ঢাবির ছাত্র না হলে জীবন অসম্পূর্ণ থেকে যেত: সলিমুল্লাহ খান
- টিডিসি রিপোর্ট
- প্রকাশ: ০৫ জুলাই ২০২১, ০৭:২৬ PM , আপডেট: ০৫ জুলাই ২০২১, ০৭:২৬ PM
লেখক ও বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খান বলেছেন, আমি যদি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র না হতাম, আমার জীবন অসম্পূর্ণ থেকে যেত। সম্প্রতি ‘প্যারিসের জানালা’ ফেসবুক পেজে ‘শতবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (১৯২১-২০২০): সৌরভ ও গৌরবের সেকাল এবং একাল’ শীর্ষক আলোচনায় তিনি এ মন্তব্য করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের এই সাবেক শিক্ষার্থী আক্ষেপ করে বলেন, ‘একটা সত্য কথা বললে অপ্রীতিকর হয়, সবাই আমাকে বলে আপনি এটা বলবেন না। আমি আইন বিভাগে কোনো ভাল শিক্ষকের দেখা পাইনি। আমি দুঃখিত রওনক আপা (ড. রওনক জাহান) আপনি যে শিক্ষকদের নাম করলেন, আমার নাম করার মতো একটা শিক্ষকও আমি পাইনি। আইন বিভাগে ৩৫ জন শিক্ষক ছিলেন আমাদের সময়ে। প্রথম দিন ক্লাসে গিয়ে অবাক হয়ে গেলাম। শিক্ষকেরা শুধু টেক্সট বই ধরে পড়াচ্ছেন। সারা বছর একটি বই পড়তে হবে। যেমন আমি এমএ পাস করেছি, যাকে এলএলএম বলে। এই সময়ে কোনোদিন আমাকে একটি প্রবন্ধ লিখতে হয়নি। আমি অনেক ভাল ভাল শিক্ষক পেয়েছি বিশ্ববিদ্যালয়ে। যেমন একজন অধ্যাপক আবু হেনা মোস্তফা কামাল। কিন্তু তারা কেউ আমার বিভাগীয় শিক্ষক ছিলেন না। আর দুজন লোকের নাম না বললে গোনাহ হবে, একজন হলেন আহমদ ছফা তিনি আমাকে অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের কাছে নিয়ে গেলেন।’
সলিমুল্লাহ খান বলেন, ‘‘অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক প্রথমেই আমাকে যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক জোসেফ স্টার্কের অরিজিনস অব ইসলামিক জুরিসপ্রুডেন্স বইটা দিলেন। ইহুদি অধ্যাপকের বই। আমি একজন প্রথমবর্ষের ছাত্র, আমাকে উনি বললেন, ‘বইটা নিয়ে যান’, আমি তো বইটা ফেরত নাও দিতে পারি। কোথাও লিখেও রাখলেন না। বললেন, ‘আইনে ভর্তি হয়ছেন তো এটা পড়েন’, এ ধরনের অনেক ভাল শিক্ষক আমি পেয়েছি।’’
আরও পড়ুন: অনলাইনে পরীক্ষা, যা ভাবছেন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা
অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খান বলেন, ‘আমার কাছে শ্রেষ্ঠ শিক্ষক হচ্ছেন যিনি আমাকে একটা বই পড়তে দেন। তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরি থেকে আমরা বই নিতে পারতাম না। শুধু সেমিনার থেকে দুটি বই নেওয়া যেত, এতে আমার তৃষ্ণা মিটতো না। চট্টগ্রাম কলেজের ছাত্র ছিলাম। তখন আমার নিজের দুহাজারের মতো বই ছিল। সেগুলো কলেজের হোস্টেলেই রাখতাম। এখন ঢাকা এসে তো আমি এতিমের মতো হয়ে গেলাম। আব্দুর রাজ্জাক সাহেবের সাথে দেখা হওয়াটা ছিল আমার স্মরণীয় অভিজ্ঞতা। তিনি যখন মারা যান তখন আমি এমেরিকাতে। প্রথম আলোতে একটা লেখা পাঠিয়েছিলাম, সেখানে আমি বলেছিলাম, আমার কাছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং আব্দুর রাজ্জাক সমার্থক। এটা আপনারা একটু বাড়াবাড়ি বলতে পারেন।’
সলিমুল্লাহ বলেন, ‘সবাই আমাকে বলছেন, আপনি তো এই বিশ্ববিদ্যালয়কে পছন্দ করেন না। আমি বলি, এই বিশ্ববিদ্যালয় আমার জ্ঞানদায়িনী মা, আলমা মাতের। কিন্তু মায়ের অবমাননা দেখলে, আমার দুচোখ দিয়ে পানি আসে। যেটা আহমদ ছফা ১৯৯৩ সালের উপন্যাস গাভী বৃত্তান্ততে মোটামুটি ভালভাবে চিত্রিত করেছেন। সেই বেদনার কথা বললেও ঢাকায় লোকে ধরে পিটাতে চায়।’
আরও পড়ুন: গবেষণায় চৌর্যবৃত্তি ঠেকাতে নীতিমালা অনুমোদন জাবির
ইউল্যাবের অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খান বলেন, ‘আমি যদি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র না হতাম, আমার জীবন অসম্পূর্ণ থেকে যেত। সত্যি কথা বলতে গেলে আমি এই কলা ভবনে, মধুর ক্যান্টিনে, শরীফ মিয়ার ক্যান্টিনে, লাইব্রেরির বারান্দায় আমার বন্ধুবান্ধবদের কাছ থেকে যা শিখেছি। আমার শ্রেষ্ঠ বন্ধু ছিলেন প্রয়াত তারেক মাসুদ, কবি মোহন রায়হান, পিয়াস করিম, কবি রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ। আমরা বন্ধুবান্ধবের কাছে অনেককিছু শিখেছি। আমার দুর্ভাগ্য যে আইন বিভাগে আমি কোনো ভাল শিক্ষক পাইনি। আমাকে প্রথম বিভাগে দ্বিতীয় স্থান দেওয়া হয়েছিল, পরে সেটা নিয়ে অনেক স্ক্যান্ডাল হয়েছিল। আমি সিনেট সদস্য হয়েছিলাম ছাত্র প্রতিনিধি হিসেবে। তখন উপাচার্য ছিলেন ফজলুল হালিম চৌধুরী। উপাচার্য পরে আমাকে বললেন, তোমার ফলাফল সংশোধন করা হলো, এখন আর মামলা-টামলা কইরো না। আমাকে প্রথম বিভাগে দ্বিতীয় স্থান দেওয়া হয়েছিল, আসলে আমি প্রথম স্থানই পেয়েছিলাম। সেটাই পরে বলবৎ হয়েছে। কিন্তু ওই যে যিনি করেছিলেন তিনি তো আমারই শ্রদ্ধেয় শিক্ষক। আমি তাঁর নামটা বলব না। তিনি এখন মৃত। তিনি যে কাজটা করেছিলেন, বললেই বোঝা যাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের নৈতিকতার প্রশ্নটি। আমার খাতায় মূল শিক্ষক দিয়েছিলেন ৭৬ নম্বর। আর তিনি পরীক্ষা কমিটির প্রধান এবং ডিন ছিলেন, তিনি সেটাতে দিয়েছিলেন ৪৩ নম্বর। দুজনের মধ্যে ব্যবধান ২০-এর বেশি হওয়ায় তৃতীয় পরীক্ষকের কাছে গেল। তিনি আইন ভঙ্গ করে নিজেকে তৃতীয় পরীক্ষক নিয়োগ করেছিলেন।’
ভার্চুয়াল অনুষ্ঠানটিতে আরও আলোচক হিসেবে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ড. রওনক জাহান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আব্দুল মজিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী অ্যাডভোকেট আরিফ খান।
অনুষ্ঠানটির সঞ্চালনা করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলামনাই এসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি রকীবউদ্দিন আহমেদ।