শাবিপ্রবি শিক্ষক মাজহারের বিরুদ্ধে অভিযোগের পাহাড়
- মোফাজ্জল হক, শাবিপ্রবি
- প্রকাশ: ০৫ অক্টোবর ২০২৪, ০৯:০৮ PM , আপডেট: ০৫ অক্টোবর ২০২৪, ০৯:০৮ PM
নিরাপত্তা কর্মীকে দিয়ে ফেনসিডিল সরবরাহ করা, নারী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ, শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে টাকা ধার নিয়ে না দেওয়াসহ নানা অনিয়ম অপকর্মের অভিযোগ উঠেছে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগের সাবেক বিভাগীয় প্রধান ও স্কুল অব ম্যানেজমেন্ট এন্ড বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. মাজহারুল হাসান মজুমদারের বিরুদ্ধে।
শিক্ষার্থীদের অভিযোগ সুন্দরী নারী শিক্ষার্থীরা কখনো শাড়ি পড়ে ক্লাসে আসলে তাদেরকে বিভিন্নভাবে প্রপঞ্চনা করতেন ও অফিসে ডাকাতেন এমনকি নানা কৌশলে গায়ে স্পর্শ করতেন। তিনি নিজ বিভাগে চেয়ারে বসে প্রকাশ্যে শিক্ষার্থীদের সামনে ধূমপান করেন এতে অনেক শিক্ষার্থী বিব্রতবোধ করেন।
শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে ফেরত দেননি বলেও একাধিক শিক্ষার্থীর অভিযোগ। বিভিন্ন সময় ক্লাসে মেয়েদেরকে কটূক্তিমূলক কথাবার্তা বলতেন তিনি। এমনকি মেয়েদেরকে বাসায় এসে রান্না করে দেওয়ার আর্জিও জানাতেন বলে অভিযোগ উঠেছে এই শিক্ষকের বিরুদ্ধে। তিনি প্রায়ই টাকা ধার করেন, কিন্তু কখনো শোধ করেন না। টাকা ধার নেওয়া প্রতি ছাত্রের কাছেই তার কমন কথা, 'এই টাকার ব্যাপারে আপনি, আমি এবং গড ছাড়া যেন চতুর্থ কোন ব্যক্তি না জানে। আমি ৭ দিনের মধ্যে টাকাটা ফেরত দিয়ে দেব। ৭ দিন কখনো শেষ হয় না, ছাত্রছাত্রীও ভয়ে টাকা ফেরত চায় না বলেও অভিযোগ করেন শিক্ষার্থীরা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন প্রশাসনিক দপ্তর সূত্রে জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদ উপাচার্য হওয়ার পর উপ-উপাচার্য থেকে শুরু করে শিক্ষক নিয়োগ ও গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক কর্মকর্তা নিয়োগে নিজ এলাকা কুমিল্লার স্বজনপ্রীতি মনোভাব দেখাতেন বলেও অভিযোগ তাদের। অধ্যাপক মাজহারুল হাসান মজুমদারও সম্ভ্রান্ত আওয়ামী পরিবারে কুমিল্লার সন্তান হওয়ায় উপাচার্যের দুধের মাছি হয়ে নিয়োগ বাণিজ্য থেকে শুরু করে নানা অনিয়মের অভিযোগ উঠলেও ফলপ্রসূ কোনো বিহিত হয়নি বলেও জানান তারা। এমনকি উপাচার্য বরাবর নানান অনিয়মের অভিযোগ জমা পরার পরেও ২০২৩ সালের জুনে ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদের ডিন করা হয় থাকে।
এ ব্যাপারে ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগের গ্রাজুয়েট শিক্ষার্থী আজমিনা আফরিন তোরা দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ক্লাসে কখনো কোন ছাত্রী সেজেগুজে আসলে, তাকে দেখতে ভাল লাগলে নানা ছুঁতোয় তাকে অপমান অপদস্ত এবং এক পর্যায়ে গায়ে হাত তুলতেন তিনি। অপমানে ছাত্রীরা তার সামনেই কেঁদে দিত। সুন্দরী মেয়েদের বিভিন্ন সময়ে তার রুমে ডাকতেন। বেশির ভাগ সহপাঠিরাই তা এড়িয়ে যেত কৌশলে। কিন্ত তাকে এড়ানো কঠিন ছিল বৈকি। দফায় দফায় কয় দিন পর পর তিনি বিভিন্ন জনের উদ্দেশ্যে সবার সামনেই বলতেন পরে তার রুমে গিয়ে দেখা করতে! ক্লাসে বিভিন্ন অপ্রাসঙ্গিক কথা বলে মেয়েদের অস্বস্তিতে ফেলায় তিনি ছিলেন ওস্তাদ। মেয়েরা লজ্জায় কুঁকড়ে যেত। সম্ভবত তিনি তা দেখে মজা পেতেন।
তিনি আরো বলেন, ক্লাসে অপমান করে ক্লাস শেষে আমাকে একদিন উনি ফোন করে ভার্সিটি গেইটে ডেকে নেন। ক্লাসের অপমানের পর তার সঙ্গে গেইটে দেখা করার রুচি না থাকলেও শিক্ষককে এড়াতে পারিনি সেদিন। গেটে যাওয়ার পর ছোট একটা উপহার হাতে ধরিয়ে দিয়ে শরীরে চাপ দিয়ে স্পর্শ করে বলেন, 'শাসন করা তাকেই মানায় সোহাগ করে যে'। ঘেন্নায় সেদিন মরে যেতে ইচ্ছা করেছিল। ওনার বিরুদ্ধে অ্যাকশনে যেতে চেয়েছিলাম। শাবিপ্রবির যৌন নির্যাতন সেলে একটা অভিযোগ করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ভিক্টিম একটা মেয়েও রাজি হয়নি কারণ তাদের যুক্তি ছিল স্যারের বিরুদ্ধে কিছু করলে উনি পুরা ব্যাচের রেজাল্ট নামায়া দিবেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ২০১২-১৩ শিক্ষাবর্ষের ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগের শিক্ষার্থী বলেন, মাজহারুল স্যার একদিন হোয়াটসঅ্যাপে ফোন দিয়ে বলতেছে আমি যেন থাকে ১০ হাজার টাকা ধার দেই। আমি আগেই জানতাম এবং বিভাগের সিনিয়রদের কাছ থেকেও শুনেছি স্যার বিভিন্ন সময়ে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে আর ফেরত দিতে চান না। তাই আমি আর টাকা দেইনি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একই বিভাগের অধ্যায়নরত একজন শিক্ষার্থী বলেন, আমাদের মাজহার স্যারের বিরুদ্ধে অভিযোগের শেষ নেই। উনি নারী শিক্ষার্থীদের সাথে অসৌজন্যমূলক আচরণ করেন। শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে টাকা ধার নিয়ে আর দিতে চান না পাশাপাশি উনি একজন মাদকাসক্ত মানুষ। এখনো তিনি বিভাগের সামনে বসে প্রকাশ্য ধুমপান করেন বলেও অভিযোগ করেন এই শিক্ষার্থী। তিনি আরো বলেন, উনার ডিন অফিসে আমরা তালা মেরে দিয়েছি এবং দ্রুত পদত্যাগ করার জন্য আল্টিমেটাম দিয়েছি। যদি তিনি পদত্যাগ না করেন তাহলে আমরা উপাচার্য বরাবর সকল অভিযোগের লিখিত দিব।
উল্লেখ্য, মাজহারুল ইসলাম মজুমদার ২০২২ সালে জাহিদুর রহমান নামে এক নিরাপত্তা কর্মীকে দিয়ে ফেনসিডিল আনানোর সময় শিক্ষার্থীরা তাকে আটক করে পুলিশের কাছে সোর্পদ করেন। ঘটনার নিশ্চয়তা করে সিলেট মহানগর পুলিশের উপ-পুলিশ কমিশনার আজবাহার আলী শেখ বলেছেন, এক যুবক উপাচার্যের বাসভবনের দিকে ঢুকছিল। সে এখানকার আউট সোর্সিংয়ের সিকিউরিটি গার্ড। জাহিদুর রহমান নামে ওই সিকিউরিটি গার্ডকে ফেনসিডিলসহ শিক্ষার্থীরা আটক করে পুলিশের হাতে দিয়েছে। ওই গার্ড জানিয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবিএ বিভাগের অধ্যাপক মাজহারুল হাসান মজুমদারের জন্য সে ফেনসিডিল নিয়ে গিয়েছিল।
জানা যায়, ২০২১ সালের এপ্রিলে অনলাইন ক্লাস চলাকালে অধ্যাপক মাজহারুল হাসান প্রকাশ্যে ধুমপান করলে ছবিটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও জাতীয় পত্র-পত্রিকায় ছড়িয়ে পড়লে দেশজুড়ে ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দেয়। এছাড়াও বিভিন্ন ব্যাচের অনলাইন ক্লাস চলাকালে ধূমপানরত অবস্থায় তার একাধিক ছবি প্রকাশের পর ব্যাপক সমালোচনা হয়েছিল। গণমাধ্যমের কাছে সে সময় তিনি সে ছবির সত্যতাও স্বীকার করেছিলেন।
টাকার বিনিময়ে প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ ও রয়েছে এই শিক্ষকের বিরুদ্ধে। সেমিস্টার ফাইনাল পরিক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের সাথে জড়িত অভিযোগ এনে একই বিভাগের বেলায়েত হোসেন নামের একজন শিক্ষককে আজীবন বহিষ্কার করা হলেও মাজহারুল হাসান মজুমদারকে শাস্তি স্বরূপ ৫ বছরের জন্য পরীক্ষা সংক্রান্ত কাজ থেকে নিষিদ্ধ করা হয়। ঐ ঘটনার তদন্ত কমিটির প্রধান ছিলেন অধ্যাপক ড. মো. জাফর ইকবাল।
এ ব্যাপারে বেলায়াত হোসেনের সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মোশাররফ হোসেন টিটু বলেন, বেলায়েত হোসেনের সাথে অন্যায় করা হয়েছে। কেননা থাকে বহিষ্কার দেখানো হলেও আইনগতভাবে তাকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেওয়া হয়নি। এখনো বেলায়াত হোসেন ন্যায় বিচার পাওয়ার অধিকার রাখেন বলেও তিনি জানান।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে সব অভিযোগ অস্বীকার করে অধ্যাপক মাজহারুল হাসান মজুমদার দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, এসব অভিযোগ ভিত্তিহীন। আজমিনা তোরা মেয়েটা ক্লাসে ঐ দিন হাসাহাসির জন্য বেশি বকাঝকা করে ফেলছিলাম তাই ওকে খুশী করতে ছোট একটা গিফট দিয়ে তার কপালে স্পর্শ করেছিলাম। তার অভিযোগের ব্যাপারে বিভাগের অন্য কেউ ইন্ধন দিচ্ছেন বলেও মনে করেন তিনি।