বিদেশে পড়তে যাওয়ার প্রবণতা কমছে ভারতীয় শিক্ষার্থীদের

  © সংগৃহীত

ভারতীয় শিক্ষার্থীদের জন্য উচ্চশিক্ষার গন্তব্য হিসেবে আমেরিকা, ইংল্যান্ড, কানাডা এবং অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশ বরাবরই শীর্ষে ছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে দেখা যাচ্ছে, বিদেশে পড়াশোনার জন্য ভারতের শিক্ষার্থীদের আগ্রহ কমছে। সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে বিদেশগামী শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১৫ শতাংশ কমে গেছে। এতে কি শুধুই রাজনৈতিক কারণ দায়ী, নাকি এর পেছনে আরও গভীর সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব কাজ করছে?

পরিসংখ্যান কী বলছে?

ভারতের সংসদে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ২০২৪ সালের বিদেশে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের পরিসংখ্যান তুলে ধরেছে। তাতে দেখা যাচ্ছে, ২০২৩ সালে যেখানে ৮,৯২,৯৮৯ জন ভারতীয় শিক্ষার্থী বিদেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করছিলেন, সেখানে ২০২৪ সালে এই সংখ্যা নেমে দাঁড়িয়েছে ৭,৫৯,০৬৪ জনে। অর্থাৎ এক বছরে সোয়া লাখেরও বেশি শিক্ষার্থী কমেছে।

সবচেয়ে বেশি শিক্ষার্থী কমেছে কানাডায়, যেখানে ২০২৪ সালে শিক্ষার্থী সংখ্যা কমেছে ৪২ শতাংশ। ইংল্যান্ডে এই হার ২৮ শতাংশ, আমেরিকায় ১৩ শতাংশ। তবে এর বিপরীত চিত্রও আছে। কিছু দেশে ভারতীয় শিক্ষার্থীদের সংখ্যা বেড়েছে। রাশিয়ায় শিক্ষার্থী বেড়েছে ৩৪ শতাংশ, ফ্রান্সে ১৪ শতাংশ। বিশেষত, মেডিকেল পড়তে রাশিয়ায় ভারতীয় শিক্ষার্থীদের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে।

কেন কমছে ভারতীয়দের বিদেশে পড়তে যাওয়ার সংখ্যা?

এই প্রবণতার পেছনে একাধিক কারণ রয়েছে। 

রাজনৈতিক ও অভিবাসন নীতির কড়াকড়ি: বিশেষজ্ঞদের মতে, বিশ্বজুড়ে ডানপন্থী রাজনীতির উত্থান এবং কঠোর অভিবাসন নীতির কারণে বিদেশে পড়াশোনা করা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।

আমেরিকা: ২০২৪ সালের নির্বাচনী আবহে অভিবাসনবিরোধী মনোভাব আরও জোরদার হয়েছে।

কানাডা: ভারত-কানাডা সম্পর্কের টানাপোড়েনের কারণে ভিসা পেতে সমস্যা হচ্ছে।

ইউরোপের অনেক দেশেও অভিবাসন কঠিন হচ্ছে, ফলে ভারতীয় শিক্ষার্থীদের বিকল্প পথ খুঁজতে হচ্ছে।

বিশিষ্ট রাজনৈতিক বিশ্লেষক রাজাগোপাল ধর চক্রবর্তী বলছেন, “ডোনাল্ড ট্রাম্পের আমেরিকা বা কানাডার বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি ভিনদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য আদর্শ নয়। অন্যদিকে, রাশিয়া বা ফ্রান্সে শিক্ষার্থীদের জন্য তুলনামূলক সুবিধাজনক পরিবেশ রয়েছে।”

কানাডায় শিক্ষার্থী কমার বড় কারণ

বিশ্লেষকদের মতে, ভারত-কানাডা সম্পর্কের টানাপোড়েন সরাসরি প্রভাব ফেলেছে শিক্ষার্থী ভিসার ওপর। ২০২৩ সালে শিখ নেতা হরদীপ সিং নিজ্জর হত্যাকাণ্ডের পর দুই দেশের সম্পর্কে অবনতি ঘটে, যার ফলে ভারতীয় শিক্ষার্থীদের কানাডায় যাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে।

অর্থনৈতিক বাস্তবতা

বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা, চাকরির বাজারে অনিশ্চয়তা এবং উচ্চশিক্ষার খরচ বেড়ে যাওয়ার কারণে অনেক শিক্ষার্থী বিদেশে পড়তে যাওয়ার সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করছেন। অতীতে শিক্ষার্থীরা বিদেশে পড়তে গিয়ে পড়াশোনা শেষে বহুজাতিক সংস্থায় চাকরির সুযোগ খুঁজতেন। কিন্তু বর্তমান চাকরির বাজার সেই নিশ্চয়তা দিচ্ছে না। অনেক বড় প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান কর্মী ছাঁটাই করছে, যা উচ্চশিক্ষার্থীদের অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিচ্ছে।

আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য তপোধীর ভট্টাচার্য বলছেন, “ডানপন্থী রাজনীতির উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে জনকল্যাণমূলক নীতিগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ফলে আমেরিকা-ইউরোপে শিক্ষার্থী ভিসা পাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে।”

রাশিয়ায় মেডিকেল পড়তে যাওয়ার প্রবণতা

রাশিয়া ও ইউক্রেন যুদ্ধের পরও ভারতীয় শিক্ষার্থীরা রাশিয়ায় মেডিকেল পড়তে যাচ্ছেন। কারণ সেখানে— খরচ কম, কঠিন প্রবেশিকা পরীক্ষার ঝামেলা নেই, বৃত্তি ও আবাসনের সুবিধা পাওয়া যায় ও এমবিবিএস ছাড়াও পিএইচডি করতে যাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যাও বেড়েছে।

শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তনও একটি কারণ?

শিক্ষাবিদ পবিত্র সরকার মনে করেন, “ভারতের নিজস্ব শিক্ষাব্যবস্থার গুরুত্ব কমছে, বাজেট কমছে, নিয়োগের সম্ভাবনা কমছে। তাই শিক্ষার্থীরা বিকল্প পথ খুঁজছেন।”

ভবিষ্যৎ প্রবণতা কী হতে পারে?

উচ্চশিক্ষার জন্য ভারতীয় শিক্ষার্থীরা নতুন দেশগুলোর দিকে ঝুঁকতে পারেন, যেমন রাশিয়া, ফ্রান্স, চীন বা সংযুক্ত আরব আমিরাত। ভারতে উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়ন হলে দেশেই পড়তে আগ্রহী হবেন শিক্ষার্থীরা। বিশ্ব রাজনীতির পরিবর্তনের ওপর নির্ভর করবে পশ্চিমা দেশগুলোর অভিবাসন নীতি, যা ভারতীয় শিক্ষার্থীদের সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করবে।

বিদেশে পড়তে যাওয়ার হার কমার পেছনে রাজনীতি, অর্থনীতি, চাকরির বাজার ও অভিবাসন নীতির পরিবর্তন—সবকিছুই ভূমিকা রাখছে। তবে শিক্ষার্থীদের নতুন বিকল্প গন্তব্য খোঁজার প্রবণতা ইঙ্গিত দিচ্ছে, ভবিষ্যতে উচ্চশিক্ষার জন্য ভারতীয়দের গতিপথ আরও বৈচিত্র্যময় হতে পারে।


সর্বশেষ সংবাদ