‘মান রক্ষায়’ ব্যতিক্রমী গ্রেডিং ৬ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে
- আহমেদ ইউসুফ
- প্রকাশ: ০১ অক্টোবর ২০২৪, ০৬:৩৬ PM , আপডেট: ০৯ অক্টোবর ২০২৪, ০৪:০৯ PM
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) বেঁধে দেওয়া অভিন্ন গ্রেডিং পদ্ধতি মানছে না বেশ কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। দীর্ঘদিন আলোচনার পর ইউজিসি এবার বিষয়টি সমাধানের কথা জানিয়েছে। তদারক সংস্থাটি বলছে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অভিন্ন পদ্ধতি না মানায় শিক্ষার্থীদের আর্থিক ক্ষতি এবং চাকরির বাজারে বৈষম্যের মুখে পড়তে হচ্ছে। ফলে যত দ্রুত সম্ভব বিষয়টি সুরাহা করতে চান তারা।
ইউজিসি প্রণীত গ্রেডিং পদ্ধতিতে দেখা যায়, ৮০ বা এর বেশি নম্বর পেলে একজন শিক্ষার্থীকে ‘এ-প্লাস’ বা সিজিপিএ-৪ দেওয়া হবে। ৭৫ থেকে ৭৯ নম্বর পেলে তা ‘এ রেগুলার’ বা সিজিপিএ-৩ দশমিক ৭৫ এবং ৭০ থেকে ৭৪ পেলে ‘এ মাইনাস’ বা সিজিপিএ-৩ দশমিক ৫ পাবে। ৬৫ থেকে ৬৯’র জন্য ‘বি প্লাস’ বা সিজিপিএ-৩ দশমিক ২৫, ৬০ থেকে ৬৪’র কম পেলে তা ‘বি রেগুলার’ বা সিজিপিএ-৩ হিসাবে শনাক্ত করা হবে।
‘ইউজিসির তরফ থেকে যেটা করণীয় আমরা খুব সিরিয়াসলি সেটা নিশ্চিত করব। গ্রেডিং সিস্টেম কারা মানছে কারা মানছে না আমরা বিষয়গুলো খোঁজ নেব। আমরা কেবল দায়িত্ব নিয়েছি। এটা একক কোন কাজ না, এটা টিমওয়ার্ক। পাশাপাশি ইউজিসির আইনে যে নির্দেশনা রয়েছে সে অনুযায়ী মেম্বারদের মতামতের ভিত্তিতে এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়া হবে —অধ্যাপক এস এম এ ফায়েজ, চেয়ারম্যান, ইউজিসি
তবে ইউজিসির বেঁধে দেয়া অভিন্ন গ্রেডিং পদ্ধতির বিপরীতে নিজেদের মতো করে গ্রেডিং দিচ্ছে ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি; নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি (এনএসইউ); আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ (এআইইউবি); ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস (ইউল্যাব); ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি (ইউআইইউ) এবং ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ (আইইউবি)। জানা যায়, এর আগে ২০২২ সালে বিষয়টি নিয়ে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়কে চিঠি পাঠিয়ে অভিন্ন গ্রেডিং পদ্ধতি অনুসরণের জন্য সময় বেঁধে দিয়েছিল ইউজিসি। ওই চিঠির আলোকে ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস অ্যাগ্রিকালচার অ্যান্ড টেকনোলজি (আইইউবিএটি) এবং ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি ইউজিসির গ্রেডিং পদ্ধতি অনুসরণ শুরু করলেও বাকি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো চলছে আগের নিয়মেই।
অধ্যাপক এস এম এ ফায়েজ, চেয়ারম্যান, ইউজিসি
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দাবি, ইউজিসির অভিন্ন গ্রেডিং পদ্ধতির বিষয়টিকে তারা একটি গাইডলাইন হিসেবে দেখেন। নিয়মটি মানতেই হবে এমন কোন বাধ্যবাধকতা ইউজিসি থেকে দেয়া হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মান রক্ষা এবং স্বকীয়তা বজায় রাখতেই অভিন্ন গ্রেডিং অনুসরণ করতে আগ্রহী নয়।
‘মান রক্ষার কথা বললেও মূলত বিশ্ববিদ্যালয় রিটেকের মাধ্যমে নীরবে শিক্ষার্থীদের অর্থ কেড়ে নিচ্ছে। কারণ আমাদের পাস মার্ক বেশি। তাদের কাছে কোনোকিছু বলতে গেলে ভর্তির সময়ের কথা বলেন। কিন্তু এটা সরাসরি বৈষম্য। কারণ গ্রেডিংয়ের কারণে জব মার্কেটেও আমরা নিজেদের তুলে ধরার সুযোগ পাই না। আমাদের মধ্যে এমনও শিক্ষার্থী আছেন, যারা বছরের পর বছর রিটেকের অর্থ জোগাড় করতে গিয়ে পরিবারের জমি বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন। গ্রেডিং সিস্টেমে পরিবর্তন আনা এখন সময়ের দাবি —আবু সায়েম, শিক্ষার্থী, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়
খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, ব্র্যাক ইউনিভার্সিটিতে ৯০-৯৭ নম্বর পেলে ‘এ এক্সিলেন্ট’ এবং ৯৭-১০০ পেলে ‘এ প্লাস এক্সেপসনাল’; যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়টির পাস নম্বর ৫০। এনএসইউতে ৯৩ বা তার বেশি নম্বর পেলে ‘এ এক্সিলেন্ট’ বা সিজিপিএ ৪ দেওয়া হয়। আইইউবিতে ৯০-এর বেশি পেলে তাকে এ গ্রেড বা সিজিপিএ ৪ দেওয়া হয়। তাদের গ্রেডিংয়ে ‘এ প্লাস’ নেই। ইউআইইউতে ৯০ বা তার বেশি পেলে শিক্ষার্থীরা ‘এ (প্লেইন)’ বা সিজিপিএ ৪ পায়; যেখানে পাস করতে পেতে হয় ন্যূনতম ৫৫। এআইইউবি ৯০ নম্বরে সিজিপিএ ৪ দেওয়ার পাশাপাশি লেটার গ্রেডে ‘এ প্লাস’ আর পাস নম্বর ৫০। ইউল্যাবে ‘এ প্লাস’ পেতে হলে ৯৩ নম্বর পেতে হয় আর পাস মার্ক ৪০।
নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির রেজিস্ট্রার ড. আহমেদ তাজমিন জানান, ‘নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি মূলত নর্থ আমেরিকান সিস্টেম অনুসরণ করে। উচ্চশিক্ষালয়টি ন্যাশনাল এবং ইন্টারন্যাশনাল এডভাইজারদের উপদেশক্রমে শুরু থেকেই নিজস্ব গ্রেডিং অনুসরণ করে। ইউজিসি অনেক পরে অভিন্ন গ্রেডিং সিস্টেম দিয়েছে।’
আরও পড়ুন: সাবেক চেয়ারম্যানসহ ইউজিসির ১৩ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে এআইইউবি শিক্ষার্থীর মামলা
ড. আহমেদ বলেন, আমরা মনে করি, আমাদের গ্রেডিং সিস্টেমটা মান নিশ্চিতের জায়গা থেকে আমাদেরকে সবার থেকে আলাদা করে। পাশাপাশি জব মার্কেট এবং স্টুডেন্টদের থেকে যে রিয়েকশন আসে, তাতে আমাদের মনে হয়েছে এই পদ্ধতি শিক্ষার্থীদের যোগ্যতা পরিপূর্ণভাবে তুলে ধরতে সক্ষম। আর ইউজিসি যে সিস্টেম প্রোভাইড করেছে, সেটিকে তারা কখনও বাধ্যতামূলক করেনি। বরং এটা আমাদের কাছে একটা গাইডলাইন হিসেবে থাকল।
গ্রেডিং সিস্টেম নিয়ে নর্থ সাউথ, ইউআইইউ এবং এআইইউবির কয়েকজন শিক্ষার্থীর সাথে যোগাযোগ করা হলে তারা বিষয়টি নিয়ে চাপা ক্ষোভ প্রকাশ করেন। আবু সায়েম নামে এক শিক্ষার্থী দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে জানান, ‘বিশ্ববিদ্যালয় মান রক্ষার কথা বললেও মূলত তারা রিটেকের নামে নীরবে শিক্ষার্থীদের অর্থ কেড়ে নিচ্ছে। কারণ আমাদের পাস মার্ক বেশি। তাদের কাছে কোনোকিছু বলতে গেলে ভর্তির সময়ের কথা বলেন। কিন্তু এটা সরাসরি বৈষম্য। কারণ গ্রেডিংয়ের কারণে জব মার্কেটেও আমরা নিজেদের তুলে ধরার সুযোগ পাই না। আমাদের মধ্যে এমনও শিক্ষার্থী আছেন, যারা রিটেকের অর্থ জোগাড় করতে গিয়ে পরিবারের জমি বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন। গ্রেডিং সিস্টেমে পরিবর্তন আনা এখন সময়ের দাবি।’
‘ইউজিসি স্ট্যান্ডার্ড বেঁধে দেয়ার পরে ২০২৩ সালের ফল সেমিস্টার থেকে আমরা সেটা অনুসরণ করা শুরু করি। এতে মানের কোনো ঘাটতি হয়েছে বলে মনে হয়নি আমাদের। বরং সম্প্রতি ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি অনেকদূর এগিয়েছে —প্রফেসর এম রুহুল আমিন, ডিন, ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি
ইউজিসির গ্রেডিং স্ট্যান্ডার্ড বেঁধে দেওয়ার আগে ব্যতিক্রম স্কেলিং করত বেসরকারি ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি। তবে ২০২৩ সালের ফল সেমিস্টার থেকে বিশ্ববিদ্যালয়টি ইউজিসির নিয়মে গ্রেডিং শুরু করে। এতে শিক্ষার মান এবং মানসম্মত শিক্ষার্থী পেতে সমস্যায় পড়ছে কি-না জানতে চাইলে ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং অনুষদের ডিন প্রফেসর এম রুহুল আমিন জানান, ইউজিসি স্ট্যান্ডার্ড বেঁধে দেয়ার পরে ২০২৩ সালের ফল সেমিস্টার থেকে আমরা সেটা অনুসরণ করা শুরু করি। এতে মানের কোনো ঘাটতি হয়েছে বলে মনে হয়নি আমাদের। বরং সম্প্রতি ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি অনেকদূর এগিয়েছে।
আরও পড়ুন: উচ্চশিক্ষায় সুশাসনের দায়িত্বে থেকে নিজেই নানা অপকর্মে জড়ান ড. সাজ্জাদ
তবে খোঁজ নিয়ে দেখা যায় ব্যতিক্রম গ্রেডিং পদ্ধতি নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার্থীরা ক্ষোভ প্রকাশ করে আসছে দীর্ঘদিন থেকে। যদিও শিক্ষার্থীদের এমন দাবিকে আমলে নেয় না বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। তাদের দাবি, শিক্ষার্থীরা ভর্তি হওয়ার আগে থেকে আমাদের গ্রেডিং সিস্টেম সম্পর্কে অবগত হয়। সেক্ষেত্রে এটা নিয়ে পরবর্তী প্রতিক্রিয়া অমূলক।
একাধিক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সাথে কথা হলে তারা বিষয়টি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। জানা যায়, সম্প্রতি কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা গ্রেডিং সিস্টেম পরিবর্তনের জন্য আন্দোলন করেন। তবে এতেও হিতে বিপরীত হয়। উল্টো শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ এনে তাদের হয়রানি করা হয়।
‘ইউজিসির স্ট্যান্ডার্ড থাকলে সবাইকে সেটা মানা উচিত। তবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মান রক্ষায় নিজেদের স্বকীয়তা বজায় রাখার বিষয়টিও অগুরুত্বপূর্ণ নয়। এক্ষেত্রে একটা সমাধানে আসা জরুরি —অধ্যাপক ড. আনোয়ার হোসেন, সদস্য, ইউজিসি
সম্প্রতি গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর বড় পরিবর্তন আসে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনে। বিভাগীয় দায়িত্ব বণ্টন হয় নিয়ন্ত্রণ সংস্থাটির চেয়ারম্যান ও সদস্যদের মাঝে। এতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বিভাগের দায়িত্বে আসেন নবনিযুক্ত সদস্য অধ্যাপক ড. আনোয়ার হোসেন। তিনি জানান, বিষয়টি আমার জানা ছিল না। ইউজিসির স্ট্যান্ডার্ড থাকলে সবাইকে সেটা মানা উচিত। তবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মান রক্ষায় নিজেদের স্বকীয়তা বজায় রাখার বিষয়টিও অগুরুত্বপূর্ণ নয়। এক্ষেত্রে একটা সমাধানে আসা জরুরি। আমরা শীঘ্রই বিষয়টি নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সাথে বসব।
আরও পড়ুন: ডা. জাফরুল্লাহ’র মৃত্যুর ১০ দিনের মাথায় দখল গণস্বাস্থ্যের মেডিক্যাল কলেজ
বিষয়টি নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক এস এম এ ফায়েজ দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ইউজিসির তরফ থেকে যেটা করণীয় আমরা খুব সিরিয়াসলি সেটা নিশ্চিত করব। গ্রেডিং সিস্টেম কারা মানছে কারা মানছে না আমরা বিষয়গুলো খোঁজ নেব। আমরা কেবল দায়িত্ব নিয়েছি। এটা একক কোন কাজ না, এটা টিমওয়ার্ক। পাশাপাশি ইউজিসির আইনে যে নির্দেশনা রয়েছে সে অনুযায়ী মেম্বারদের মতামতের ভিত্তিতে এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়া হবে।