ যদি এ বিষয়ে কমিশনে অভিযোগ জানায় তাহলে আমরা বিষয়টি খতিয়ে দেখবো।
একই বিষয়ে জানতে যোগাযোগ করা হয় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) উপাচার্য অধ্যাপক ড. শিরীণ আখতারের সঙ্গে। বুধবার (২৪ জানুয়ারি) সন্ধ্যায় উপাচার্য দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে জানিয়েছেন, বৃহস্পতিবার সকালে তার মুখপাত্রের মাধ্যমে এ বিষয়ে বক্তব্য প্রদান করবেন। তবে বৃহস্পতিবার এ বিষয়ে একাধিকবার চেষ্টা করেও উপাচার্য অধ্যাপক ড. শিরীণ আখতারের কোনো বক্তব্য পাওনা যায়নি।