ইবির ফুলপরীকে নির্যাতনের ঘটনায় ২৭ নারী অধিকারকর্মীর বিবৃতি
- টিডিসি রিপোর্ট
- প্রকাশ: ০৪ মার্চ ২০২৩, ০২:২০ PM , আপডেট: ০৪ মার্চ ২০২৩, ০২:২০ PM
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের (ইবি) দেশরত্ন শেখ হাসিনা হলে শাখা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের হাতে নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ফুলপরী খাতুন নামে বিশ্ববিদ্যালয়টির নবীন এক শিক্ষার্থী। এই ঘটনায় নিন্দা জানিয়ে সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচারের দাবি জানিয়েছেন ২৭ নারী অধিকারকর্মী। শনিবার (০৪ মার্চ) দেওয়া বিবৃতিতে তারা এই নিন্দা জানান।
বিবৃতিতে বলা হয়েছে, কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের দেশরত্ন শেখ হাসিনা হলে ছাত্রলীগ নেত্রী সানজিদা চৌধুরী অন্তরা, তাবাসসুম ইসলাম ও তাদের সহযোগীদের হাতে ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্রী ফুলপরী খাতুনকে লাঞ্চনা, অপমান ও যৌন আক্রমণের ঘটনার তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি।
‘‘একইসঙ্গে আমরা সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করছি, শাসকদলের ছাত্র সংগঠন ও তাদের ছত্রছায়াদানকারী সুবিস্তৃত নেটওয়ার্কের প্রতি, যারা সশব্দে বা নিঃশব্দে ঘটনার ভয়াবহতা হালকা করার ও দৃষ্টি সরানোর চেষ্টা চালাচ্ছে। তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, হল প্রশাসন, ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব, রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবী এবং মিডিয়া ও নারী সংগঠনের একাংশ। এক্ষেত্রে উল্লেখ্য যে, তাদের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া আর কিছু না করুক, ফুলপরীর অভিযোগের সত্যতা প্রমাণ করে।’’
এতে বলা হয়, সবার আগে আমরা ফুলপরী ও তার পরিবারকে সশ্রদ্ধ সালাম জানাই। যুগ যুগ ধরে যৌন আক্রমণের শিকার নারীকে গোষ্ঠীর ইজ্জত বাঁচানোর কথা বলে মুখ বন্ধ রাখতে বলা হয়েছে। মিডিয়া সূত্রে জানতে পেরেছি যে ফুলপরীর বাবা আতাউর রহমানই তাকে নিপীড়নের বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস যোগান। "তোর বাবা একজন ভ্যানচালক, কে তোর পাশে দাঁড়াবে?", আক্রমণকারী সানজিদা চৌধুরীর এই তিরস্কারকে মিথ্যা প্রমাণিত করে সমগ্র দেশের ন্যায়পরায়ণ মানুষ আজ ফুলপরী ও তার মেহনতি পরিবারের পাশে।
‘‘আমরা মনে করি তার বাবা স্যুটেড-ব্যুটেড নন বলেই মাথা নত করেননি। ফুলপরীকে অনুসরণ করে ইতোমধ্যেই ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের আরও ৪ জন শিক্ষার্থী তদন্ত কমিটির কাছে নির্যাতনের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন। আমরা তাদেরও অভিবাদন জানাই।’’
বিবৃতিতে বলা হয়েছে, নির্যাতনের ঘটনাকে হালকা করার প্রচেষ্টায় শুরুর দিকে এটিকে 'পরস্পরের বিরুদ্ধে অভিযোগ' ও 'র্যাগিং' বলে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু কদিন পর একটি ইউটিউব চ্যানেলে যখন ভুক্তভোগী সাড়ে ৪ ঘণ্টাব্যাপী নির্যাতনের ঘটনা নিঃসংকোচে বর্ণনা করেন, তখন আমরা স্পষ্টভাবে দেখতে পাই যে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ও আর সব ছাত্রলীগ আধিপত্যাধীন উচ্চতর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের (পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, ইডেন কলেজ ইত্যাদি) মতো।
‘‘এখানেও ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের একচ্ছত্র আধিপত্য বিরাজমান। এখানেও ছাত্রলীগের নেতা-নেত্রী-কর্মীরা শাসকদলের শারীরিক ও মতাদর্শিক লাঠিয়াল বাহিনী। এখানেও তারা অবাধে সিট বাণিজ্য থেকে শুরু করে টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি করেন। এখানেও ভয়ের সংস্কৃতি বিদ্যমান। এখানেও অসাড় নীতি-নৈতিকতাসম্পন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্ণধাররা ‘প্রক্টর, প্রভোস্ট, অধ্যক্ষ, ভিসি’ পদের বিনিময়ে ছাত্রলীগকে প্যারালাল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন চালাতে দেন। এখানেও ছাত্রলীগের নেত্রীরা সহযোগীদের সাহায্যে টর্চার সেল চালান। এখানেও নেতা-নেত্রীদের ইচ্ছামতো যেকোনো স্থান—কী শিক্ষার্থীর রুম, কী নেত্রীর রুম, কী গণরুম— নিমেষে বনে যেতে পারে টর্চার সেল। আর এসব কারণেই কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ নেতাদের বক্তব্য, 'অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার জন্য কিছু বিপথগামী'রা দায়ী, ধোপে টেকে না। সমস্যা ব্যক্তিক নয়, সমগ্র ব্যবস্থার।’’
আরও পড়ুন: ইবির ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হল ফুলপরীর নতুন ঠিকানা
অধিকারকর্মীরা বলেন, ফুলপরীকে কেবল শারীরিক নয়, মানসিক ও যৌন নির্যাতনও করা করেছে। এখন শোনা যাচ্ছে এ ধরনের ঘটনা ক্যাম্পাসে অহরহই ঘটে। তফাৎ হচ্ছে এর আগে কেউ ফুলপরীর মতো সাহস করে বলেননি।
বিবৃতিদাতাদের ভাষ্য, ফুলপরীর অভিযোগের ভয়াবহতার পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্ববিদ্যালয় ও হল কর্তৃপক্ষের উচিত ছিল অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি আইনের অধীনে আক্রমণ ও ব্ল্যাকমেইলের মামলা করার জন্য অভিযোগকারীকে আইনি পরামর্শ ও সহায়তা প্রদান করা। কিন্তু সেটি করা দূরে থাক, গণমাধ্যমে সূত্রে জানতে পারি যে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তদন্তের নামে উলটো ফুলপরীকে হয়রানি করছে। তদন্ত চলাকালীন তাকে যেখানে অনায়াসে নিরাপত্তা দিয়ে ক্যাম্পাসে থাকার ব্যবস্থা করা যেত, সেখানে মেয়ে আর বাবাকে ভ্যান, নৌকা, ইজিবাইকে চড়ে রোজ ৮ ঘণ্টা ব্যয় করে বাড়ি থেকে আসা-যাওয়া করতে হচ্ছে। দৈনিক আয়ের ওপর নির্ভরশীল পরিবারকে এমন পরিস্থিতিতে ফেলা আরেক ধরনের টর্চার! কিন্তু এখানেই শেষ নয়, তদন্তের তথ্য যাচাই-বাছাই করার নামে বিশ্ববিদ্যালয় তদন্ত কমিটি ফুলপরীকে তার নির্যাতনকারীদের মুখোমুখি করে "মাফ চাওয়ার" নাটকও সাজিয়েছে।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছে, 'আশ্চর্যজনক হলেও সত্য আমাদের নারী শিক্ষামন্ত্রী পদত্যাগ করা তো দূরে থাক, এখন পর্যন্ত একটি শব্দও উচ্চারণ করেননি। একই অবস্থা নারী প্রতিমন্ত্রী, জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত আসনের নারী সংসদ সদস্য, সংরক্ষিত আসনের বাইরের নারী এমপি ও মূলধারার নারী নেত্রীদের। সম্ভবত তারা আশা করছেন গত বছর ইডেন মহিলা কলেজের ছাত্রলীগ নেত্রীদের বিরুদ্ধে জুনিয়র সহপাঠীদের পার্টির নেতা বা ব্যবসায়ীদের কাছে যৌন উপভোগের জন্য যেতে বাধ্য করার তদন্তটি যেভাবে "ম্যানেজ" হয়ে গিয়েছিল, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনাটিও একইভাবে "ম্যানেজ" হয়ে যাবে।
সবশেষে এই অধিকারকর্মীরা বলেন, 'এই পরিস্থিতিতে ফুলপরীকে যৌন নির্যাতন করার ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচারের জোর দাবি জানাই।'
বিবৃতিতে সই করেছেন— ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) শিক্ষক অধ্যাপক ড. গীতি আরা নাসরিন, গার্মেন্টস শ্রমিক ঐক্য ফোরামের সভাপতি মোশরেফা মিশু, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) শিক্ষক অধ্যাপক ড. মির্জা তাসলিমা সুলতানা, চাকমা সার্কেলের উপদেষ্টা রাণী য়েন য়েন, ভারতের জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি গবেষক নাজনীন শিফা, ঢাবি শিক্ষক কাজলী শেহরীন ইসলাম ও মার্জিয়া রহমান, গবেষক ও মানবাধিকার কর্মী রোজীনা বেগম, নৃবিজ্ঞানী ও গবেষক ড. নাসরিন খন্দকার, ঢাবি শিক্ষক ড. সামিনা লুৎফা, গবেষক ও অ্যাক্টিভিস্ট দিলশানা পারুল, অ্যাক্টিভিস্ট মারজিয়া প্রভা, চিকিৎসক ডা. সাদিয়া চৌধুরী, নৃবিজ্ঞানী ও চলচ্চিত্র নির্মাতা ড. নাসরিন সিরাজ, আলোকচিত্রী ও বাংলাদেশ গার্মেন্টস শ্রমিক সংহতির সভাপ্রধান তাসলিমা আখতার, নারী সংহতির সভাপতি শ্যামলী শীল, অ্যাক্টিভিস্ট ইলিরা দেওয়ান, শিক্ষক ও নোয়াখালী নারী অধিকারের সভানেত্রী লায়লা পারভীন, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের শিক্ষক শিল্পী বড়ুয়া, শিক্ষক ও আলোকচিত্রী জান্নাতুল মাওয়া, লেখক ও নৃবিজ্ঞানী সায়েমা খাতুন, যুক্তরাজ্যের ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক সাদাফ নূর, কানাডার ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি গবেষক হানা শামস আহমেদ, লেখক তাহেরা বেগম জলি, সুপ্রিম কোর্টের অ্যাডভোকেট ব্যারিস্টার সাদিয়া আরমান, সাংবাদিক ও গবেষক ড. সায়দিয়া গুলরুখ এবং লেখক ও নৃবিজ্ঞানী রেহনুমা আহমেদ।