ব্যাংক হিসাব জব্দ

১৮ বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০ হাজার শিক্ষক-কর্মকর্তার বেতন-বোনাস নিয়ে শঙ্কা

জাতীয় রাস্ব ভবন।
জাতীয় রাস্ব ভবন।   © ফাইল ছবি

দেশের ২৮ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাংক হিসাব জব্দ করার পর এখন পর্যন্ত ১০টি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের হিসেব সচল করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কর অঞ্চল-১১ কর্তৃপক্ষ। ফলে এনবিআরের নির্ধারিত ১৫ শতাংশ বকেয়া কর পরিশোধ না করায় এখনো জব্দই রয়েছে ১৮টি বেসরকারি উচ্চশিক্ষালয়ের ব্যাংক হিসাব। সর্বশেষ বৃহস্পতিবার (৪ এপ্রিল) পর্যন্ত ১০টি বিশ্ববিদ্যালয় আংশিক বা পূর্ণ কর পরিশোধসহ নির্ধারিত সময়ে পরিশোধের আশ্বাসে তাদের ব্যাংক হিসাব সচল করে কর্তৃপক্ষ। ব্যাংক হিসেব বন্ধ থাকায় কোনো অর্থই ব্যয় করতে পারছে না বাকী বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। ফলে আসন্ন ঈদকে ঘিরে অনিশ্চয়তা রয়েছে এসব উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের আসন্ন ঈদুল ফিতরের আগে বেতন-বোনাসসহ অন্যান্য সুবিধাদি পাওয়া নিয়েও।

বর্তমানে রাজস্ব বোর্ডের কর অঞ্চল-১১ এর অধীনে মোট ৫২টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। তবে কিছু বিশ্ববিদ্যালয় করের আওতায় না থাকা এবং কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে আইনগত জটিলতা থাকায় সবাইকে করের নোটিশ প্রদান করেনি জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এর মধ্যে নির্ধারিত সময়ে কর পরিশোধ না করার অভিযোগে মোট ২৮টি বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাংক হিসাব জব্দ সরকারের জন্য সিংহভাগ রাজস্ব আহরণকারী এ প্রতিষ্ঠানটি। এতে আসন্ন ঈদে বেতন ও বোনাসসহ সংশ্লিষ্ট পাওনাদি পাওয়া নিয়ে শঙ্কায় পড়েছেন প্রায় ১৫ থেকে ২০ হাজার শিক্ষক-কর্মকর্তা ও কর্মচারী।

কিছু বিশ্ববিদ্যালয় এর মধ্যে করের অর্থ পরিশোধ করেছে, কেউ কেউ সময় চেয়ে আবেদন করেছে এবং আমরা তা বিবেচনা করছি। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আমাদের কাছে আবেদন করলে আমরা বিবেচনা করার চেষ্টা করবোউপ-কর কমিশনার (অঞ্চল-১১) মো. রকিবুল হাফিজ।

ব্যাংক হিসেব বন্ধ থাকায় ঈদের আগে বেতন-বোনাসসহ সব ধরনের খরচাদি বন্ধ রয়েছে এমন তালিকায় রয়েছে—ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশ (ইউল্যাব), ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি (ইডব্লিউইউ) এবং সাউথইস্ট ইউনিভার্সিটিসহ (এসইইউ) মোট ১৮টি বেসরকারি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান।

বৃহস্পতিবার পর্যন্ত জব্দ হওয়া অ্যাকাউন্ট খুলে দেওয়া হয়েছে দেশের প্রথম বেসরকারি উচ্চশিক্ষালয় নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি (এনএসইউ), ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি (ডিআইইউ), আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ (এআইইউবি), ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি (আইইউবি), ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ (ডব্লিউইউবি) এবং প্রাইম ইউনিভার্সিটিসহ মোট ১০টি প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসেব। এসব প্রতিষ্ঠান করের পুরো অর্থ, আবার কেউ আংশিক পরিশোধ করায় তাদের অ্যাকাউন্ট খুলে দেওয়া হয়েছে। এছাড়াও আংশিক কর পরিশোধকারী প্রতিষ্ঠানগুলো বাকি অর্থ পরিশোধের জন্য সময় চেয়ে আবেদন করেছে কর্তৃপক্ষের কাছে।

আরও পড়ুন: ৫৪ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের পকেটে বার্ষিক উদ্বৃত্ত ১২৫০ কোটি টাকা

এর আগে গত ২৭ ফেব্রুয়ারি দেশের সব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে তাদের হাতে থাকা উদ্বৃত্ত থাকা অর্থ থেকে ১৫ শতাংশ ট্যাক্স সরকারকে দিতে হবে বলে রায় দেন আপিল বিভাগ। তবে এখনও এ রায়ের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করা হয়নি। এছাড়াও এখনও আত্মপক্ষ সমর্থন করে আইনি লড়াই চালিয়ে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে বেসরকারি খাতের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর। আর শুরু থেকেই সরকারের এমন সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রতিষ্ঠাতা ও উদ্যোক্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতি (এপিইউবি)।

ব্যাংক হিসেব জব্দ হওয়া প্রতিষ্ঠানের তালিকায় রয়েছে ইউল্যাবও। উচ্চশিক্ষালয়টির স্থায়ী ক্যাম্পাস থেকে তোলা। ছবি: ফাইল থেকে

এপিইউবি’র পক্ষ থেকে গণমাধ্যমে পাঠানো সর্বশেষ সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, আদালত কর্তৃক পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ এবং তদনুযায়ী আয়কর প্রদান সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের কোনোরূপ সুযোগ না দিয়ে রোজা চলাকালীন সময় মুসলমানদের বৃহৎ ধর্মীয় উৎসব পবিত্র ঈদ-উল-ফিতরের পূর্বে বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট স্থগিত করা একটি অমানবিক পদক্ষেপ হিসেবে প্রতীয়মান। এর ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশাল সংখ্যক শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী পরিবারের বেতন, বোনাস এবং অন্যান্য প্রদেয় বিল পরিশোধ করা সম্ভব হবে না। সেজন্য আয়কর প্রদান সংক্রান্ত রিট আপিলের নিষ্পত্তি আগেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর স্থগিতকৃত ব্যাংক অ্যাকাউন্ট পুনরায় চালু করার অনুরোধও জানানো হয়েছে একই বিজ্ঞপ্তিতে।

সরকারের এমন কঠোর সিদ্ধান্তের আগে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে আরও সময় দেওয়া প্রয়োজন ছিল বলে মনে করেন ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস (ইউল্যাব) ট্রেজারার অধ্যাপক. ড. মিলান কুমার ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, এ সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে আরও সচেতন হওয়া দরকার ছিল। ঈদের আগে এমন সিদ্ধান্তে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং সংশ্লিষ্টরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের সিংহভাগ বেতন-ভাতাই এখনও দেওয়া হয়নি—যুক্ত করেন তিনি।

আদালতের পূর্ণাঙ্গ আদেশের পূর্বে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অ্যাকাউন্ট বন্ধ রাখা ‘অমানবিক’। ঈদের আগের এ সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ব্যাংক হিসাব জব্দের ফলে প্রায় ১৫ থেকে ২০ হাজার শিক্ষক-কর্মকর্তা ও কর্মচারী বেতন-ভাতা থেকে বঞ্চিত হবেনবেলাল আহমেদ, পরিচালক, বাংলাদেশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতি।

সাউথ ইস্ট ইউনিভার্সিটি (এসইইউ) ট্রেজারার অধ্যাপক ড. অরুণ কান্তি গুহ দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, এমন সিদ্ধান্তের ফলে আমাদের খুব কষ্ট হচ্ছে, খুবই খারাপ অবস্থা যাচ্ছে আমাদের। আমরা আমাদের শিক্ষক-কর্তকর্তা বা সংশ্লিষ্টদের কোনো অর্থই দিতে পারছি না। আমরা কিছুই করতে পারছি না। ঈদের আগে আগামী ৮ তারিখ আমাদের একটি শুনানি আছে—দেখা যাক, সেখানে কী সিদ্ধান্ত হয়।

আদালতের পূর্ণাঙ্গ আদেশের পূর্বে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অ্যাকাউন্ট বন্ধ রাখাকে ‘অমানবিক’ বলছেন বাংলাদেশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতির (এপিইউবি) পরিচালক বেলাল আহমেদ। তিনি দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, কর আদায়ে আদালতের রায়ের পূর্ণাঙ্গ কপি আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করা উচিত ছিল। ঈদের আগের এ সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ব্যাংক হিসাব জব্দের ফলে প্রায় ১৫ থেকে ২০ হাজার শিক্ষক-কর্মকর্তা ও কর্মচারী বেতন-ভাতা থেকে বঞ্চিত হবেন। তবে সমিতির পক্ষ থেকে বন্ধ অ্যাকাউন্টগুলো সচল করতে এনবিআরের সাথে একটি বৈঠকের চেষ্টা করা হচ্ছে বলেও জানান তিনি।

আরও পড়ুন: বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থগিত ব্যাংক অ্যাকাউন্ট পুনরায় চালুর নির্দেশনা চায় এপিইউবি

বিষয়টি নিয়ে জানতে কথা হয় সংশ্লিষ্ট কর অঞ্চলের উপ-কর কমিশনার মো. রকিবুল হাফিজের সাথে। তিনি দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে জানিয়েছেন, আমরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে চিঠি দিয়ে কর পরিশোধের আহ্বান জানিয়েছিলাম। যারা তা করেনি তাদের অ্যাকাউন্ট নিয়ম অনুযায়ী বন্ধ করা হয়েছে। এর মধ্যে কিছু বিশ্ববিদ্যালয় অর্থ পরিশোধ করেছে, কেউ কেউ সময় চেয়ে আবেদন করেছে এবং আমরা তা বিবেচনা করছি। 

আদালতের আদেশের সারাংশ রয়েছে জানিয়ে এই উপ-কর কমিশনার বলেন, ঈদের আগে আমাদের আরও দুই কার্যদিবস অফিস রয়েছে। যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসেব জব্দ করা হয়েছে, এর মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আমাদের কাছে আবেদন করলে আমরা বিবেচনা করার চেষ্টা করবো।


সর্বশেষ সংবাদ