ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

আইন বিভাগে সান্ধ্য কোর্স চালু নিয়ে প্রতিবাদ ঘরে-বাইরে

গত বুধবার সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আইন বিভাগের প্রাক্তন শিক্ষার্থীবৃন্দ’-এর ব্যানারে কর্মসূচি
গত বুধবার সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আইন বিভাগের প্রাক্তন শিক্ষার্থীবৃন্দ’-এর ব্যানারে কর্মসূচি  © ফাইল ছবি

প্রায় দুই বছর ভর্তি কার্যক্রম বন্ধ ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) সান্ধ্য কোর্স। তবে নতুন নীতিমালার আলোকে গত বছরের মার্চের শেষ দিকে  নীতি নির্ধারণী সর্বোচ্চ ফোরাম সিন্ডিকেটের এক নিয়মিত সভায় ‘প্রফেশনাল ও এক্সিকিউটিভ মাস্টার্স প্রোগ্রাম’ নামে সান্ধ্য কোর্স চালুর অনুমোদন দিয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। তার এক বছর পর সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়টির আইন বিভাগে প্রফেশনাল এল.এল.এম নামে একটি সান্ধ্য কোর্সের ভর্তি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হলে সেটি নিয়ে তুমুল সমালোচনা শুরু হয়।

এটিকে ‘বাণিজ্যিক কোর্স’ অবহিত করে তা বন্ধের দাবিতে আইন বিভাগের সাবেক ও বর্তমান শিক্ষার্থীরা ছাড়াও বিভিন্ন মহল থেকে প্রতিবাদ উঠেছে। পালন করা হয়েছে প্রতিবাদ কর্মসূচিও। প্রতিবাদ করা এসব ব্যক্তি ও সংগঠন বলছেন, বিভাগের শিক্ষকরা ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হওয়ার জন্য বাণিজ্যিক দৃষ্টিকোন থেকে এ কোর্স চালুর উদ্যোগ নিয়েছে। বিপরীতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিক্ষার পরিবেশ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশ্য।

তবে বিশ্ববিদ্যালয় ও আইন বিভাগ কর্তৃপক্ষ বলছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতিমালার আলোকে এই কোর্স চালুর অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে সমাজ ও জাতির চাহিদা মোতাবেক এটি পরিচালিত হবে।

জানা গেছে, ২০২০ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কাউন্সিলের এক সভায় বিশ্ববিদ্যালয়ে চলমান সান্ধ্য কোর্সসহ অনিয়মিত সব কোর্সে নতুন শিক্ষার্থী ভর্তির সব ধরনের কার্যক্রম স্থগিত করা হয়। একইসঙ্গে সান্ধ্য কোর্স পরিচালনার সময়োপযোগী বিধিমালা প্রণয়ন করতে একটি কমিটিও করা হয় সেদিন। করোনা পরিস্থিতির কারণে দীর্ঘদিন ওই কমিটির কার্যক্রম বন্ধ ছিল।

এর প্রায় দুই বছর পর ২০২২ সালের ২১ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কাউন্সিলে কমিটির করা বিধিমালা অনুমোদিত হয়। পরে ওই মাসের ২৮ তারিখে নতুন নীতিমালার আলোকে ‘প্রফেশনাল ও এক্সিকিউটিভ মাস্টার্স প্রোগ্রাম’ ফের চালুর অনুমোদন দিয়েছিল সিন্ডিকেট। সে সময় বলা হয়েছিল, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্যেক বিভাগ এ ধরনের সর্বোচ্চ একটি কোর্স চালু করতে পারবে। এসব কোর্সে শিক্ষার্থী ভর্তির কার্যক্রম শুরু করার আগে অনুমোদন নিতে হবে। 

এদিকে সম্প্রতি আইন বিভাগে এ ধরনের কোর্স চালুর অনুমতি দেয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। পরে ভর্তি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়ে এ বিষয়টি জানাজানি হয়। এরপর বিষয়টি নিয়ে প্রতিবাদ উঠেছে। গত বুধবার সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আইন বিভাগের প্রাক্তন শিক্ষার্থীবৃন্দ’-এর ব্যানারে আইনজীবীরা এক প্রতিবাদ সভা করেন।

সেখানে বক্তারা বলেন, এই সিদ্ধান্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সাধারণ মাস্টার্সের মর্যাদাকে ক্ষুন্ন করবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কোন বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য প্রতিষ্ঠিত হয়নি। তাই এই বিজ্ঞপ্তির কার্যক্রম অবিলম্বে বন্ধ করা উচিত।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট 'বাণিজ্যিক' কোর্স অ্যাখ্যা দিয়ে কোর্স বাতিলের তিন দফা দাবি জানায়। সংগঠনের নেতৃবৃন্দ বলছেন, সম্পূর্ণ বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে তারা এই কোর্স খুলতে চায়। কতৃপক্ষের এইরকম চিন্তা বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারণার সাথে সাংঘর্ষিক। বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ জ্ঞান সৃষ্টি—বিতরণ—সংরক্ষণ হলেও তা ভুলে গিয়ে শিক্ষাকে আজ পণ্যে পরিণত করা হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়কে দোকানে পরিণত করা হয়েছে।

এ ধরনের কোর্স বাতিলের জন্য তাদের তিন দফা হলো– অবিলম্বে আইন বিভাগে বাণিজ্যিক প্রফেশনাল কোর্স খোলার সিদ্ধান্ত বাতিল করতে হবে; অন্যান্য বিভাগেও যেসব বাণিজ্যিক কোর্স চালু আছে তা বাতিল করতে হবে; রেগুলার ব্যাচের আসনসংখ্যা কমানোর ঘোষণা বাতিল করতে হবে।

‘বাণিজ্যিক কোর্স’ বন্ধ করার দাবি জানিয়েছে গণতান্ত্রিক ছাত্র জোট ঢাবি শাখা। গণতান্ত্রিক ছাত্র জোট ঢাবি শাখার সমন্বয়ক ও সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি রাজীব কান্তি রায়, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন ঢাবি সংসদের সভাপতি শিমুল কুম্ভকার, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট ঢাবি শাখার সভাপতি সাদিকুল ইসলাম সাদিক, বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রী ঢাবি শাখার আহবায়ক জাবির আহমেদ জুবেল, গণতান্ত্রিক ছাত্র কাউন্সিল ঢাবি’র সংগঠক সাজিদ উল ইসলাম, বিপ্লবী ছাত্র—যুব আন্দোলন ঢাবির সংগঠক আবরার ইফাজ এবং বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশন ঢাবির সংগঠক মাহফুজ আহম্মেদ প্রশাসনের এমন সিদ্ধান্তের তীব্র নিন্দা জানিয়ে এক যৌথ বিবৃতি দেন।

এতে তারা বলেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারণার সাথে যেকোনো ধরণের বাণিজ্যিক কোর্স সাংঘর্ষিক। জনগণের করের টাকায় পরিচালিত অবকাঠামো ব্যবহার করে শিক্ষা ব্যবসার বিরোধীতা করছি আমরা। এই সকল বাণিজ্যিক কোর্সের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে প্রশাসন ও কোর্সের সাথে যুক্ত শিক্ষকরা। বিপরীতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিক্ষার পরিবেশ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশ্য।

এদিকে আগামীকাল সোমবার গণতান্ত্রিক ছাত্র জোট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা আইন অনুষদের সামনে এই বাণিজ্যিক কোর্স বন্ধের দাবিতে বিক্ষোভ সমাবেশ করবে।

এ বাণিজ্যিক কোর্স চালুর বিষয়ে আইন বিভাগে সাবেক শিক্ষার্থী ফুয়াদ হোসেন শাহাদাত বলেন, শিক্ষা তো মানুষের জন্য। আইন বিভাগের শিক্ষকরা শিক্ষাকে বাণিজ্যিক করণের প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। যেখানে একজন নিয়মিত শিক্ষার্থী মাস্টার্সে ভর্তির জন্য দশ থেকে ১২ হাজার টাকা দিয়ে ভর্তি হতে পারে। সেখানে বাহির থেকে মাস্টার্সের জন্য একজন শিক্ষার্থীকে ২ লাখ ৮০ হাজার দিতে হচ্ছে। এখানে এত ব্যবধান কেন? এতেই প্রমাণিত হয় শিক্ষাকে বাণিজ্যে রূপান্তরিত হচ্ছে। যেই বিভাগে বঙ্গবন্ধু পড়েছে, সেই বিভাগের এমনটা হতে পারে না। আইন বিভাগের কোনো শিক্ষার্থীই বিষয়টিকে সমর্থন করে না।

এ বিষয়ে আইন বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মো আসিফ নজরুল বলেন, আমাদের শিক্ষকরা টাকা উপার্জনের জন্য এ কোর্স চালু করেনি। টাকা উপার্জনের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অনেক পথ খোলা আছে। আমাদের মূল চিন্তা হচ্ছে– বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন, শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন আর্থিক সহায়তা, আইন বিভাগের সম্প্রসারণ, ই-লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠাসহ বিভিন্ন ব্যাপারে আর্থিক স্বনির্ভরতা তৈরীর জন্য কোর্স চালু করা হয়েছে। 

তিনি আরও বলেন, এ ব্যাপারে কারো আপত্তি থাকলে আনুষ্ঠানিকভাবে চিঠি দিয়ে আলোচনা করতে চায়। তাহলে আমরা আলোচনা করতে রাজি আছি।

এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. আখতারুজ্জামান দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় কোনো বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান নয়। বিশ্ববিদ্যালয় এ জায়গা থেকে কোনো মুনাফা নিবে না। সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে সমাজ ও জাতির চাহিদা মোতাবেক আইনের প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

আইন বিভাগে কি হচ্ছে?
অধ্যাপক ড. মো আসিফ নজরুল আইন বিভাগে প্রফেশনাল মাস্টার্সের চালুর ব্যাপারে ব্যাখ্যা দিয়েছেন। শনিবার তিনি তার ফেসবুকে এই ব্যাখ্যা দেন। তিনি বলেন, আইন বিভাগে প্রফেশনাল মাষ্টার্স কোর্স নিয়ে বিভাগের প্রাক্তন ও বর্তমান কিছু শিক্ষার্থীর ভিন্নমত আমাদের নজরে এসেছে। আমরা ভিন্নমতকে শ্রদ্ধা জানাই এবং একারনে কিছু বিষয়ে প্রকৃত তথ্য তুলে ধরার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছি। 

১.  প্রফেশনাল মাষ্টার্স কোর্স ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদিত একটি কোর্স এবং এটি চালু করার সিদ্ধান্তটি আইন বিভাগের সকল শিক্ষকের সম্মতির ভিত্তিতে গ্রহণ করা হয়েছে। 

২. এই কোর্স চালুর পেছনে মূলত বিভাগের উন্নয়ন, কো-কারিকুলার ও গবেষনা কার্যক্রম বৃদ্ধি, এবং ছাত্র-ছাত্রীদের বিভিন্ন কল্যানের কথা ভাবা হয়েছে। অতীতে বিভাগের অনেক প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি আমরা শিক্ষকরা এমন কিছু কাজে সাধ্যমতো ব্যাক্তিগত ভাবে অর্থদান করেছি। তবে ব্যক্তি উৎসের অনিশ্চয়তা ও অপর্যাপ্ততা বিবেচনা করে বিভাগের একটি নিশ্চিত ও স্থায়ী ফান্ডের প্রয়োজন বিভাগ সবসময় অনুভব করেছে।

প্রফেশনাল মাস্টার্স কোর্স চালু হলে সেখান থেকে প্রাপ্ত মোট অর্থ থেকে কেন্দ্রীয় ছাত্র বৃত্তিতে ১০ শতাংশ, বিভাগের উন্নয়নমূলক কাজে ৫ শতাংশ এবং বিভাগের গবেষনা ফান্ডে ৫ শতাংশ  খরচ করার বিধান রয়েছে এবং ডীন অফিসের নামে ৫ শতাংশ বরাদ্ধ রয়েছে। আমরা এসব উৎস থেকে পাওয়া অর্থ আইন বিভাগের নিয়মিত  শিক্ষার্থীদের কোট ভিজিট, ক্লিনিকাল লিগ্যাল এডুকেশন, মুটকোর্ট ও শিক্ষা সফরের মতো কাজে ব্যবহার করতে পারবো বলে আশা করি। উল্লেখ্য, আর্থিক অপ্রতুলতার জন্য অতীতে এসব কার্যক্রম অনিয়মিত বা খন্ডিত পরিসরে চালাতে হয়েছে বা বন্ধ করে দিতে হয়েছে।   

৩. কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন শিক্ষকরা ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হওয়ার জন্য বাণিজ্যিক সৃষ্টিকোন থেকে এটি চালু করা উদ্যোগ নিয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধান অনুসারে, প্যারা ২-তে উল্লেখিত উপরোক্ত খরচসমূহ বাদে কোর্সটি থেকে প্রাপ্ত অর্থের ৩০ শতাংশ বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রদান করার বিধান রয়েছে। প্রোগ্রাম চলার খরচ হিসেবে বাকী মাত্র ৪৫ শতাংশ খরচ করার সুযোগ আইন বিভাগের রয়েছে। ফলে এখানে একটি কোর্স-এ শিক্ষাদান করে এমনকি একজন সিনিয়র অধ্যাপকের মাসে বড়জোর ২৫ হাজার টাকা উপার্জন করার কথা যা অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্ধেকের মতো। ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হতে চাইলে এখানকার বহু শিক্ষক বরং এতে শিক্ষাদানে রাজি হওয়ার কথা না। 

৪. এখানে ভর্তির আবেদন করার যোগ্যতা হিসেবে পাবলিক পরীক্ষায় জিপিএ/সিজিপিএ মাত্র ২.৫ কেন চাওয়া হয়েছে তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। আমরা এরসাথে একমত। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট ও একাডেমিক কাউন্সিলের বেধে দেয়া বিধি অনুসারে এর বাইরে যাওয়ার উপায় আমাদের নেই। উল্লেখ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল প্রফেশনালে/এক্সিকিউটিভ বা অনুরূপ কোর্সে একই জিপিএ/সিজিপিএ-র বিধান রয়েছে।

৫. কোর্স পরিচালনা এবং পাঠ্যদানে বিভাগের কৃতি প্রাক্তন ছাত্র-ছাত্রীদের অন্তর্ভূক্তির বিষয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধান অনুসারে আমরা অবশ্যই বিবেচনা করে দেখবো।

সবশেষে তিনি লেখেন, আমরা আশা করবো এ বিষয়টি নিয়ে ভুল বোঝাবুঝির অবসান হবে। আমরা আইন বিভাগর স্বার্থে একসাথে কাজ করতে সমর্থ হবো।


সর্বশেষ সংবাদ