ছাত্রদল নেতাদের নেতৃত্বে ইউজিসিতে ‘ক্যু’, সচিবকে অপসারণ

ফেরানো হয়েছে নারী কেলেঙ্কারিতে জড়িতদেরও; পছন্দের কর্মকর্তাদের দায়িত্ব বণ্টন করে তালিকায় স্বাক্ষরের চেষ্টা

ইউজিসি ও ছাত্রদলের লোগো
ইউজিসি ও ছাত্রদলের লোগো  © সম্পাদিত

বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) ছাত্র সংগঠন ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় দুই নেতা এবং দেশের উচ্চশিক্ষার তদারক সংস্থা বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) কর্মকর্তা-কর্মচারী মিলে নিজেদের পছন্দের বাইরের কর্মকর্তাদের পদচ্যুতির চেষ্টা করেছেন। রবিবার (১১ আগস্ট) দুপুরের দিকে ইউজিসির বর্তমান ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আলমগীরকে অবরুদ্ধ করে তার কাছ থেকে স্বাক্ষর নেওয়ার চেষ্টা করেছেন ছাত্রদলের পরিচয়ধারী নেতারা। এসময় একই ছাত্র সংগঠনের পরিচয়ে কমিশনের বাইরে আরও কয়েকজন নেতাকর্মী দল বেঁধে অবস্থান করছিলেন বলে জানা গেছে।

কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ছাত্রদলের নেতা-কর্মীরা কমিশনের ভেতরে এবং বাইরে অবস্থান করেন। এর মধ্যে মওদুদ আহমেদ নামের একজন নিজেকে কেন্দ্রীয় কমিটির দাবি করে ইউজিসির বেশ কয়েকজন কর্মকর্তাকে নানা ধরনের হুমকি এবং অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করেন। তাদের সাথে ইউজিসির একজন অফিস সহায়ক ছিলেন—যিনি এক বছর আগে নারী কেলেঙ্কারিতে হাতেনাতে ধরা পড়লে তার ইনক্রিমেন্ট বন্ধ হয়ে যায়। তাদের সাথে আরও ছিলেন ইউজিসির বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শাখার উপ-পরিচালক ড. মহিবুল আহসানসহ ৪ চার কর্মকর্তা। 

সরানোর চেষ্টা করা হয়েছিল এ ১৯ কর্মকর্তাকে। তালিকাটি ইউজিসির অভিযুক্ত কর্মকর্তারা প্রস্তুত করে ছাত্রদল নেতাদের প্রদান করেন। তারা এতে স্বাক্ষর করতে ইউজিসির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানকে চাপ প্রয়োগ করতে থাকেন। পরবর্তীতে তিনি তাতে স্বাক্ষর করতে অস্বীকৃতি জানান। ছবি: দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস।

এদিন ইউজিসির বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শাখার ডিরেক্টর ওমর ফারুখকে সরিয়ে একই পদে বসার চেষ্টা করেছেন ইউজিসির একই শাখার বর্তমান উপ-পরিচালক ড. মহিবুল আহসান। সেজন্যই তিনি ইউজিসির পরিচালক পদ মর্যাদাধারী একজনের পরামর্শে ছাত্রদলের নেতাকর্মীদের কমিশনে ডেকে এনেছেন—জানিয়েছেন ইউজিসির একাধিক কর্মকর্তা। তাদের সাথে ছিলেন ইউজিসির অফিস সহায়ক; খোকন খান নামের ওই অফিস সহায়ক কমিশন বন্ধের দিনে এক নারীকে নিয়ে প্রতিষ্ঠানটির ল্যাবে দুই ঘণ্টারও বেশি অবস্থান করার সময় হাতেনাতে ধরা পরেন। পরবর্তীতে এ অপরাধে তাঁর ইনক্রিমেন্ট আটকে রাখার আদেশ জারি করা হয়। আজ ছাত্রদলের নেতাদের চাপের মুখে সে আদেশও তুলে নিতে বাধ্য হন ইউজিসির বর্তমান দায়িত্বপ্রাপ্তরা।

এছাড়াও তাদের সাথে ছিলেন—ইউজিসির ইনফরমেশন ম্যানেজমেন্ট, কমিউনিকেশন এবং ট্রেনিং বিভাগের উপ-পরিচালক মোহাম্মদ মনির উল্লাহ, প্রশাসন বিভাগের সহকারী সচিব মোহাম্মদ মামুনুর রশিদ খান, পরিকল্পনা ও উন্নয়ন বিভাগের উপ-পরিচালক আকরাম আলী খানসহ রিসার্চ সাপোর্ট এন্ড পাবলিকেশন ডিভিশনের আরও এক কর্মকর্তা।

দুপুর ২ টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের সচিব হিসেবে নিয়োগ পান ইউজিসির রিসার্চ অ্যান্ড পাবলিকেশন ডিভিশনের ডিরেক্টর ড. ফখরুল ইসলাম। তিনি আওয়ামীপন্থি হিসেবে পরিচিত এবং বিগত দিনগুলোতে সরকারের পক্ষে বিভিন্ন গণমাধ্যমে লেখালেখি করেছেন।

নাম-পরিচয় না করার শর্তে ইউজিসির কর্মকর্তারা জানান, মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে ইউজিসির কর্মকর্তাদের সাথে যোগ সাজোশ করেন ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা। তাদের সাথে সম্পৃক্ত কর্মকর্তারা ইউজিসির এ বড় ধরনের রদবদলের চেষ্টা সহায়তা করেছেন এবং ১৯ জন কর্মকর্তাকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য তালিকা করেছেন।

এর আগে দুপুরে ইউজিসিতে নিজ কক্ষে অবরুদ্ধ করা হয় কমিশনের বর্তমান ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আলমগীরকে। তাঁকে রুমে আটকিয়ে কমিশনের বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পদে রদবদলের চেষ্টা করেন ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা। কমিশনের মধ্যে বড় ধরনের রদবদলের চেষ্টায় অধ্যাপক ড. মো. আলমগীর রাজি না হলে পরবর্তীতে তারা কমিশনের সচিবকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য চাপ দেন এবং তা করার পর ছাত্রদলের নেতারা কমিশন ত্যাগ করেন।

আরও পড়ুন: উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়নে ডজন খানেক সুপারিশ ইউজিসির

এছাড়াও ইউজিসির আরও বেশ কয়েকজন কর্মকর্তাকে সরানোর চেষ্টা করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছেন—ইউজিসির বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শাখার ডিরেক্টর ওমর ফারুখ, শীবানন্দ শীল, গোলাম দস্তগীর, নাহিদ সুলতানা, ইউসুফ আলী খান, মো. মামুনসহ মোট ১৯ কর্মকর্তা। শুরুতে তাদের ওএসডি করানোর চাপ থাকলেও পরবর্তীতে ইউজিসির চেয়ারম্যান রাজি না হওয়ায় তাদের অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরে বদলির চেষ্টা করা হয়। কিন্তু, সেখানে ইউজিসি বর্তমান ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মো. আলমগীর স্বাক্ষর না করায়—এ পরিবর্তন সম্ভব হয়নি। 

অভিযুক্ত ছাত্রদলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মওদুদ আহমেদ। ছবি: সামাজিক মাধ্যম থেকে সংগৃহীত।

নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে ইউজিসির একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় নেতা পরিচয় দিয়ে ইউজিসির অফিস সহায়ক খোকন এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শাখার উপ-পরিচালক ড. মো. মহিবুল আহসান এতে নেতৃত্ব প্রদান করেন। পরবর্তীতে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ছাত্রদলের ওই নেতার নাম মওদুদ আহমেদ। তিনি সর্বশেষ কমিটিতে সংগঠনটির কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হিসেবে পদপ্রাপ্ত হয়েছেন। ইউজিসির এক কর্মকর্তার চায়ের দাওয়াতে তিনি সেখানে গিয়েছেন বলে দাবি করেছেন ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সভাপতি রাকিবুল ইসলাম রাকিব।

অভিযুক্ত ছাত্রদলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মওদুদ আহমেদ এবং ইউজিসির বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শাখার উপ-পরিচালক ড. মহিবুল আহসান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) সাবেক শিক্ষার্থী ও কবি জসীমউদ্দীন হলের ছাত্র। সে সুবাদে তাদের পরিচয় এবং সে পরিচয়কে কাজে লাগিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ড. মহিবুল আহসান কমিশনের গুরুত্বপূর্ণ পদে আসতে চান। সেজন্য তিনি ছাত্রদলের নেতাকর্মীদের নিয়ে কমিশনে এসব করছেন।

আরও পড়ুন: একক ভর্তি পরীক্ষা: ঢাবি-বুয়েটসহ ১০ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিদের নিয়ে কমিটি, নেতৃত্বে ইউজিসি

বিষয়টি নিয়ে জানতে কথা হয় ইউজিসির অভিযুক্ত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শাখার বর্তমান উপ-পরিচালক ড. মহিবুল আহসানের সাথে। তিনি দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, তিনি এসব কাজের সাথে কোনোভাবেই জড়িত নন এবং ওই ছাত্রদল নেতাদের সাথে তার কোনো যোগাযোগ বা পরিচয় নেই। উল্টো ছাত্রদলের পরিচয় প্রদানকারী নেতারা তাঁকে দুই ঘণ্টারও বেশি সময় আটকে হয়রানি করেছেন বলেও অভিযোগ জানান তিনি। তিনি বলেন, তারা আমার ফোন নিয়ে যায় এবং আমাকে নানা ধরনের হুমকির পাশাপাশি শাসাতে থাকেন।

এছাড়াও বাকী অভিযুক্ত ইউজিসি কর্মকর্তাদের কমিশনের ইনফরমেশন ম্যানেজমেন্ট, কমিউনিকেশন এবং ট্রেনিং বিভাগের উপ-পরিচালক মোহাম্মদ মনির উল্লাহ এবং প্রশাসন বিভাগের সহকারী সচিব মোহাম্মদ মামুনুর রশিদ খান ও পরিকল্পনা ও উন্নয়ন বিভাগের উপ-পরিচালক আকরাম আলী খান দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে জানিয়েছেন, তারা এর সাথে জড়িত নন। এ রকম কোনো ঘটনা ঘটেনি এবং এসবের সাথে তাদের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। এর বাইরে ইউজিসির রিসার্চ সাপোর্ট এন্ড পাবলিকেশন ডিভিশনের অভিযুক্ত কর্মকর্তার সাথে বিভিন্ন মাধ্যমে চেষ্টা করেও তাদের কোনো বক্তব্য পাওয়া সম্ভব হয়নি।

ইউজিসির বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শাখার ডিরেক্টর ওমর ফারুখ, শীবানন্দ শীল, গোলাম দস্তগীর, নাহিদ সুলতানা, ইউসুফ আলী খান, মো. মামুনসহ মোট ১৯ কর্মকর্তাকে সরানোর চেষ্টা করা হয়েছে।

একই বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে ছাত্রদলের অভিযুক্ত যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মওদুদ আহমেদের সাথে। তিনি দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে জানান, সেখানে তারা কিছু করেননি। ইউজিসির ভেতরে হট্টগোল হলে তারা তা দেখতে ভেতরে যান এবং বেরিয়ে আসেন। কাউকে শাসানো বা জোর করে স্বাক্ষর নিয়ে রদবদলের জন্য তারা কিছু করেননি।

তবে ভিন্ন বক্তব্য পাওয়া গেছে সংগঠনটির শীর্ষ নেতার বক্তব্যে। বিষয়টি ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সভাপতি মো. রাকিবুল ইসলাম রাকিবের নজরে আনা হলে তিনি বিষয়টি অবগত আছেন জানিয়ে দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, মওদুদ ইউজিসির এক কর্মকর্তার দাওয়াতে সেখানে চা খেতে গিয়েছেন। ওই কর্মকর্তা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং মওদুদের সিনিয়র বলেও জানিয়েছেন তিনি।

আরও পড়ুন: একক ভর্তি পরীক্ষা: ইউজিসির সুপারিশ যাচাই-বাছাই করছে মন্ত্রণালয়

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি তা অস্বীকার করে বলেন, ইউজিসিতে সাধারণ শিক্ষার্থীরা রদবদল চাচ্ছেন এবং সেজন্য আন্দোলন হয়েছে। সেখানে এককভাবে ছাত্রদলের নেতাদের দোষারোপ না করারও আহ্বান জানান তিনি। একই সাথে তিনি পুরোনো দিনে ছাত্রদলের নেতাকর্মীদের নির্যাতনের কথাও তুলে ধরেন। তিনি বলেন, আপনারা অভিযোগের বিষয়ে না লিখে—মওদুদ ঢাবিতে থাকাকালে নির্যাতিত এবং হামলা-মামলার শিকার হয়েছেন, তা নিয়ে কতটুকু লিখা হয়েছে, সে বিষয়ে প্রশ্ন তোলেন।

একই বিষয়ে জানতে চাইলে ইউজিসির বর্তমান ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আলমগীর দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, আমাদের সচিবের পদে রদবদল করা হয়েছে। এটি কমিশনের নিয়মিত বিষয়। প্রতিদিনের কার্যাবলির অংশ হিসেবে এটি করা হয়েছে।  


সর্বশেষ সংবাদ