ফিফা বিশ্বকাপের আলোচিত যত ঘটনা
- টিডিসি স্পোর্টস
- প্রকাশ: ২০ নভেম্বর ২০২২, ১০:৩৬ AM , আপডেট: ২০ নভেম্বর ২০২২, ১০:৩৬ AM
ইতিহাসে প্রথমবারের মতো মুসলিম দেশ কাতারে আজ থেকে শুরু হতে যাচ্ছে ২২তম ফিফা বিশ্বকাপ। ফুটবলের এই মহারণকে সামনে রেখে সারা বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশও এখন বিশ্বকাপ জ্বরে কাঁপছে। বাড়ির ছাদে, উঠানে লম্বা খুঁটি পুঁতে প্রিয় দেশের পতাকা উড়িয়ে উন্মাদনায় মেতেছেন ফুটবলপ্রেমীরা।
রাজধানীসহ সারা দেশের সমর্থকরা নিজ নিজ দলের বিশাল বিশাল পতাকার রেকর্ড গড়ে সংবাদের শিরোনাম হওয়ার প্রতিযোগিতায় নেমেছেন। ফুটবলে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী দুই দল ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনা ভক্তরা ইতোমধ্যেই ফেসবুকে একে অপরের সমালোচনায় মুখর হয়ে উঠেছেন। পাড়া-মহল্লার চায়ের দোকানে চলছে বাকযুদ্ধ।
বিখ্যাত পূর্বের ফুটবল আসরগুলো নানা ঘটনা বা দুর্ঘটনায় পরিপূর্ণ। আর এসব ঘটনা ঘটাও অনেকটাই স্বাভাবিক। বিগত আসরগুলোতে ঘটে গেছে বিতর্কিত নানান ঘটনা। যার সাথে জড়িত ছিলেন খেলোয়াড়, রেফারি, কর্মকর্তাসহ কোনো কোনো দেশের রাষ্ট্রপ্রধানও।
জেনে নেয়া যাক তেমন কয়েকটি আলোচিত ঘটনা।
বাছাইপর্ববিহীন বিশ্বকাপ
১৯৩০ সালে উরুগুয়েতে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপ কোনো বাছাইপর্ব ছিল না। ফিফা প্রায় সব দেশকেই সেখানে খেলার আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। কিন্তু অর্থনৈতিক দুরবস্থা ও আটলান্টিক মহাসাগর পাড়ি দিয়ে লাতিন দেশ উরুগুয়েতে যাওয়া এড়াতে সেই বিশ্বকাপ নিয়ে কোনো আগ্রহই দেখায়নি গোটা ইউরোপ। পারে ফিফা সভাপতি জুলেরিমের হস্তক্ষেপে এন্ট্রি দেওয়ার শেষ দিনে বিশ্বকাপে নাম লেখায় ফ্রান্স, বেলজিয়াম, যুগোশ্লাভিয়া ও রোমানিয়া।
বিশ্বকাপ না খেলেই দেশে
প্রথম বিশ্বকাপকে অনেকটা ভ্রমণ হিসেবে নিয়েছেন অংশগ্রহণকারী দেশগুলো। এটির গুরুত্ব তাদের কাছে কতটা কম ছিল, সেটা বোঝা যায় আর্জেন্টিনা দলের অধিনায়ক ম্যানুয়েল ফেইরারের একটি কান্ডে। তিনি ছিলেন আইনের ছাত্র। গ্রুপপর্বের দুটি ম্যাচ খেলেই তিনি দেশে ফিরে যান কারণ তার পরীক্ষা ছিলো।
আরও পড়ুন: ৯ দশকে ফুটবল বিশ্বকাপে বৈচিত্র্যময় যত বল।
ইতালির শাসক যখন রেফারি নির্বাচক
দ্বিতীয় বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হয় ১৯৩৪ সালে—ইতালিতে। দেশটিতে তখন স্বৈরশাসক বেনিতো মুসোলিনির ফ্যাসিবাদী শাসন। মুসোলিনির কারণেই দ্বিতীয় বিশ্বকাপে নানা বিতর্কের সৃষ্টি হয়। কথিত আছে, ইতালির শাসক নাকি বিশ্বকাপে ইতালির ম্যাচগুলোর রেফারি নিজে নির্বাচিত করতেন। অনেকেই বলেন, তার প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপের কারণেই ইতালি সে বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন হয়।
বিশ্বকাপ খেলতে ভারতের অস্বীকৃতি
১৯৩৮ সালের পর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে ১৯৪২ ও ১৯৪৬ সালে মাঠে গড়াতে পারেনি বিশ্বকাপ। ১৯৫০ সালে ব্রাজিলে অনুষ্ঠিত হয় চতুর্থ বিশ্বকাপ। সেখানে অংশ নেয় ১৬টি দল। সেবারই প্রথম বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ পায় ভারত। কিন্তু সে সময় অল ইন্ডিয়া ফুটবল ফেডারেশন (এআইএফএ) সে সুযোগ গ্রহণ করেনি। অনেকেই বলেন, ভারত নাকি সে বিশ্বকাপে খালি পায়ে খেলতে চেয়েছিল। ফিফা সেটি দেয়নি বলেই ভারত দল পাঠায়নি।
মারাকানা ট্র্যাজেডি
১৯৫০ বিশ্বকাপের ফাইনালে মুখোমুখি হয়েছিল ব্রাজিল ও উরুগুয়ে। ম্যাচটি ড্র করলেই শিরোপা নিশ্চিত হতো ব্রাজিলের। বিশ্বকাপ জয়ের ব্যাপারে ব্রাজিল এতটাই আশাবাদী ছিল যে ফাইনালের দিন ব্রাজিলীয় দৈনিক ‘ও মুন্দো’ ব্রাজিল দলের একটা ছবি ছাপিয়ে শিরোনাম দিয়েছিল, ‘এরাই হলো বিশ্বচ্যাম্পিয়ন!’ এই পত্রিকার অনেকগুলো সংখ্যা কিনে উরুগুয়ে অধিনায়ক ওবদুলিও ভ্যারেলা নিজেদের হোটেল রুমের টয়লেটে নিয়ে ফেলেছিলেন।
সতীর্থদের বলেছিলেন পত্রিকাগুলোর কপিতে প্রস্রাব করতে! দলের আত্মবিশ্বাস তুলে ধরতেই ভ্যারেলা এমনটি বলেছিলেন। ফাইনালে লাখো স্বাগতিক দর্শকের সামনে এই উরুগুয়ে ২-১ গোলে ব্রাজিলকে হারিয়ে উৎসব করেছিল। ব্রাজিলিয়ানরা এ ঘটনায় এতটাই মুষড়ে পড়েছিল যে ফাইনালের পর মারাকানা স্টেডিয়ামের ছাদ থেকে লাফ দিয়ে দর্শকদের আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে। পর্তুগিজ ভাষায় এই ট্র্যাজেডি ‘মারাকানাজো’ নামে কুখ্যাত।
দুইবার ট্রফি চুরি
প্রথমবার: ১৯৬৬ সালের ফিফা ফুটবল বিশ্বকাপের আর মাত্র ৪ মাস বাকি! ওয়েস্ট মিনিস্টারের সেন্ট্রাল হলে ২৪ ঘণ্টার কড়া পাহারার পরেও ২০ মার্চ, ১৯৬৬ সালে জুলে রিমে কাপ চুরি হয়ে যায়, যা সারা বিশ্বে তোলপাড় ফেলে দিয়েছিল। লন্ডনের পুলিশ বাহিনী চোরের খোঁজে তখনকার সময়ে ১৫ হাজার পাউন্ডের পুরস্কারের ঘোষণা দিয়েছিল।
আরও পড়ুন: মরুর বুকে আজ থেকে শ্রেষ্ঠত্বের লড়াইয়ে নামছে ৩২ দল।
বিশ্বকাপের আগে জুলে রিমে কাপ উদ্ধার করা যাবে না এই ভয়ে ব্রিটিশরা তড়িঘড়ি করে আরেকটি রেপ্লিকা কাপ তৈরি করার ব্যবস্থা করে। পিকেলস নামের একটি কুকুর সেবার ইংল্যান্ডের মান ইজ্জত বাঁচাতে অবদান রাখে। চুরির এক সপ্তাহ পরে পিকেলস কুকুর লন্ডনের এক বাগানে খবরের কাগজে মোড়া অবস্থায় ট্রফিটি উদ্ধার করে।
দ্বিতীয়বার: ১৯৭০ সালে ব্রাজিল তৃতীয়বারের মতো বিশ্বকাপ জিতলে ট্রফিটি স্থায়ীভাবে তাদের দিয়ে দেয়া হয়। কিন্তু ট্রফিটি আগলে রাখতে ব্যর্থ হয় ব্রাজিল। ১৯৮৩ সালে ব্রাজিল ফুটবল ফেডারেশনের অফিস থেকে ট্রফিটি চুরি হয়ে যায়।
রিও ডি জেনেরিওতে ব্রাজিলিয়ান ফুটবল কনফেডারেশনের অফিসে ছিল জুলে রিমে ট্রফি। ভবনটির তৃতীয় তলায় ছিল ট্রফিটি। ১৯-২০ ডিসেম্বর রাতের বেলায় ভবনটিতে প্রবেশ করে বুলেটপ্রুফ কাচে ঘেরা শোকেসে রাখা ট্রফিটি নিয়ে মুহূর্তে রাতের অন্ধকারে হাওয়া হয়ে যায় চোরের দল। সেই সঙ্গে চিরদিনের জন্য হারিয়ে যায় ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম মূল্যবান ট্রফি।
চুরির জন্য ৪ জন মানুষকে দোষী সাব্যস্ত করা হলেও কাপটি আর কখনও খুঁজে পাওয়া যায়নি। এখন পর্যন্ত কেউ জানে না যে সেই আসল কাপটির মূলত কি হয়েছিল। লোকমুখে এমন শোনা যায় যে এটিকে গলিয়ে বিক্রি করা হয়েছে অথবা কোনো ধনকুবেরের ব্যক্তিগত কালেকশনে এটির ঠাঁই হয়েছে।
হ্যান্ডস অব গড
বিশ্বকাপ ফুটবলের অসংখ্য বিতর্কিত ঘটনার মধ্যে সম্ভবত এটিই সবচেয়ে বেশি মুখে মুখে ফেরে। ১৯৮৬ সালে মেক্সিকো বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে ইংল্যান্ড এবং আর্জেন্টিনার দ্বৈরথে প্রথমার্ধের খেলা গোলশূন্য থাকে। পরে দ্বিতীয়ার্ধের ৬ মিনিটের একবারের শেষের দিকে ইংলান্ডের ডি বক্সের ভিতরে উড়ে আসা বলকে হেড দিতে লাফিয়ে ওঠেন ম্যারাডোনা ও ইংলিশ গোলরক্ষক পিটার শিল্টন। কিন্তু হেড না করে ম্যারাডোনা কৌশলে হাত দিয়ে বলটি জালে জড়িয়ে দেন। রেফারি আল বিন নাসের তা ধরতে না পেরে গোলের বাঁশি বাজান এবং সেই গোলের সুবাদে ম্যাচটি শেষ পর্যন্ত ২-১ গোলে জিতে নেয় আর্জেন্টিনা।
ব্যাটল অব সান্তিয়াগো
বলা হয়ে থাকে বিশ্বকাপ ফুটবলের ইতিহাসে এটি সবচাইতে ন্যক্কারজনক ঘটনা। ঘটেছিল সান্তিয়াগোতে ১৯৬২ বিশ্বকাপে স্বাগতিক চিলি ও ইতালির ম্যাচে। ম্যাচটিতে সংঘর্ষের ঘটনা এত বেশি ছিলো যে শেষ পর্যন্ত যুদ্ধের খেতাব লাভ করে। তবে সূত্রপাত মাঠের ভেতরে নয়, বাইরে। দুই ইতালিয়ান সাংবাদিক তাদের সংবাদপত্রে প্রকাশ করেন যে ‘চিলিকে বিশ্বকাপ আয়োজন করতে দেওয়াটা পাগলামি ছাড়া কিছুই না। এখানে ফোন কাজ করে না, বিশ্বস্ত স্বামীর মতো ট্যাক্সিরও পর্যাপ্ত অভাব। এক শহরের ভেতর একটি চিঠি পৌঁছাতে সময় লাগে ৫ দিন। ’
এমন খবর দেখে গোটা চিলির জনগণ ক্ষোভে ফেটে পড়ে। ক্ষোভ এতটাই চরমে পৌঁছে যে, ইতালির সাংবাদিক ভেবে আর্জেন্টিনার এক সাংবাদিককে তারা পিটিয়ে আহত করে। ঘটনা ইতালিয়ান শিবিরে পৌঁছালে খেলা শুরুর ১২ সেকেন্ডের মধ্যেই ইতালির জর্জিও ফেরেনি ফাউল করেন। ১২ মিনিটে ফেরেনি আবার ফাউল করলে রেফারি অ্যাস্টন তাকে মাঠ থেকে বেরিয়ে যেতে বলেন। কিন্তু তিনি রেফারিকে পাত্তা না দিয়ে খেলা চালিয়ে যেতে থাকেন। পরে পুলিশ ঢুকে তাকে টেনে হিঁচড়ে বাইরে নিয়ে যায়। সমস্যার শেষ এখানে হলেই পারাতো। হয়নি, বরং ম্যাচের সময় যত গড়িয়েছে আরও কুৎসিৎ আকার ধারণ করেছে খেলাটি। চলেছে শেষ পর্যন্ত। কী না হয়েছে? লাথি, কিল, ঘুষি, যাচ্ছেতাই রকমের ফাউল, রেফারিকে হুমকি। শেষ পর্যন্ত চিলি ম্যাচটি ২-০ গোলে জিতলেও তাদের বেশ কয়েকজন খেলোয়াড়কে ম্যাচ শেষে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়।
এক খেলোয়াড়কে তিনবার হলুদ কার্ড
হলুদ কার্ডের হিসেব রাখতে না পারায় ২০০৬ সালে জার্মানি বিশ্বকাপে গ্রুপ পর্বে অস্ট্রেলিয়া এবং ক্রোয়েশিয়ার মধ্যকার ম্যাচে বড় ধরনের বিতর্কের জন্ম দেন ওই ম্যাচের রেফারি গ্রাহাম পুল। ক্রোয়েশিয়ার খেলোয়াড় জসিপ সিমুনিককে তিনি পরপর ২ বার কার্ড দেখালেও তাকে লাল কার্ড দেখিয়ে মাঠের বাইরে পাঠাননি। কারণ তিনি প্রথমবার জসিপ সিমুনিকে যে হলুদ কার্ডটি দেখিয়েছিলেন সেটা ভুলক্রমে ১ জন অস্ট্রেলিয়ান খেলোয়াড়ের নামে লিপিবদ্ধ করেন। ম্যাচে রেফারির মতের বিরোধিতার কারণে জসিপ সিমুনিক তৃতীয়বারের মতো রেফারি গ্রাহাম পুল হলুদ কার্ড দিয়ে মাঠ ছাড়া করেন। ম্যাচটি শেষ পর্যন্ত ২-২ গোলে ড্র হয়। এমন অপরিনামদর্শী কাণ্ডের পরে গ্রাহাম পুলকে আর কোনো বিশ্বকাপেই ম্যাচ পরিচালনা করতে দেওয়া হয়নি।