জেদ থেকে সফল ফ্রিল্যান্সার অনন্যা
- সুজন চন্দ্র দাস
- প্রকাশ: ১৩ এপ্রিল ২০২৫, ০৫:০২ PM , আপডেট: ১৩ এপ্রিল ২০২৫, ০৬:০১ PM

ময়মনসিংহ শহরে বাস করেন অনন্যা রায়। তিনি একসময় স্বপ্ন দেখতেন চিকিৎসক হওয়ার। কিন্তু মেডিকেলে ভর্তির আশানুরূপ ফল না পাওয়ায় সে স্বপ্ন পূরণ হয়নি। তবে জীবনে সফল হতে জেদ ধরেন তিনি। নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে এখন তিনি একজন সফল ফ্রিল্যান্সার, প্রশিক্ষক এবং নারীদের আত্মবিশ্বাসী করে গড়ে তোলার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তিনি দেশের তরুণদের কাছে অনুপ্রেরণার প্রতীক। তার সাফল্যের গল্প তুলে ধরেছেন দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসের প্রতিনিধি সুজন চন্দ্র দাস।
অনন্যার জন্ম ও বেড়ে ওঠা ময়মনসিংহ শহরে। বাবা জুয়েল রায় একটি ছোট্ট প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন, বর্তমানে তিনি অবসরে। মা মুক্তা রায় গৃহিণী। ছোট বোন বর্তমানে ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন।
২০১৭ সালে প্রিমিয়ার আইডিয়াল হাইস্কুল থেকে এসএসসি ও ২০১৯ সালে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন অনন্যা। বর্তমানে তিনি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করছেন।
শৈশব থেকেই অনন্যার স্বপ্ন ছিল চিকিৎসক হওয়ার। কিন্তু মেডিকেলে ভর্তির আশানুরূপ ফল না পাওয়ায় সে স্বপ্ন পূরণ হয়নি। আত্মীয়স্বজন ও আশপাশের মানুষের কটাক্ষ, ব্যর্থতার চাপ—সব মিলিয়ে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন তিনি। এর মধ্যেই আসে করোনা মহামারি, রাতগুলো হয়ে ওঠে নিঃসঙ্গ ও আতঙ্কময়। তবে জীবনে সফল হতে জেদ ধরেন তিনি।
আরও পড়ুন: ৪৭তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি পরীক্ষার নতুন তারিখ ঘোষণা
ঠিক তখনই ছোট বোনের একটি অনুরোধ তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। ‘দিদি, ফ্রিল্যান্সিং করে মানুষ অনেক ভালো করছে, তুমি তো পারবে,’—এই কথাটি ছিল অনন্যার জীবনের এক নতুন সূচনার সুর। জানতেন না ফ্রিল্যান্সিং কী, কিন্তু শুরু করলেন শিখতে। পাশে ছিলেন তার মা-বাবা ও ছোট বোন।
অনন্যা বলেন, ‘আমার মা সব সময় চাইতেন মেয়েরা মানুষের মতো মানুষ হোক। মা-ই আমাকে শিখিয়েছেন কীভাবে লড়াই করে বাঁচতে হয়।’
শুরুর দিকে ছিল অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতা। ল্যাপটপ কেনার সামর্থ্য ছিল না। তখন তার দিদিমা এগিয়ে এসে হয়ে উঠেন স্বপ্নপূরণের সহযাত্রী। কঠোর পরিশ্রম, অধ্যবসায় ও আত্মবিশ্বাসকে সঙ্গী করে ধীরে ধীরে দক্ষ হয়ে উঠেন অনন্যা।
তার প্রথম আয় ছিল মাত্র ২৫ ডলার। সেই টাকাতেই মা, দিদিমা ও বোনকে শাড়ি উপহার দিয়েছিলেন ভালোবাসার প্রথম ছোঁয়া। ‘সেই অনুভূতি আজও আমার কাছে সবচেয়ে স্পেশাল’ বলেন অনন্যা।
পাঁচ শতাধিক শিক্ষার্থীকে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন অনন্যা রায়, যাদের অনেকেই এখন সফল ফ্রিল্যান্সার ও উদ্যোক্তা
এরপর আর পেছনে তাকাতে হয়নি। বড় বড় আন্তর্জাতিক প্রজেক্টে কাজ করেছেন, ক্লায়েন্টদের প্রশংসা পেয়েছেন বারবার। সরকারি প্রকল্প ‘Do-ICT’তেও যুক্ত ছিলেন সফলভাবে। কখনো লাখ টাকাও আয় করেছেন।
আজ তিনি একজন প্রশিক্ষক হিসেবে পাঁচ শতাধিক শিক্ষার্থীকে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন, যাদের অনেকেই এখন সফল ফ্রিল্যান্সার ও উদ্যোক্তা।
অনন্যা বলেন, ‘লার্নাররা যখন এসে বলে—আপু, আমি এখন নিজের পায়ে দাঁড়াতে পেরেছি, তখন সেটাই আমার জীবনের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি মনে হয়। অনেকেই আমাকে ছোট ছোট উপহার দেয়, যা আমার কাছে অমূল্য।’
সেই সঙ্গে অনন্যা বলেন, ‘প্রথমে আশপাশের অনেকেই সন্দেহের চোখে দেখত, মেয়েরা এসব করে—এ কথাও শুনেছি। ঘরে বসে টাকা আয় করা যায়, এটা বিশ্বাস করত না অনেকে। মা-বাবাও সমাজের অনেক কটূক্তি সহ্য করেছেন। তবে আমার জেদ ছিল সফল হব। আজ মা-বাবা আমাকে নিয়ে গর্ব করেন।’
আরও পড়ুন: ‘স্বৈরাচারের প্রতিকৃতিতে’ আগুন: সন্দেহভাজনের তালিকায় ঢাবির আরবি বিভাগের শিক্ষার্থী
বর্তমানে অনন্যা অনেক প্রতিষ্ঠানে আইটি এক্সপার্ট ও মেন্টর হিসেবে যুক্ত আছেন। নারী শিক্ষার্থীদের আত্মবিশ্বাসী করে তুলতেই তার বিশেষ মনোযোগ। তার প্রতি লার্নারদের ভালোবাসা ও সম্মানই আজ তার মূল শক্তি। ‘যখন ভাবতাম আর কিছুই সম্ভব নয়, তখনই আশপাশের মানুষের ভালোবাসা আমাকে নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শিখিয়েছে,’ বলেন অনন্যা।
বর্তমানে লেখালেখি, পারিবারিক সময় এবং নিজের দক্ষতা বাড়ানো নিয়েই ব্যস্ত সময় পার করছেন তিনি।
নতুনদের উদ্দেশ্যে অনন্যার পরামর্শ— ‘আত্মবিশ্বাস, ধৈর্য আর ইচ্ছাশক্তি থাকলে সফলতা কেবল সময়ের ব্যাপার। নিজের ওপর বিশ্বাস রাখো, পথ খুঁজে পাবে।’
অনন্যার মা মুক্তা রায় বলেন, ‘আমার মেয়ে ছোটবেলা থেকেই পরিশ্রমী। জীবনের নানা চ্যালেঞ্জ এসেছে, কিন্তু সে কখনো থেমে যায়নি। নিজের লক্ষ্যে পৌঁছাতে প্রতিনিয়ত চেষ্টা করে যাচ্ছে। একজন মা হিসেবে আমি গর্বিত।’
আরও পড়ুন: রাজনৈতিক দলগুলোর বিজ্ঞপ্তিতে অসংগতি ও ভুল বানানের ছড়াছড়ি
তিনি আরও বলেন, ‘আমি ওর কষ্টের সময়গুলো খুব কাছ থেকে দেখেছি। আত্মবিশ্বাস আর ইচ্ছাশক্তির জোরেই সে লড়াই করেছে। আজ সে শুধু নিজেই নয়, আরও হাজারো মানুষকে দক্ষ করে তুলছে। এমন মেয়ে ঘরে ঘরে থাকুক।’
অনন্যা রায়ের গল্প কেবল একজন ফ্রিল্যান্সারের সাফল্য নয়, এটি একজন নারীর আত্মবিশ্বাস, দৃঢ়তা ও অসম্ভবকে সম্ভব করে তোলার অনন্য উদাহরণ।