চবি ছাত্রলীগের লাগাম টেনে ধরবে কে?
- জানে আলম, চবি প্রতিনিধি
- প্রকাশ: ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০৫:২৫ PM , আপডেট: ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১১:৪০ AM
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে (চবি) আবারও এক সাংবাদিককে মারধরের ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনায়ও জড়িত শাখা ছাত্রলীগের উপগ্রুপের কর্মীরা। এর আগেও এক নারী সাংবাদিককে হেনস্তা ও হুমকি, চায়ের দোকানে বসাকে কেন্দ্র করে আরেক সাংবাদিককে মারধর, শিক্ষককে হুমকি এবং চিফ ইঞ্জিনিয়ার ও নিরাপত্তা প্রধানকে মারধরসহ বিভিন্ন ঘটনায় সংবাদের শিরোনাম হয়েছে চবি ছাত্রলীগ।
শুধু তাই নয়। শাখা ছাত্রলীগের বেপরোয়া কর্মকাণ্ডে চবির উপাচার্য দপ্তর, পরিবহনের প্রায় ৬০টি গাড়ি, শিক্ষক ক্লাব ও পুলিশ বক্স ভাংচুরসহ প্রায়ই সময় সংঘর্ষে জড়ান। এসব ঘটনার জেরে আজ রবিবার (২৪ সেপ্টেম্বর) চবি ছাত্রলীগের কমিটি বিলুপ্ত করে দিয়েছে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদ।
চাঁদাবাজি, অনিয়ম ও উশৃংখলতার ক্ষেত্রে শাখা ছাত্রলীগের উপর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। ফলে ছাত্রলীগের এসব বেপরোয়া কর্মীদের নিয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের মনে প্রতিনিয়তই ভয় ও শঙ্কা বিরাজ করছে।
জানা যায়, আজ রবিবার সাড়ে ১১টায় শাখা ছাত্রলীগ সভাপতি রেজাউল হক রুবেলের নেতৃত্বাধীন সিএফসি গ্রুপের কর্মীরা সংবাদমাধ্যম প্রথম আলোর চবি প্রতিনিধিকে মারধর করে। এসময় "আর নিউজ করিস, তারপর দেখব'' বলে ওই সাংবাদিককে হুমকিও দেন তারা।
আরও পড়ুন: সাংবাদিক মারধরের পরেই চবি ছাত্রলীগের কমিটি বিলুপ্ত
মারধরের শিকার হওয়া ওই প্রতিনিধি মোশাররফ জানান, বেলা সাড়ে ১১ টার দিকে আমি উপাচার্যের কার্যালয়ে যাচ্ছিলাম ছাত্রলীগের সংঘর্ষ, ভাঙচুর, প্রধান প্রকৌশলীকে মারধরসহ অন্যান্য বক্তব্য নেওয়ার জন্য। এ সময় নতুন কলা ও মানববিদ্যা অনুষদের সামনে ১৫ থেকে ২০ জন ছাত্রলীগের কর্মী আমাকে প্রথমে পিছন থেকে ধাক্কা দেন। এরপর ছাত্রলীগ নিয়ে কেন প্রতিবেদন করেছি, তা জানতে চায়। কয়েকজন আমার কপালে, মুখে কিলঘুষি ও বুকে লাথি দেয়। এরপর তারা আমার হাতেও আঘাত করে।
মোশাররফ আরও জনান, মারধরের সময় তারা আমাকে পরবর্তীতে ছাত্রলীগ নিয়ে আর কোন প্রতিবেদন না ছাপানোর জন্য হুমকি দেন। তারা বলেন, আর যদি নিউজ করিস, তারপর দেখব তোরে কে বাঁচাতে আসে। ছাত্রলীগকে নিয়ে কোন নিউজ হবে না।
মারধরের পর ওই প্রতিনিধির শারীরিক অবস্থার বর্ণনা দিতে গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় চিকিৎসা কেন্দ্রের প্রধান চিকিৎসা কর্মকর্তা মো. আবু তৈয়ব বলেন, মোশাররফের কপালে চারটি সেলাই দিতে হয়েছে। তার হাতেও আঘাত আছে। এক্সরে করাতে হবে। এ ছাড়া উন্নত চিকিৎসা জন্য তাকে চমেকে পাঠানো হয়েছে।
এদিকে সাংবাদিকের উপর হামলাকে গণতন্ত্রের জন্য হুমকি মনে করছেন চবি যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক খ. আলী আর রাজী। তিনি বলেন, এটা স্বাধীন সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে যেমন বাধা তেমনি গণতন্ত্রের জন্যও বড় ধরনের বাধা।
তিনি আরও বলেন, সাংবাদিকতা করতে গিয়ে জীবনকে ঝুঁকিতে ফেলতে হলে দেশে গণতন্ত্র বলে কিছু থাকবে না। আজকে তার জীবন বিপন্ন হতে পারতো। জীবনের চেয়ে তো সাংবাদিকতা বড় হতে পারে না। জীবন না থাকলে সাংবাদিকতা দিয়ে কি করবেন? কোন যুদ্ধের ক্ষেত্রেও সাংবাদিকদের একটা নিরাপত্তা থাকে। কিন্তু এখানকার প্রশাসন এতটাই অযোগ্য যে সাংবাদিকদের কোন নিরাপত্তায় দিতে পারে না।
ওই শিক্ষক আরও বলেন, বিচার না হওয়াতে যারা সাংবাদিক পেটাচ্ছে তারা একটা বার্তা দিচ্ছে যে, দেখো আমরা সাংবাদিকদেরই কেয়ার করি না। এমন পরিস্থিতি হলে সাধারণ শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা কথা বলার সাহস পাবে কিভাবে? এ পরিস্থিতির পরিবর্তন না হলে ফলাফল আরও ভয়াবহ হবে।
এ বিষয়ে শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক আবদুল হক বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ৭৩ এর অধ্যাদেশকে সমুন্নত রেখে আইনের শাসন এবং নীতি নৈতিকতা মেনে প্রশাসন পরিচালনা করতে হয়। কিন্তু এই প্রশাসনের আগ্রহের জায়গা হচ্ছে নিয়োগ বাণিজ্য এবং ব্যক্তিগত সুবিধা আদায় করা। নিয়োগ কেলেঙ্কারি সহ বিভিন্ন সুবিধাভোগ করতে করতে প্রশাসনের ইমেজ এখন তলানিতে পৌঁছে গিয়েছে।
আরও পড়ুন: ‘ছাত্রলীগ নিয়ে কেন নিউজ হয়েছে’ বলেই চবিতে সাংবাদিককে মারধর
তিনি আরও বলেন, এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের যে একটা প্রশাসন আছে তা কেউ অনুভব করে না। এভাবে একটা বিশ্ববিদ্যালয় চলে না। প্রথম আলোর প্রতিনিধিকে মারধর কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এর আগেও এমন অনেক ঘটনা ঘটেছে যার বিচার হয়নি। বিচারহীনতার সংস্কৃতির দরুন এখানে এতো এতো অব্যবস্থাপনা রয়েছে যে প্রশাসনের কোনো ভাবমূর্তি নাই। ডিসিপ্লিনারি কমিটি ঘটনাগুলোর বিচার করে শাস্তি দেয় আবার ছাত্রলীগ ক্ষমা চাইলে ক্ষমা করে দেয়, শাস্তি কার্যকরের ক্ষেত্রে নতজানু নীতি ফলো করে অর্থাৎ যে লাউ সে কদু। এসব বিচার করার জন্য করা,কার্যত কিছুই না।
এঘটনার প্রতিবাদে বিকেল ৩টায় ভুক্তভোগী সাংবাদিক মোশাররফ শাহের উপর বর্বরোচিত হামলার প্রতিবাদে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতি (চবিসাস) মানববন্ধন করেছে। এসময় সংগঠনটির দপ্তর সম্পাদক মোহাম্মদ আজহারের সঞ্চালনায় সভাপতি মাহবুব এ রহমান বলেন, প্রশাসন বিশ্ববিদ্যালয়কে ছাত্রলীগের কাছে ইজারা দিয়েছে বলে মনে হচ্ছে। বহিষ্কৃত ছাত্রলীগ কর্মী তার গ্রুপের নেতাকে নিয়ে ক্যাম্পাস দাপিয়ে বেড়ালেও প্রশাসন কিছু দেখছেন না, আবার শাস্তি ক্ষমা করে পরীক্ষায়ও বসতে দিচ্ছেন। এসব নতজানু নীতির কারণে ছাত্রলীগ নিয়মশৃঙ্খলা ভঙ্গ করতে কোনো ভয় পাচ্ছে না। আমি কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের কাছে আহ্বান করবো এসব ঘটনায় জড়িতদের শাস্তির আওতায় নিয়ে আসা হোক। স্বাধীন সাংবাদিকতা করতে ছাত্রলীগ এভাবে বাঁধা দিতে পারে না। এঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে ব্যবস্থা নিতেই হবে।
সার্বিক বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক বেনু কুমার দে বলেন, মারধরের বিষয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। পাঁচ কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত কমিটিকে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে। আমি তাকে সাংবাদিক বলার আগে সে আমার শিক্ষার্থী। যারা এ ঘটনায় জড়িত তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তদন্ত কমিটির রিপোর্টের ভিত্তিতে দোষীদের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন মামলা করবে কিনা তা পরে জানানো হবে। এছাড়াও আমরা বিভিন্ন পরিকল্পনা নিয়েছে। পরিস্থিতি দ্রুতই নিয়ন্ত্রণে আসবে।