বিতর্কিতদের হাতেই নেতৃত্ব
ছাত্রত্ব হারানো গালিব হলেন রাবি ছাত্রলীগের সেক্রেটারি
- টিডিসি রিপোর্ট
- প্রকাশ: ২২ অক্টোবর ২০২৩, ০৫:৫২ PM , আপডেট: ২৩ অক্টোবর ২০২৩, ০৭:৫৯ AM
দীর্ঘ সাত বছর পর ৩৯ সদস্যবিশিষ্ট রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের আংশিক কমিটি ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। অভিযোগ উঠেছে, নানাভাবে বিতর্কিতদেরও কমিটিতে পদ দেওয়া হয়েছে। বারবার ড্রপআউট হয়ে ছাত্রত্ব হারানো শিক্ষার্থী হয়েছেন রাবি ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক। এছাড়াও গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে স্থান পেয়েছে অছাত্র, বিবাহিত, ড্রপআউট, বিভিন্ন অপকর্মে ‘বিতর্কিত’ ও হঠাৎ সক্রিয় নেতারা।
এদিকে বিতর্কিতদের রাবি কমিটিতে পদায়ন না করার ঘোষণা দিয়েছিলো বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। কিন্তু সে কথা রাখেনি তারা। বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পদে বিতর্কিতরা পদ পেয়েছে। বিভিন্ন অপকর্মে জড়িতদের পদায়ন নিয়ে প্রতিবারই কমিটি ঘোষণার পর ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা হয়। সাদ্দাম-ইনান ঘোষিত বর্তমান কমিটি ঘিরেও সে ধারা অব্যাহত থাকল।
গতকাল শনিবার রাতে এ কমিটি ঘোষণা করা হয়। এদিকে কমিটি ঘোষণার একদিন পরেই আজ রবিবার নতুন কমিটিকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেছে ছাত্রলীগের একাংশ।
অনুসন্ধানে জানা যায়, সাদ্দাম-ইনান ঘোষিত বর্তমান কমিটির সাধারণ সম্পাদক আসাদুল্লাহ-হিল-গালিব। তিনি রাবির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক (আইআর) বিভাগে ২০১৪-১৫ সেশনে প্রথম বর্ষে ভর্তি হয়েছিলেন। প্রথম বর্ষে কৃতকার্য হয়ে দ্বিতীয় বর্ষে উঠলেও দ্বিতীয় বর্ষ টপকাতে পারেননি গালিব। এ সময় আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ থেকে একাডেমিক সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম অনুযায়ী ড্রপআউট হন গালিব।
তবে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের শীর্ষ পদ পেতে ঢাকার উত্তরার ১৫ নম্বর সেক্টরে অবস্থিত ‘অতীশ দীপঙ্কর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়’ থেকে বিবিএ পাসের জাল সনদপত্র (রেজিস্ট্রেশন নম্বর-৭৭-০০১৩-১২৪) বানিয়ে রাবির গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষে সান্ধ্যকালীন মাস্টার্স কোর্সে ভর্তি হন।
অনুসন্ধানে জানা যায়, অতীশ দীপঙ্কর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক মো. কামরান চৌধুরী স্বাক্ষরিত একটি চিঠিতে বলা হয়েছে, গালিব ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করেননি। এমনকি ৭৭-০০১৩-১২৪ রেজিস্ট্রেশন নম্বরে সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের যে সার্টিফিকেটটি জমা দিয়ে গালিব সাংবাদিকতা বিভাগের সান্ধ্যকালীন মাস্টার্স কোর্সে ভর্তি হয়েছে সেটিও ভুয়া। এ ছাড়া গালিবের বিরুদ্ধে ক্যাম্পাসে মাদক ব্যবসার সাথে জড়িত এবং অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র বহনের অভিযোগও রয়েছে।
বর্তমান কমিটির সভাপতি মো. মুস্তাফিজুর রহমান বাবু। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের ২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী। ২০১৮ সালে স্নাতক এবং পরের বছর স্নাতকোত্তর শেষ করেছেন বাবু। ছাত্রত্ব ধরে রাখতে বর্তমানে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব আদার ল্যাংগুয়েজেজ-এ ভর্তি আছেন। এছাড়া তিনি দীর্ঘদিন যাবত ক্যাম্পাস রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন না বলে জানিয়েছেন অনেক নেতাকর্মী। সম্মেলনকে ঘিরে হঠাৎ সক্রিয় হন বাবু। এছাড়া বিতর্কিতদের নিয়ে নিয়মিত মিটিং মিছিল ও শোডাউন দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে।
এছাড়া কমিটির সহ-সভাপতি মো. মেজবাহুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। তিনি ২০১৯ সালে অনার্স এবং পরের বছর মাস্টার্স শেষ করেন। এরপর ছাত্রত্ব ধরে রাখতে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংলিশ অ্যান্ড আদার ল্যাঙ্গুয়েজের ইংলিশ ভাষা শিক্ষা কোর্সে ভর্তি আছেন বলে অভিযোগ আছে। এ ছাড়া তার পরিবার বিএনপি-জামায়াতপন্থী রাজনীতির সঙ্গে জড়িত বলে ক্যাস্পাসে প্রচার আছে।
সহ-সভাপতি শাহিনুল ইসলাম সরকার ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স বিভাগে ভর্তি হন ২০১১-১২ শিক্ষাবর্ষে। ২০১৬ সালে অনার্স এবং ২০১৮ সালে মাস্টার্স সম্পন্ন করে ছাত্রত্ব টিকিয়ে রাখতে ইংলিশ অ্যান্ড আদার ল্যাঙ্গুয়েজের জার্মান ভাষার শর্ট কোর্সে ভর্তি রয়েছেন তিনি।
আরেক সহ-সভাপতি মেহেদী হাসান মিশুও ড্রপ আউট হয়ে ছাত্রত্ব হারিয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষের ছাত্র ছিলেন তিনি। তার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, সিট বাণিজ্য, দোকান ভাঙচুরের অভিযোগ রয়েছে। ২০১৯ সালে এক শিক্ষার্থীকে জিম্মি করে ভয়ভীতি দেখিয়ে ২০ হাজার টাকা চাঁদা দাবির অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়া কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের পেছনে ছাত্রদল নেতা নাফিউল ইসলাম জীবনকে মারধরের অভিযোগ রয়েছে।
সহ-সভাপতি আলফাত সায়েম জেমসের নামে হলকক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র চুরি, বরাদ্দকৃত সিটে না থাকতে দেওয়া ও প্রাণনাশের হুমকির অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়া তার নামে সিট বাণিজ্যেরও অভিযোগ রয়েছে।
ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের ২০১৫-১৬ সেশনের শিক্ষার্থী তাওহীদুল ইসলাম দূর্জয়। এই বিভাগ থেকে অনার্স শেষ করেছেন তিনি। কিন্তু ছাত্রত্ব ধরে রাখতে এখনো মাস্টার্স শেষ করেননি। তার বিরুদ্ধে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের বিরোধী রাজনীতি করে সাংগঠনিক দুর্বলতা তৈরির অভিযোগ রয়েছে।
সহ-সভাপতি মোসা. তামান্না আক্তার তন্নী বিশ্ববিদ্যালয়ের চিত্রকলা, প্রাচ্যকলা ও ছাপচিত্র বিভাগের ২০১৪-১৫ সেশনের শিক্ষার্থী। তার মাস্টার্সের পরীক্ষা শেষ হয়েছে ১৮ মাস আগে। বিশ্ববিদ্যালয়ের অনিয়মিত শিক্ষার্থী হওয়ায় তাকে নিজের দখলে রাখা সিট ছাড়ার নির্দেশ দেওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের রহমতুন্নেসা হলের গেটে তালা মেরে দেন এই ছাত্রলীগ নেত্রী।
অন্য আরেক সহ-সভাপতি মো. মোমিন ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃতি বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর শেষ করেছেন। তার নামে বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারীকে পিটিয়ে টাকা ছিনিয়ে নেওয়া এবং হল থেকে বৈধ শিক্ষার্থীকে বের করে দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে।
যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ভাস্কর সাহা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থী। তার নামে অর্থনীতি বিভাগের এক শিক্ষার্থীকে রুমে ডেকে গলায় ছুরি ধরে কাছে থাকা আনুমানিক ২০ হাজার টাকা ছিনিয়ে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী বিষয়টি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও সাংবাদিকদের জানাতে চাইলে রড ও স্টাম্প দিয়ে বেধড়ক মারধর করে। এতে ওই শিক্ষার্থীর কানের পর্দা ফেটে যায়। এর পরও এই বিষয়টি কাউকে জানালে আবরারের যে অবস্থা হয়েছে সেই অবস্থা হবে বলে হুমকি দেয়।
আরেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নাইম আলীর নামে দলীয় কর্মসূচিতে না যাওয়ায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) দুই শিক্ষার্থীর বিছানাপত্র নামিয়ে দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়া শিক্ষার্থী কৃষ্ণ রায়কে নির্যাতনের পর মেরে ‘শিবির’ বলে চালিয়ে দেওয়ার হুমকির ঘটনায় তদন্তে এই ছাত্রলীগ নেতার সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়। এই ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শৃঙ্খলা কমিটির সভায় তার ছাত্রত্ব সাময়িক বাতিলের সুপারিশ করা হয়।
সাংগঠনিক সম্পাদক নাশরাত আর্শিয়ানা ঐশি বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব হলের ২৮৮ নম্বর কক্ষে থাকতেন। তবে তার নামে ডাবল সিটের কক্ষে একা থাকাসহ রাজনৈতিক ক্ষমতা দেখিয়ে হলের নিয়মনীতি না মানার অভিযোগ রয়েছে। এ ঘটনায় তার কক্ষে তালা ঝুলিয়ে দেয় হল প্রশাসন।
এ ছাড়া নতুন ঘোষিত এ কমিটির বেশির ভাগই ছাত্রত্ব হারিয়ে এখন সান্ধ্যকালীন কোর্সধারী। সিট বাণিজ্য, চাঁদাবাজি, শিক্ষার্থী নির্যাতন, দলীয় কোন্দলসহ নানা অভিযোগ রয়েছে তাদের নামে।