জুলাই গণঅভ্যুত্থান

শহীদ ওসমান ছাড়া পরিবারের ঈদ কেটেছে শুধুই কান্নায়

শহীদ ওসমান পাটোয়ারী
শহীদ ওসমান পাটোয়ারী  © ফাইল ফটো

২০২৪ সালের জুলাই গণঅভ্যুত্থানে বাংলাদেশের ইতিহাসে রক্তে লেখা এক অধ্যায়। এই বিপ্লবে যারা শহীদ হয়েছেন, তাঁদের মধ্যে একজন হলেন তা’মীরুল মিল্লাত কামিল মাদ্রাসা টঙ্গীর আলিম ২০২১ ব্যাচের মেধাবী শিক্ষার্থী লক্ষ্মীপুরের ওসমান পাটোয়ারী—এক তরুণ, এক স্বপ্নবাজ, এক সন্তানের অবিনশ্বর প্রতীক।

গুলিবিদ্ধ একটি বিকেল
৪ আগস্ট ২০২৪, বিকেল চারটা। লক্ষ্মীপুর শহর উত্তপ্ত। স্বৈরাচারবিরোধী বিক্ষোভে পুলিশের সহযোগিতায় কুখ্যাত সন্ত্রাসী টিপু ও তার দল গুলি চালায়। সেদিন গুলিবিদ্ধ হন ওসমান। তার শরীরে লেগেছিল ৫৫টি গুলি—এমনটাই জানায় প্রত্যক্ষদর্শীরা। ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান তিনি।

মায়ের বারবার নিষেধ সত্ত্বেও আন্দোলনে যাওয়া থেকে পিছিয়ে যাননি। তিনি বলতেন, শহীদের মর্যাদা অনেক বড়, শহীদের মায়ের মর্যাদা আরও বড়! বিপ্লবের আগের দিন মাকে শেষ চুমু দিয়ে বলেছিলেন, আমার কিছু হলে মাফ করে দিও।

শেষ ফোন কল ও নিস্তব্ধতা
ওসমানের বড় ভাই ওমর ফারুক ছিলেন চট্টগ্রামে। ঘটনার দিন দুপুরে দু’বার কথা হয়েছিল ভাইয়ের সঙ্গে। দ্বিতীয় ফোনে ওসমান বলেন— ভাইয়া, লক্ষ্মীপুরে একজন শহীদ হয়েছে। আমার জন্য চিন্তা কইরেন না, কিছু হলে মাফ করে দিয়েন।

বিকেলে আরেকবার কল করেছিলেন ভাই, কিন্তু রিসিভ করেছিল এক অপরিচিত কণ্ঠ, ওসমান আর দুনিয়ায় নেই। লক্ষ্মীপুর সদর হাসপাতালের মর্গে মরদেহ রাখা আছে, এসে নিয়ে যান।

শহীদের শেষ ইচ্ছে
ওসমান চেয়েছিলেন গোসল ছাড়াই দাফন হোক। পরিবার তার সেই ইচ্ছাকে মান্যতা দেয়। শিক্ষাজীবনে ছিলেন উজ্জ্বল, দাখিল ও আলিমে পেয়েছিলেন জিপিএ-৫। তার স্বপ্ন ছিল মদিনা ইউনিভার্সিটিতে পড়ার। তিনি বলতেন, আমার মৃত্যু হোক শহীদের মৃত্যু, যেন আল্লাহর পথে জীবন দিতে পারি।

এক অলৌকিকতা, মায়ের স্বপ্ন
শহীদ হওয়ার মাসখানেক পর ময়নাতদন্তের জন্য কবর খোঁড়া হয়। তখন দেখা যায়—ওসমানের মরদেহ একেবারে অক্ষত! উপস্থিত সবার চোখ ছলছল করে ওঠে।

মা এক রাতে স্বপ্নে দেখেন— ওসমান কল দিচ্ছে, আম্মু, আমি এখন মদিনা ইউনিভার্সিটির পেছনে আছি, দেখতে পাচ্ছো?—এ যেন স্বপ্ন অপূর্ণ থাকলেও প্রাপ্তি ছিল আধ্যাত্মিক।

পরিবারের ঈদ কেটেছে শুধুই কান্নায়
২০২৫ সালের রমজান ও ঈদ ছিল শহীদ ওসমানের পরিবারের জন্য এক নিঃসঙ্গ এবং রক্তক্ষরণে ভরা সময়। ঈদের চাঁদ যখন চারপাশে আনন্দ বয়ে আনছে, তখন ওসমানের পরিবারের শুধুই কান্নার শব্দ।

বড় ভাই ওমর ফারুক বলেন, ঈদের নামাজের আগের সেই ভোর, মাকে সালাম দিতে গিয়েছিলাম। কিন্তু মা হঠাৎ জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠেন— গত ঈদেও তো আমার দুই বাহুতে দুইটা পাখি ছিল, আজ কেন এই দিন দেখতে হলো? আমার আরেকটা পাখি নাই।

ঈদের নামাজ শেষে কোলাকুলি করার কথা ছিল ভাইয়ের সঙ্গে। কিন্তু এবার বুকটা খালি। কবরের পাশে দাঁড়িয়ে বলা হলো— ঈদ মোবারক, ভাই। চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়লো সেই কান্না, যে কান্নার শব্দ যেন পৌঁছে গেল আকাশ ছুঁয়ে।

শহীদ ওসমানের ভাই আরও বলেন, মনে হয় ভাই আমাকে শুনতে পায়। কবরের পাশে দাঁড়ালে শান্তি পাই।

বাবা মোহাম্মদ আব্দুর রহমান জানান, পড়াশোনার জন্য বকতাম, তাই স্বপ্নেও আমাকে দেখায় না। আমাদের পরিবারের শোক একার নয়— এটি একটি দেশের কান্না। শহীদেরা যে স্বপ্ন নিয়ে শহীদ হয়েছিলেন, সেই স্বপ্নের বাংলাদেশ এখনো অসম্পূর্ণ। 

সহপাঠীরা জানান, শহীদ ওসমান পাটোয়ারীসহ এই শহীদেরা রক্ত দিয়ে যে পতাকা আঁকেন, তার প্রতিটি রেখায় রয়েছে একটি মায়ের চোখের জল, একটি ভাইয়ের কান্না, একটি পরিবারের নিঃসঙ্গ ঈদ। সেই শোককে শক্তিতে পরিণত করতে না পারলে আমরা ইতিহাসের কাছে দায়মুক্ত হতে পারব না।


সর্বশেষ সংবাদ