আসন সংকটে অতিথি কক্ষে ৩ বছর পার ছাত্রীদের, খাবার নিয়েও অসন্তোষ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়  © ফাইল ছবি

আবাসন সংকট, নিম্নমানের খাবারসহ নানারকম সমস্যায় জর্জরিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) নারী শিক্ষার্থীদের জন্যে বরাদ্দে থাকা হলগুলো। সম্প্রতি ছাত্রীদের আবাসিক হলগুলোর এসব সমস্যা সমাধানে মানববন্ধন করেছেন হলগুলোর ছাত্রীরা। এসময় তারা সমস্যা সমাধানে নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দেন। সবগুলো হলের মধ্যে সবচেয়ে শোচনীয় অবস্থা বাংলাদেশ-কুয়েত মৈত্রী হলের। এই হলটির ছাত্রীরা এসব সমস্যা নিয়ে দিনের পর দিন পার করে দিলেও মুখ খুলে বলতে পারছেন না তাদের সমস্যার কথা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মৈত্রী হলের অতিথি কক্ষের এক ছাত্রী জানান, ‘বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে স্নাতক ৩য় বর্ষে উঠে যাওয়ার পরও এখনো বৈধ সিটে উঠতে পারিনি। আমার মত এখানে অনেক ছাত্রী রয়েছেন। আমরা একাধিকবার সিটের জন্য আবেদনের প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেও কোন ফল পাইনি। বিগত ২ বছরের বেশি সময় ধরে হলের অতিথি কক্ষে থাকতে হচ্ছে আমাদের।’

এ পরিস্থিতির কারণ হিসেবে এ ছাত্রী বলছেন হলে মাস্টার্স শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও অনেক ছাত্রী দেরি করে সিট ছাড়েন। এক্ষেত্রে এসব ছাত্রীরা বিশ্ববিদ্যালয় প্রণীত নিয়ম ভাঙছেন। কিন্তু হল প্রশাসন এই দিকটি সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ না করায় বাকি ছাত্রীদের ভুগতে হচ্ছে।

আরও পড়ুন: পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আবাসন সুবিধা নেই ৬৬ ভাগ শিক্ষার্থীর

হলের সিট সংকট নিয়ে আরেক ছাত্রী বলেন, ‘হলের মনোয়ারা ভবনে বেশিরভাগ মেয়েই পলিটিক্যাল সুবিধা নিয়ে উঠেছেন। সিট সংকটের জন্য সেখানে নতুন ছাত্রী স্থানান্তরও সম্ভব না। একইসঙ্গে ভবনটি পুরনো আর ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। যদি এটিকে বর্ধিত করে পুনর্নির্মাণ করা যায়, তাহলে হয়তো কিছুটা সমস্যা কমবে।'

শুধু আবাসন সংকটেই শেষ নেই। হলটিতে পরিবেশন করা খাবার নিয়েও রয়েছে ব্যাপক অভিযোগ। ছাত্রীরা জানান, প্রায়ই নষ্ট খাবার দেয়া হয় হল ক্যান্টিনে। এক ছাত্রী বলেন, 'প্রায়ই দেখা যায় খাবার কিনে সে খাবার মুখে দেয়া যাচ্ছে না। এমনিতেই দ্রব্যমূল্য বেড়ে যাওয়ার পর খাবার পরিমাণে কমিয়ে দেয়া হয়েছে। এরমধ্যে যদি পচা-বাসি খাবার খেতে হয় তাহলে সেটা আমাদের দুর্ভাগ্য।’

বাংলাদেশ-কুয়েত মৈত্রী হল

বিশ্ববিদ্যালয়টির নারী ছাত্রীদের প্রায় সবগুলো হলের একই চিত্র। এসব সমস্যা নিয়ে গত ৪ সেপ্টেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের সন্ত্রাস বিরোধী রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী শিক্ষার্থীবৃন্দ’ ব্যানারে মানববন্ধনের আয়োজন করেন ছাত্রীরা। এ কর্মসূচির পরবর্তী তিনদিনের মধ্যে সংকট নিরসনে কোন পদক্ষেপ না নিলে অনশনে বসার হুঁশিয়ারি করা হয়েছে। তবে পরে এ বিষয়ে কোন পক্ষ থেকেই দৃশ্যমান পদক্ষেপ দেখা যায়নি।

জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের মৈত্রী হলে মোট ৫টি অতিথি কক্ষ রয়েছে। বৈধ সিট না পাওয়া পর্যন্ত ছাত্রীরা সেখানে থাকেন। প্রতি রুমে ২০ জন করে মোট ১০০ জন ছাত্রীকে থাকতে হয়। অতিথি কক্ষের ছাত্রীরা জানান, এক রুমে গাদাগাদি করে থাকা অনেক কষ্টকর। এরমধ্যে তারা ঠিকভাবে রিডিং রুমের সুবিধা পান না।

আরও পড়ুন: পূর্ণ আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে যবিপ্রবি

এক ছাত্রী এ বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, 'হলে মোট ৩টি রিডিং রুম আছে। এরমধ্যে অতিথি কক্ষের ছাত্রীদের জন্য বরাদ্দ রুম একটি। কিন্তু সেখানে পর্যাপ্ত জায়গা না থাকায় আমরা পড়ার সুযোগ পাই না। বাকি রিডিংরুমগুলো অন্য ভবনে হওয়ায় আমরা সবসময় যেতেও পারি না।'

ছাত্রীরা জানান হলে আরও একটি বড় সমস্যা হলো অ-স্বাস্থ্যকর ওয়াশরুম। হলের ওয়াশরুমগুলোতে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা প্রতিনিয়ত করা হয় না। এমনকি ৩টি ওয়াশরুমের জন্য মাত্র একটি লাইট জ্বালানো হয়। হলের এক ছাত্রী বলেন, 'গোসলখানা বা টয়লেট ব্যবহার করতে গেলে প্রায়ই অন্ধকারে অসুবিধায় পড়তে হয়। এমনিতেই ১০০ জন মেয়ে ৩টা গোসলখানা, ৩টা টয়লেট ব্যবহার করি এরমধ্যে যদি আরও অসুবিধা ভোগ করতে হয় কি করবো!'

মৈত্রী হলের হাউজ টিউটর মনিরা পারভীন বলেন, 'সম্প্রতি জেনারেল মিটিং-এর মাধ্যমে প্রতি ফ্লোরে একজন করে হল প্রতিনিধি নির্বাচন করা হয়েছে। তারা খাবারের মান যেন ঠিক থাকে সেসব বিষয় পর্যবেক্ষণ করবেন। এছাড়া একটি নীতিমালা তৈরি করা হয়েছে যে- হল ক্যান্টিনের কোন কর্মচারী যদি পচা-বাসি খাবার পরিবেশন করেন কিংবা মেয়েদের সঙ্গে কোন বিষয়ে দুর্ব্যবহার করেন তাহলে তাকে জরিমানা করা হবে। এরকম পরপর ৩ বার ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটলে তিনি বহিষ্কারও হতে পারেন।

মৈত্রী হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক ড. নাজমুন নাহার দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস কথা বলেন, যারা বর্তমানে তৃতীয় বর্ষে আছেন তারা সকলেই ২০১৯-২০ সেশনের ছাত্রী। ইতিমধ্যে তাদের ২টি বিজ্ঞপ্তি দিয়ে ১৫০ জন ছাত্রীকে আবাসিক করা হয়েছে। এখনো প্রায় ৭০ জন অতিথি কক্ষে থাকছেন; তাদের সিটের ব্যবস্থা করতে পারিনি। কারণ, এই হলে সিট সংখ্যা মাত্র ৬৫৪টি। প্রশাসনের সঙ্গে হলের সিট সংখ্যা বাড়ানোর ব্যাপারে কথা বলেছি।

ক্যান্টিনের খাবারের দাম ও মান নিয়ে অধ্যাপক নাজমুন নাহার বলেন, ‘যতই ভালো খাবার রান্না করা হোক না কেন সবাই তো আর এক খাবার পছন্দ করেন না। আমি নিজেই মাঝেমধ্যেই ক্যান্টিনে খাবার খাই। খাবারের মানের ব্যাপারে হল কর্তৃপক্ষ সচেতন রয়েছে। বর্তমানে হলে একটি নিয়ম করা হয়েছে, পচা-বাসি খাবার পাওয়া গেলেই ক্যান্টিনগুলোকে জরিমানা গুনতে হবে, তাই ক্যান্টিন মালিকরাও সচেতন থাকে।

মানববন্ধন

এর আগে গত ৪ সেপ্টেম্বর হলের সমস্যা নিয়ে ছাত্রীদের উদ্যোগের আয়োজিত মানববন্ধন কর্মসূচি থেকে ছয়টি দাবি জানানো হয়। দাবিগুলো হলো- অনাবাসিক ও এক হলের ছাত্রীদের অন্য হলে ঢোকার ব্যবস্থা করা; খাবারের মান বৃদ্ধি ও প্রয়োজনীয় মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা করা; পর্যাপ্ত পরিমাণে বিশুদ্ধ পানির ফিল্টার স্থাপন করা; হলের কর্মচারীদের দৌরাত্ম্য কমানো এবং ছাত্রীদের সাথে খারাপ ব্যবহার করলে প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ; হলে ফার্মেসী স্থাপন এবং কোনো ছাত্রী রাতে অসুস্থ হয়ে পড়লে দ্রুত চিকিৎসা প্রদানের ব্যবস্থা করা; ও অগ্রীম অ্যাপ্লিকেশন ছাড়া নাম এন্ট্রির মাধ্যমে রাত সাড়ে ১১টা পর্যন্ত গেইট দিয়ে ঢোকার ব্যবস্থা করা।

বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের ২য় বর্ষের শিক্ষার্থী রাফিয়া রেহনুমা রিদি বলেন, ডাকসু না থাকার কারণে প্রশাসন ও শিক্ষার্থীদের মাঝে মেলবন্ধন নেই। প্রশাসনের একচ্ছত্র আধিপত্যের কারণে শিক্ষার্থীরা অনেক অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। শিক্ষকরা ঠিকই বেতন নেন কিন্তু হলগুলোতে নূন্যতম কোনো মানবিক মর্যাদা নিশ্চিত করা হয় না। আমরা আশা করি, প্রশাসন এই দাবিগুলো মেনে নেবে। প্রশাসন ও শিক্ষার্থীদের মাঝে দূরত্ব কমে আসুক।


সর্বশেষ সংবাদ