৭৬ দিয়ে শুরু, সর্বোচ্চ ২৬৯৬০২— দুই যুগে মাধ্যমিকে যত জিপিএ-৫

মাধ্যমিকের জিপিএ-৫
মাধ্যমিকের জিপিএ-৫  © টিডিসি ফটো

চলতি বছরের (২০২৪) মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট (এসএসসি) ও সমমানের পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে। রবিবার (১২ মে) প্রকাশিত ফল অনুযায়ী, এ বছর এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় পাসের হার ৮৩ দশমিক ০৪ শতাংশ। অংশগ্রহণকারী পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ২০ লাখ ১৩ হাজার ৫৯৭ জন। এরমধ্যে জিপিএ-৫ পেয়েছে ১ লাখ ৮২ হাজার ১২৯ জন।

দুই যুগ আগে ২০০১ সালে গ্রেডিং পদ্ধতি চালুর প্রথম বছর জিপিএ-৫ পায় মাত্র ৭৬ জন শিক্ষার্থী। ধারাবাহিকভাবে জিপিএ-৫ এর সংখ্যা প্রতিবছর বাড়তে শুরু করে। গত ২৪ বছরে এ সংখ্যাটা কয়েক হাজার গুণ পর্যন্ত বেড়েছে।

সনাতন পদ্ধতির ফলাফলে এসএসসির সর্বোচ্চ সাফল্য বলে বিবেচিত হতো স্টার মার্কস। আর গ্রেডিং পদ্ধতিতে সর্বোচ্চ জিপিএ-৫-কে বিবেচনা করা হয়। এই সর্বোচ্চ সাফল্য অর্জন বা জিপিএ-৫ লাভের ঘটনা ২০২২ সালে ছিল রেকর্ডসংখ্যক। পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য শিক্ষার্থীরা আড়াই বছর সময় পাওয়ায় পাশাপাশি এ বছর সংক্ষিপ্ত সিলেবাস ও প্রশ্নপত্রে একাধিক অপশন থাকায় এই বছর রেকর্ডসংখ্যক জিপিএ-৫ পায়। ওই বছর মাধ্যমিকে জিপিএ-৫ পায় ২ লাখ ৬৯ হাজার ৬০২ জন।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, বাংলাদেশে ২০০১ সাল থেকে গ্রেডিং পদ্ধতি চালু এ পর্যন্ত মাধ্যমিকে জিপিএ-৫ পেয়েছে ২০ লাখ ৯১ হাজার ১৮৬ জন শিক্ষার্থী। আগামীতে নতুন শিক্ষাক্রম পুরোপুরিভাবে চালু হলে থাকছে না এই গ্রেডিং পদ্ধতি। এর পরিবর্তে এসএসসি-এইচএসসিতে শিক্ষার্থীদের মেধা মূল্যায়নে ব্যবহার হবে পারফরম্যান্স ‘ইনডিকেটর’, অর্থাৎ বিশেষ পারদর্শিতার ‘চিহ্ন’। ২০২৬ সালের এসএসসি পরীক্ষার্থীদের দিয়ে এ প্রক্রিয়ায় মূল্যায়ন শুরু হবে বলে সরকার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে জানা গেছে।

জানা যায়, ১৯৭১ সাল থেকেই বাংলাদেশের পাবলিক পরীক্ষায় অর্থাৎ এসএসসি ও এইচএসসিতে ডিভিশন পদ্ধতি ফল প্রকাশ করা হতো। ৬০০ নম্বর পেলে প্রথম বিভাগ, ৪৫০ নম্বরে দ্বিতীয় বিভাগ ও ৩৩০ নম্বরে তৃতীয় বিভাগ। ৭৫০ নম্বর পেলে দেওয়া হতো স্টার মার্ক। যারা স্টার মার্ক পেতো তাদের এলাকার মানুষরা একনজর দেখার জন্য ভিড় করতেন। মেধাবী শিক্ষার্থী হিসেবে সব জায়গায় আলাদা কদর করা হতো তাদের। ৮০ নম্বর পেলে তাকে বলা হতো লেটার মার্ক নম্বর।

প্রতি বোর্ডে সর্বোচ্চ নম্বর পাওয়া প্রথম ২০ জনকে আলাদাভাবে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হতো। সর্বোচ্চ নম্বরধারীদের বলা হতো স্ট্যান্ড করা শিক্ষার্থী। ভালো শিক্ষার্থীদের লক্ষ্যই থাকতো সেরাদের সেরা হওয়া। যারা স্ট্যান্ড করতো পরের দিন পত্রিকার প্রথম পাতায় বাবা-মা, শিক্ষকসহ শিক্ষার্থীর ছবি ছাপা হতো। ভালো ফল করার উপায় শিরোনামে ওই শিক্ষার্থীর সাক্ষাৎকারও ছাপতো পত্রিকাগুলো।

এসএসসি পরীক্ষায় গ্রেডিং পদ্ধতি চালু হয় ২০০১ সালে। আর ২০০৩ সালে এই পদ্ধতি চালু হয় এইচএসসি পরীক্ষায়। জাতি পরিচিত হতে শুরু করে জিপিএ পদ্ধতির সঙ্গে। এই পদ্ধতিতে শিক্ষাক্ষেত্রে বড় ধরনের কোনও পরিবর্তন আনা হয়নি। শুধু নম্বর দেওয়ার পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনা হয়। পরিবর্তন আনা হয় ফলাফলের প্রকাশ ভঙ্গিতে। ২০০১-এর আগে আশির ওপর নম্বর পেলে বলা হতো লেটার মার্কস আর ওই থেকে বলা হয় জিপিএ-৫।

শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, জীবনে সবকিছু পরিবর্তনশীল, আর দেশের শিক্ষাব্যবস্থাও এর বাইরে নয়। পাবলিক পরীক্ষায় এক সময় ডিভিশন ছিল আর এখন গ্রেডিং। নতুন শিক্ষাক্রমে হয়তো সেটি পরিবর্তন হবে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশেও তা হয়ে থাকে। তবে কেউ স্টার মার্ক পেল নাকি জিপিএ-৫ পেল, সেটি বড় করে না দেখে শিক্ষার্থী কি শিখল তা বড় করে দেখতে হবে সবাইকে। শিক্ষার্থীদের অসুস্থ প্রতিযোগিতা থেকে বের হয়ে শিক্ষা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর জন্য পরামর্শ দিয়েছেন তারা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক মো. খাইরুল ইসলাম বলেন, একসময় ডিভিশন ছিল আর এখন গ্রেডিং। আগামীতে নতুন কারিকুলামে হয়তো নতুন করে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন হতে পারে। শিক্ষা ব্যবস্থার পরিবর্তন শুধু এখানে না, বিশ্বের বিভিন্ন দেশেও হয়ে থাকে। অনেক কিছু পরিবর্তন হয়, সেটা স্বাভাবিক। কিন্তু সেটা সিস্টেমেটিক হচ্ছে কিনা সেটি দেখতে হবে।

তিনি বলেন, নতুন কারিকুলাম চালু হয়েছে। সেটার পেছনে তো একটি গবেষণা আছে। সেটি যদি পাবলিককে জানানো হতো এভাবে মূল্যায়ন করা হবে। তাহলে (নতুন কারিকুলাম ) সেটা নিয়ে প্রশ্ন উঠতো না, আর এটা নিয়ে শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের ভীতি কাজ করতো না। এখন সেটা শিক্ষার্থীর উপর প্রভাব পড়বে। পরিবর্তন ভালো, তবে সেটি গুছিয়ে করা দরকার।

অভিভাবক ঐক্য ফোরামের সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা মো. জিয়াউল কবির দুলু বলেন, আমাদের সময় মাধ্যমিকে প্রথম ডিভিশন অর্জন করলে বাড়ি বাড়ি শিক্ষার্থীদের দেখতে আসতো সবাই। এখন গ্রেডিং সিস্টেমে জিপিএ-৫ নিয়ে উন্মাদনা চলছে। অভিভাবকরা শিক্ষার্থীদের এতোটাই চাপে রাখেন যে, মাঝে মাঝে তা আত্মহত্যায় রূপ নেয়। কিন্তু ৮০+ নম্বর পেয়ে জিপিএ-৫ পেলেও অনেক শিক্ষার্থী ইংরেজিতে একটি বাক্য ঠিকঠাক লিখতে পারে না। এক সময় ডিভিশন ছিল আর এখন গ্রেডিং, আগামীতে হয়তো ত্রিভুজ, বৃত্ত ও চতুর্ভুজ পাবে শিক্ষার্থীরা।

শিক্ষাব্যবস্থায় সবচেয়ে আগে জরুরি নৈতিকতা ও মূল্যবোধের মন্তব্য করে তিনি বলেন, শিক্ষক-অভিভাবকরা তাদের শিক্ষার্থী ও সন্তানদের জিপিএ-৫ পাওয়ার দৌড়ে হারিয়ে যাচ্ছে তাদের নৈতিকতা ও মূল্যবোধ। এখান থেকে উত্তরণে শিক্ষা ব্যবস্থা জাতীয়করণ করতে হবে। পাশাপাশি নৈতিকতা ও মূল্যবোধের চর্চা বাড়াতে হবে। তা না হলে জিপিএ-৫ উন্মাদনা আগামীতে ভালো একটি জাতি উপহার দিতে পারবে না।

তথ্য মতে, ২০০১ সালে মোট পরীক্ষার্থী ছিল ৭ লাখ ৮৬ হাজার ২২০ জন। পাসের হার ছিল ৩৫.২২ শতাংশ। প্রথমবারের মতো জিপিএ-৫ পায় ৭৬ জন শিক্ষার্থী। ২০০২ সাল মোট পরীক্ষার্থী ছিল ১০ লাখ ৫ হাজার ৯৩৭ জন। ৪০.৬৬ শতাংশ ছিল পাসের হার। জিপিএ-৫ পায় ৩২৭ জন। ২০০৩ সালে মোট পরীক্ষার্থী ৯ লাখ ২১ হাজার ২৪ জন। পাসের হার ৩৫.৯১ শতাংশ। জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ১ হাজার ৩৮৯ জন।

২০০৪ সাল থেকে চতুর্থ বিষয়সহ নম্বর বণ্টন করা হয়। যে কারণে জিপিএ-৫ প্রাপ্ত শিক্ষার্থীর সংখ্যা এক লাফেই বেড়ে যায় প্রায় ৮ গুণ। ওই বছর পরীক্ষা দেওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ৭ লাখ ৫৬ হাজার ৩৮৭ জন। এরমধ্যে পাস করে ৪৮.০৩ শতাংশ। জিপিএ-৫ অর্জন করে ৮ হাজার ৫৯৭ জন।

২০০৫ সালে মোট পরীক্ষার্থী ৭ লাখ ৫১ হাজার ৪২১ জন। পাসের হার ৫২.৫৭ শতাংশ। আর জিপিএ-৫ পায় ১৫ হাজার ৬৪৯ জন। ২০০৬ সালে মোট পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ৭ লাখ ৮৪ হাজার ৮১৫ জন। ৫৯.৪৭ শতাংশ হচ্ছে পাসের হার। জিপিএ-৫ পায় ২৪ হাজার ৩৮৪ জন।

২০০৭ সালে মোট পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ৭ লাখ ৯২ হাজার ১৬৫ জন। পাসের হার ৫৭.৩৭ শতাংশ। জিপিএ-৫ পায় ২৫ হাজার ৭৩২ জন। ২০০৮ সালে মোট পরীক্ষার্থী ৭ লাখ ৪৩ হাজার ৬০৯ জন। এদের মধ্যে পাস করে ৭০.৮১ শতাংশ শিক্ষার্থী। জিপিএ-৫ অর্জন করে ৪১ হাজার ৯১৭ জন।

২০০৯ সালে মোট পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ৭ লাখ ৯৭ হাজার ৮৯১ জন। পাসের হার ৬৭.৪১ শতাংশ। জিপিএ-৫ পায় ৪৫ হাজার ৯৩৪ জন। ২০১০ সালে মোট পরীক্ষার্থী ৯ লাখ ১২ হাজার ৫৭৭ জন। পাসের হার ৭৮.৯১ শতাংশ। জিপিএ-৫ পায় ৫২ হাজার ১৩৪ জন। 

২০১১ সাল মোট পরীক্ষার্থী ৯ লাখ ৮৬ হাজার ৬৫০ জন, পাসের হার ৮২.১৬ শতাংশ। জিপিএ-৫ পেয়েছে ৬২ হাজার ২৪৪ জন। ২০১২ সালে পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ১০ লাখ ৪৮ হাজার ১৪৪ জন। পাসের হার ৮৬.৩৭ শতাংশ। জিপিএ-৫ পেয়েছে ৮২ হাজার ২১২ জন।

২০১৩ সালে পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ১২ লাখ ৯৭ হাজার ৩৪ জন। পাসের হার ৮৯.০৩ শতাংশ। জিপিএ-৫ পায় ৯১ হাজার ১২২ জন।

২০১৪ সাল মোট পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ১৪ লাখ ৩২ হাজার ৭২৭ জন। পাসের হার ৯১ দশমিক ৩৪ শতাংশ। জিপিএ-৫ পায় ১ লাখ ৪২ হাজার ২৭৬ জন শিক্ষার্থী। দেশে গ্রেডিং পদ্ধতিতে নম্বর দেওয়ার প্রচলন শুরু হওয়ার পর থেকে ২০১৪ সালেই সর্বোচ্চ সংখ্যক শিক্ষার্থী জিপিএ-৫ অর্জন করে। 

২০১৫ সালে মোট পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ১৪ লাখ ৭৩ হাজার ৫৯৪ জন। পাসের হার ৮৭ দশমিক ০৪ শতাংশ। জিপিএ-৫ পেয়েছে ১ লাখ ১১ হাজার ৯০১ জন। ২০১৬ সালে মোট পরীক্ষার্থী ছিল ১৩ লাখ ২৮৪ জন জন। পাসের হার ছিল ৮৮ দশমিক ৭০ শতাংশ। এ বছর জিপিএ-৫ পায় ১ লাখ ৯ হাজার ৭৬১ জন।

২০১৭ সালে মোট পরীক্ষার্থী ছিল ১৭ লাখ ৮১ হাজার ৯৬২ জন। আর পাস করেছিল ৮০ দশমিক ৩৫ শতাংশ শিক্ষার্থী। এরমধ্যে ১ লাখ ৪ হাজার ৭৬১ জন পায় জিপিএ-৫। 

২০১৮ সালে মোট পরীক্ষার্থী ছিল ২০ লাখ ২৬ হাজার ৫৭৪ জন। এতে ৭৭ দশমিক ৭৭ শতাংশ শিক্ষার্থী পাস করেছিল। এরমধ্যে ১ লাখ ১০ হাজার ৬২৯ জন পায় জিপিএ-৫। ২০১৯ সালে মোট পরীক্ষার্থী ছিল ২১ লাখ ২৭ হাজার ৮১৫ জন। আর পরীক্ষায় পাস করেছিল ৮২ দশমিক ২০ শতাংশ শিক্ষার্থী। এরমধ্যে ১ লাখ ৫ হাজার ৫৯৪ জন পায় জিপিএ-৫।

২০২০ সালে পাসের হার ছিল ৮২ দশমিক ৮৭ শতাংশ। মোট পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ২০ লাখ ৪০ হাজার ২৮ জন। এরমধ্যে জিপিএ-৫ পায় ১ লাখ ৩৫ হাজার ৮৯৮ জন। ২০২১ সালে পাসের হার ছিল ৯৩ দশমিক ৫৮ শতাংশ। মোট পরীক্ষার্থী ছিল ২২ লাখ ৪০ হাজার ৩৯৫ জন। এর মধ্যে ১ লাখ ৮৩ হাজার ৩৪০ জন জিপিএ-৫ পায়।

২০২২ এসএসসি ও সমমান পরীক্ষায় পাসের হার ছিল ৮৭ দশমিক ৪৪ শতাংশ। মোট পরীক্ষার্থী ছিল ১৯ লাখ ৯৪ হাজার ১৩৭ জন। আর জিপিএ-৫ পায় ২ লাখ ৬৯ হাজার ৬০২ জন। ২০২৩ সালে এসএসসি ও সমমান পরীক্ষায় পাসের হার ছিল ৮০ দশমিক ৩৯ শতাংশ। মোট পরীক্ষার্থী ছিল ২০ লাখ ৪১ হাজার ৪৫০ জন। আর জিপিএ-৫ পায় ১ লাখ ৮৩ হাজার ৫৭৮ জন পরীক্ষার্থী।


সর্বশেষ সংবাদ