প্রধান শিক্ষকের দুর্নীতিতে ভেঙে পড়েছে পাঠদান, অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ

প্রধান শিক্ষক হাফিজা খাতুন
প্রধান শিক্ষক হাফিজা খাতুন  © টিডিসি ফটো

প্রধান শিক্ষকের অনিয়ম, দুর্নীতি, অদক্ষতা ও একঘেয়েমিতে ভেঁঙ্গে পড়েছে মৌলভীবাজার হাফিজা খাতুন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের পাঠদান। লেখাপড়ার সুষ্ঠ পরিবেশ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন বিদ্যালয়ের এক হাজার মেয়ে শিক্ষার্থী। প্রধান শিক্ষক রাশেদা বেগম নিয়োগের পর থেকে বিদ্যালয়ের এমন চিত্র। একাধিক তদন্ত প্রতিবেদন, অডিট রিপোর্ট ও পরিদর্শন প্রতিবেদন এসেছে। এসব নথিপত্র, অভিভাবকদের বক্তব্য, বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটি ও বিদ্যালয়ের অধিকাংশ শিক্ষকদের অভিমত পর্যালোচনা করে দুর্নীতির এমন চিত্র পাওয়া যায়।

অনুসন্ধানে জানা যায়, পতিত স্বৈারাচারের দোসর প্রধান শিক্ষক রাশেদা বেগম নিয়োগের পর থেকেই শিক্ষার মানোন্নয়নের চেয়ে বিদ্যালয়ের অর্থ আত্মসাতে বেপরোয়া হয়ে উঠেন। অপেশাদার ভাবে পরিচালনা করছেন বিদ্যালয়। রশিদ ছাড়া মাসিক বেতন ও ভর্তি ফি আদায়, ভুয়া বিল ভাউচার, সাদা কাগজে টাকা উত্তোলন, তহবিল তছরুপ, বন্ধের দিনে শিক্ষার্থীদের টিফিনের নামে বিল উত্তোলন, রেজুলেশন-ক্যাশবুকে গড়মিল, খন্ডকালীন শিক্ষককের নামে আত্মীয়দের নিয়োগ, শিক্ষার্থীদের মারধর, শিক্ষকদের স্বাক্ষর জালসহ অভিযোগের অন্ত নেই ওই প্রধান শিক্ষককের বিরুদ্ধে। স্বৈরাচারের শাসন আমলে নেতাদের প্রভাব খাটিয়ে তিনি এসব অপকর্ম করেছেন। স্বৈরাচার পালানোর পরেও তার লাগাম টানতে পারছেন না কর্তৃপক্ষ। এখনও একই কায়দায় তিনি বিদ্যালয় পরিচালনা করে চলেছেন।

জানা যায়, ২০১৫ সালের ১ নভেম্বর প্রধান শিক্ষক হিসেবে বিদ্যালয়ে যোগদান করেন রাশেদা বেগম। তার নিয়োগ নিয়ে এখনও বিতর্ক শেষ হয়নি। তিনি যোগদানকালীন বিদ্যালয়ের ৩২ লক্ষ টাকার এফডিআর ছিল। ১০ বছরের ব্যবধানে বিদ্যালয়ে দিগুণ শিক্ষার্থী হয়েছে। শিক্ষার্থীদের বেতন ও ভর্তি ফি বাড়ানো হয়েছে। তখন বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী বিদ্যালয়ের পাঠদানের পরিবেশ এবং তাদের ফলাফল বেশ ভালো ছিল। 

গত ১০ বছরে রাশেদা বেগম বিদ্যালয়ে কাঠামো ভেঙ্গে চুরমার করেছেন। বিদ্যালয়ের এমন দুরবস্থা দেখে বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটি ও জেলা শিক্ষা অফিস ২০১৭ সালে পৃথক দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। তদন্তে ৬৮ লক্ষ ৫ হাজার ২’শ ৬৯ টাকার দুর্নীতি বেরিয়ে আসে। 

স্বৈরাচার পতনের পর অভিভাবক ও শিক্ষকদের আবেদনের প্রেক্ষিতে বিদ্যালয় পরিদর্শন করেন বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি ও অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মেহনাজ ফেরদৌস। পরিদর্শনকালে শিক্ষক-কর্মচারীর ছুটি, পরীক্ষার ফলাফল, বাজেট, স্টক, গার্ড ফাইল ও অভিভাবক সভা রেজিস্টার করা পাননি এবং অন্যান্য রেজিস্টার অনিয়মিত এবং সঠিকভাবে লিপিবদ্ধ পাননি। প্রতিষ্ঠান প্রধান দাপ্তরিক কাজে কর্মদক্ষ নয় বলেও তিনি পরিদর্শন প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন।

বিদ্যালয়ের এমন দুরবস্থা দেখে গত ১০ ফেব্রুয়ারী জেলা সমবায় কর্মকর্তাকে আহ্বায়ক করে ৪ সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করেন সভাপতি। তদন্ত কমিটি ১৯ ফেব্রুয়ারী বিদ্যালয়ে তদন্ত করতে গেলে তাদেরকে সহযোগিতা করা হয়নি বলে সভাপতিকে অবগত করেন কমিটির আহ্বায়ক। পরবর্তীতে তদন্ত কাজে সহযোগিতা না করায় ২৩ ফেব্রুয়ারী সভাপতি প্রধান শিক্ষককে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেন। প্রধান শিক্ষক নোটিশের জবাব না দিয়ে জেলা প্রশাসক, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক, তদন্ত  কমিটির আহ্বায়ক সহ ৭ জনকে আসামী করে মৌলভীবাজার আদালতে মামলা করেন। মামলায় উল্লেখ করেন, তিনি আশষ্কা করছেন বাদীরা তাকে বেআইনী ভাবে বরখাস্থ করতে পারে।  

এ বিষয়ে ৭ম শ্রেণীতে অধ্যায়নরত এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক মুজিবুর রহমান বলেন, ‘গাছের গুড়ি ঠিক থাকলে গাছ সঠিকভাবে দাঁড়াতে পারে। এ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করলে লেখাপড়ার এই হাল হতো না। প্রধান শিক্ষক অফিসে চেয়ারের হাতলে পা রেখে মোবাইল টিপেন।’

আরেক অভিভাবক বলেন, ‘প্রতিদিন ৮টি ক্লাসের মধ্যে মাত্র ১/২টি ক্লাস হয়। বিদ্যালয়ের পরিবেশ ও লেখাপড়ার অবস্থা খারাপ থাকায় বেশ কিছুদিন যাবত আমার মেয়েকে বিদ্যালয়ে দিচ্ছি না। কেন আমার মেয়ে বিদ্যালয়ে যাচ্ছে না, আজ পর্যন্ত ফোন দিয়ে কেউ খোঁজ নেননি। কিন্তু মাস শেষে ঠিকই বেতনের জন্য ফোন দেন।’

অভিভাবক ফটিক মিয়া বলেন, ‘আমার মেয়ে এবার এসএসসি পরীক্ষায় এক বিষয়ে অংশ গ্রহণ করবে। রেজিস্ট্রেশনের জন্য ১৫’শ টাকা দিয়েছি। রশিদ চাইলে আমাকে কোনো রশিদ দেয়া হয়নি। বিদ্যালয়ের লেখাপড়ার বিষয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, “এ বিদ্যালয়ে লেখাপড়া বলতে কিছু নেই। মেয়েরা বিদ্যালয়ে এসে সারাদিন বাহিরে ঘুরা ফেরা করে। চায়নিজ রেষ্টুরেন্টে বসে আড্ডা দেয়। আবার কেউ কেউ ছেলেদের সাথে সারাদিন ঘুরাফেরা করে বিকেলে বিদ্যালয় থেকে ব্যাগ নিয়ে বাড়িতে চলে যায়।” 

নাম গোপন রাখার শর্তে বিদ্যালয়ের ১০ জন সহকারী শিক্ষক জানান, প্রধান শিক্ষক রশিদ ছাড়া শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে বেতন, ভর্তি ফি ও রেজিস্ট্রেশনের টাকা নেন। এ টাকা বিদ্যালয়ের একাউন্টে জমা হয়নি। উনি যোগদানের সময় বিদ্যালয়ের ফান্ডে ৩২ লক্ষ টাকা ছিল। প্রধান শিক্ষক এসে বেতন ও ভর্তি দিগুণ করেন। শিক্ষার্থীও বেড়েছে। কিন্তু বিদ্যালয়ের ফান্ডে টাকা নেই। নামে বেনামে ভাউচার করে টাকা আত্মসাৎ করেছেন। শিক্ষকদের বিদ্যালয় থেকে দেয়া বেতন বৃদ্ধি করার জন্য আমরা কয়েক বছর যাবত আবেদন করে আসছি কিন্তু বাড়াচ্ছেন না। গত নভেম্বর মাসে বেতন না বাড়ানোয়ে আমরা বেতন বিলে স্বাক্ষর করিনি। 

তারা জানান, প্রধান শিক্ষক আমাদের বেতন বিলে জাল স্বাক্ষর করে সভাপতির কাছে জমা দেন। উনার চাহিদামতো কয়েকজন খন্ডকালীন শিক্ষক নিয়োগ দিয়েছেন। এরাও ১৫/২০ দিন পর এসে এক সাথে হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর করে। তাদের ক্লাসও আমাদের করাতে হয়। সাবেক সভাপতি পৌর মেয়র মো: ফজলুরর রহমান, প্রধান শিক্ষক এবং উনার অনুগত ৩ জন শিক্ষক সিন্ডিকেট করে বিদ্যালয়ের এই অবস্থা করেছেন। বিদ্যালয়ের ফলাফল ভালো না করে কীভাবে খারাপ করা যায় এ চিন্তা করতেন। শিক্ষকদের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করছেন। শিক্ষকরা যৌক্তিক কোনো কথা বললেই নেতাদের ভয় দেখাতেন।

এ বিষয়ে প্রধান শিক্ষক রাশেদা বেগম বলেন, ‘সভাপতি বিদ্যালয়ে এসে খাতাপত্র দেখতে চাইলে তখন তা অসম্পন্ন ছিল। পরবর্তীতে সকল শিক্ষকদের সাথে নিয়ে খাতাপত্র ঠিক করি। অফিস সহকারী সিমপ্যাথি দেখিয়ে বেতন বিলে স্বাক্ষর করে আমাকে অসম্মানিত করেছে। কিন্তু টাকা অফিস সহকারী কিংবা আমি নেইনি।’ 

২০১৬-১৭ অর্থ বছরের রিপোর্টের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘মাহমুদ কম্পিউটারের দোকানে বসে রিপোর্ট বানিয়েছে। জেলা শিক্ষা অফিসারের প্রতিনিধি মো: মুহিবুল হাসানের স্বাক্ষর জোরে নেয়া হয়েছে। যোগদানের এক বছরের মাথায় কীভাবে ৬৮ লক্ষ টাকা দুর্নীতি করতে পারি? আমাকে স্কুল থেকে বের করে দেয়ার চক্রান্ত করা হয়েছিল। শিক্ষকরা আমার বিরুদ্ধে যাওয়ার কারণ হল আগে বেতন হাতে হাতে নেয়া হতো। শিক্ষকরা জানুয়ারীতে টাকা তোলে ডিসেম্বরে জমা দিতেন। সুদে টাকা লাগিয়ে অনেক পয়সার মালিক হয়েছেন। বেতন অনলাইন করার পর তাদের এ ব্যবসা বন্ধ হয়ে যায়।’

সভাপতিকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, ‘আমার উপর আপনি কীভাবে তদন্ত করবেন। আপনি সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করেন। আমিও সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করব।’

জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো: ফজলুর রহমান বলেন, ‘শিক্ষকদের বেতন বৈষম্য নিরসনে আমাকে তদন্তের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। কিছু দিনের মধ্যে তদন্ত করে জমা দেব। তবে শিক্ষকদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের কারণে বিদ্যালয়ের এমন হাল।’ 

সভাপতি ও অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মেহনাজ ফেরদৌস বলেন, ‘দায়িত্ব নেয়ার পর বিদ্যালয় পরিচালনা করতে গিয়ে দেখি খুব দুরবস্থা। জেলা সদরের স্কুল এমন হতে পারে না। আয় ব্যয়ের কোনো ভারসাম্য নেই। রেজিস্ট্রার ও নথিপত্রি নেই। ফলাফল খুবই খারাপ। এগুলো সংশোধন করার জন্য প্রধান শিক্ষককে বলি। তিনি কিছু সংশোধনও করেন। আর্থিক স্বচ্ছলতা ও বিদ্যালয়কে এগিয়ে নিতে আমি একটি তদন্ত কমিটি করে দেই। তিনি সেই তদন্ত কমিটিকে সহযোগিতা না করে নিজের অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনা হতে বাঁচার জন্য জেলা প্রশাসক সহ ৭ জনের উপর মামলা করেন। বিগত সময়ে তিনি পতিত স্বৈরাচারের দোসরদের প্রভাব খাটিয়ে এমন করেছেন।’


সর্বশেষ সংবাদ