কাগজে-কলমে দুই ডজনের বেশি সংগঠন ঢাকা কলেজে, নেই কার্যক্রম
- ওয়ালিদ হোসেন, ঢাকা কলেজ প্রতিনিধি
- প্রকাশ: ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৬:০৫ PM , আপডেট: ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৬:৫৬ PM

বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী সর্বপ্রাচীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ঢাকা কলেজে রয়েছে ২৫টির বেশি সামাজিক, স্বেচ্ছাসেবী ও সাংস্কৃতিক সংগঠন। বিগত সময়ে এ সংগঠনগুলো কলেজের শিক্ষার্থীদের মুক্তবুদ্ধি চর্চা, সৃজনশীলতা ও মানবিক মূল্যবোধ বিকাশে বহুমাত্রিক ভূমিকা পালন করেছে। কলেজের শিক্ষার্থীদের সংকট ও সমাধানের প্রধান সেতুবন্ধন হিসেবে কাজ করেছে এই সংগঠনসমূহের সদস্য ও নেতৃবৃন্দ। কিন্তু বর্তমানে নানাবিধ সংকটে জর্জরিত কলেজের অধিকাংশ সংগঠনের কার্যক্রম এখন প্রায় নিষ্ক্রিয়।
জানা যায়, ঢাকা কলেজে ২০টি নিবন্ধিত সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন রয়েছে। এর মধ্যে ৫-৬টি সংগঠন সক্রিয়ভাবে ক্যাম্পাসে নিয়মিত কার্যক্রম পরিচালনা করছে। বিএনসিসি, রোভার স্কাউট, বাঁধন, রেড ক্রিসেন্ট ও বিজ্ঞান ক্লাব এই ৪টি সংগঠন সরকারিভাবে অনুমোদিত। দীর্ঘদিন ধরে বাকি সামাজিক সংগঠনগুলো কার্যক্রমে ভাটা পড়েছে। সংগঠনগুলোর নেই সুনির্দিষ্ট সাংগঠনিক কমিটি। বছরে দুই একটি প্রোগ্রাম ছাড়া এ সংগঠনগুলোর ক্যাম্পাসে কোন কার্যক্রম নেই বললেই চলে।
সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্রমতে, বর্তমানে ঢাকা কলেজে বিএনসিসি, রেড ক্রিসেন্ট, রোভার স্কাউট, ঢাকা কলেজে ডিবেটিং সোসাইটি (ডিসিডিএস), ঢাকা কলেজ সাংবাদিক সমিতি (ঢাকসাস), কালচারাল ক্লাব, তরুণ কলাম লেখক ফোরাম নিয়মিত সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনা করছে। আবৃত্তি সংসদ, ইংলিশ ল্যাঙ্গুয়েজ ক্লাব, শহীদ রুমী সংসদ, গ্রিন ভয়েস, বইবিহঙ্গ, পরিবেশ বিজ্ঞান ক্লাব, মিউজিক ক্লাব, নাট্যমঞ্চ, অ্যাডভেঞ্চার ক্লাব, নেচার স্টাডি ক্লাব, বিভিন্ন বিভাগভিত্তিক অ্যাসোসিয়েশন সংগঠনসমূহের কার্যক্রমে নিষ্ক্রিয়তা লক্ষণীয়।
কলেজের সাধারণ শিক্ষার্থীরা বলছেন, কলেজ প্রশাসন থেকে পৃষ্ঠপোষকতা ও নিয়মিত তত্ত্বাবধানের অভাব, পর্যাপ্ত ফান্ড ও অফিসের অভাব। একাডেমিক ক্যালেন্ডার না থাকা ও নির্দিষ্ট সময়ে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত না হওয়া, বিগত সময়ে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, শিক্ষার্থীদের মধ্যে আগ্রহের সংকট, ক্লাব সংগঠনগুলোতে যোগ্য নেতৃত্বের অভাবে ক্যাম্পাসে সামাজিক সংগঠনগুলো দক্ষতা উন্নয়নে সহশিক্ষা কার্যক্রম সঠিকভাবে পরিচালনা করতে ব্যর্থ হচ্ছে।
ক্যাম্পাসে সামাজিক সংগঠনগুলোর কার্যক্রম সংকটের বিষয়ে ডিবেটিং সোসাইটির সভাপতি শাহাদাত হোসাইন বলেন, অধিকাংশ ক্লাবের তুলনামূলক কম সক্রিয়তা বা নিষ্ক্রিয়তার কারণ মূলত দুইটি। পর্যাপ্ত পৃষ্ঠপোষকতার অভাব এবং নিয়মিত তত্ত্বাবধানের অভাব। একটি সংগঠন পরিচালনার জন্য যে পরিমাণ আর্থিক এবং অবকাঠামোগত সহযোগিতা প্রয়োজন হয় তা এই ক্লাবগুলো তেমন একটা পায় না।
‘‘এ কারণে আগ্রহ থাকার পরেও তারা অনেক কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে পারে না। দ্বিতীয়ত, নিয়মিত তত্ত্বাবধানের মধ্যে না থাকলে যেকোনো সংগঠনের গতিশীলতা নষ্ট হয়। এজন্য প্রয়োজন সংশ্লিষ্ট সংগঠনের দায়িত্বে থাকা শিক্ষকদের এবং সাবেক সদস্যদের নিয়মিত পর্যবেক্ষণ এবং পরামর্শ প্রদান। পাশাপাশি সংগঠনের সদস্যদের সাংগঠনিক দক্ষতাও গুরুত্বপূর্ণ। সাংগঠনিক দক্ষতার অভাবে সংগঠন অনেক বেশি পিছিয়ে পড়ে।’’
সাংগঠনিক কার্যক্রমে নিষ্ক্রিয়তার বিষয়ে আবৃত্তি সংসদের আহ্বায়ক মাহাদীউজ্জামান বলেন, ২০২২ সালে ঢাকা কলেজ আবৃত্তি সংসদের কার্যক্রম শুরু করার পর থেকেই আবৃত্তি সংসদ খুব দ্রুতই ক্রিয়াশীল সংগঠন হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠে। পরবর্তীতে ২০২৩ সালের জানুয়ারি বা ফেব্রুয়ারি এরকম একটা সময়ে স্বৈরাচারী সরকারের দোসরদের নগ্ন হস্তক্ষেপের কারণে জুলাই আন্দোলনের আগ পর্যন্ত আবৃত্তি সংসদের কার্যক্রম আর পরিচালনা করা সম্ভব হয়নি।
‘‘পরবর্তীতে জুলাই বিপ্লবের পর কার্যক্রম নতুন করে শুরু করার পর আমরা ফরম পূরণে ভালো সাড়া পেয়েছি। কিন্তু নিকটবর্তী সময়ে কয়েকটি আন্দোলন এবং সিরিজ পরীক্ষা শুরু হওয়ার কারণে আবৃত্তি সংসদের দায়িত্বশীল পর্যায়ের লোকজন এবং সদস্য কেউই সেভাবে সময় দিতে পারছে না। ফলে আবৃত্তি সংসদের কার্যক্রম কিছুটা স্থবির হয়ে পড়েছে। তবে আমরা আশা করছি, খুব শীঘ্রই আবৃত্তি সংসদের কার্যক্রমে গতি ফিরে পাবে।’’
ক্যাম্পাসে সামাজিক সংগঠনগুলোর বিভিন্ন সংকট ও সীমাবদ্ধতার কথা উল্লেখ করে তরুণ কলাম লেখক ফোরাম ঢাকা কলেজ শাখার সভাপতি রাকিব হাসান বলেন, সংগঠনগুলোর বিভিন্ন ক্ষেত্রগুলোতে ঢাকা কলেজের নেতৃত্ব প্রদান করে। সুতরাং, বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর গতিশীলতা আনা প্রয়োজন। গতিশীলতা বৃদ্ধির জন্য সংগঠনগুলোকে একাডেমিক কার্যক্রম অনুযায়ী তাদের কর্মসূচিকে সাজাতে হবে এবং ক্যাম্পাস কার্যক্রমে সক্রিয়তা বজায় রাখতে হবে।
‘‘ঢাকা কলেজ প্রশাসনকেও একইভাবে এগিয়ে আসতে হবে এবং সংগঠন বান্ধব সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। কলেজ ফান্ডের একটি নির্দিষ্ট অংশ এ সকল সংগঠনের মাঝে বণ্টন করতে হবে ও আলাদা রুমের ব্যবস্থাও গ্রহণ করতে হবে।’’
কলেজে সামাজিক সংগঠনের কার্যক্রম পরিচালনায় বিভিন্ন সীমাবদ্ধতার কথা স্বীকার করে ঢাকা কলেজ অধ্যক্ষ অধ্যাপক এ কে এম ইলিয়াস বলেন, ‘আমাদের ক্লাস রুমের তীব্র সংকট। সেখানে সংগঠনগুলোকে অফিস দেব কীভাবে? কলেজের আরবি ও পরিসংখ্যান ডিপার্টমেন্টে পাঁচ ইয়ারে একটা বা দুইটা করে রুম আছে। কোন ডিপার্টমেন্টে চারটা রুম নেই।
‘‘সামাজিক সংগঠনগুলোকে সাধ্যানুযায়ী যতটুকু সহযোগিতা করা প্রয়োজন ততটুকু করি। খাতের বাইরে গিয়ে সহযোগিতা করার সুযোগ নেই। এই মুহূর্তে সামাজিক সংগঠনের কাজ গতিশীল করতে বিশেষ সুবিধা দেওয়া আমাদের পক্ষে সম্ভব না। আমাদের দরকার একটি টিএসসি ও বড় হল। এগুলো হলে এই সমস্যা কাটিয়ে উঠা সম্ভব।’’
এ প্রসঙ্গে ঢাকা কলেজ শিক্ষক পরিষদের সাধারণ সম্পাদক আ.ফ.ম রফিক উদ্দিন বলেন, ছাত্র জীবনে মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে সামাজিক সংগঠনগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এই সংগঠনগুলোর মাধ্যমে নিজেকে দক্ষ ও যোগ্য করে গড়ে তোলা যায়। যা পরবর্তীতে চাকরির ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখে। সামাজিক সব সংগঠনকে সাহায্য করা সম্ভব না।
‘‘কারণ, আমাদের কলেজ সরকারি প্রতিষ্ঠান। সরকারি কলেজে অনেক বিধিবিধান মেনে চলতে হয়। চাইলেই যে কাউকে সাহায্য করা সম্ভব নয়। আমাদের অবকাঠামোগত সংকটের কারণে সবাইকে রুম দেওয়াও সম্ভব হয়ে উঠছে না। অধ্যক্ষ স্যারের সাথে কথা বলবো কীভাবে সামাজিক সংগঠনের কার্যক্রম বৃদ্ধি করা যায়।’’