পুতিন এবং কিমের বন্ধুত্বের পেছনে কি চীনই মূল ভূমিকা রাখছে?

ভ্লাদিমির পুতিন ও কিম জং আন
ভ্লাদিমির পুতিন ও কিম জং আন  © সংগৃহীত

ভ্লাদিমির পুতিন এবং কিম জং উন একটি চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছেন, যেখানে তাদের দুই দেশের বিরুদ্ধে যে কোনো ‘আগ্রাসনে’ তারা পরস্পরকে সহায়তার অঙ্গীকার করেছেন। পিয়ংইয়ং সফরে এসে কিমের সাথে বৈঠকের পর এ ঘোষণা দিয়েছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। আর কিম বলেছেন এটি তাদের সম্পর্ককে ‘একটি নতুন, সহযোগিতার অনন্য মাত্রা’ দিয়েছে। চুক্তিটি তাদের দ্রুত ঘনিষ্ঠ হওয়া সম্পর্ককে আর জমাট বাধাবে বলে পশ্চিমাদের মধ্যে উদ্বেগ তৈরি করেছে।

তবে বিমানবন্দরের টারমাকে রাত ৩টায় স্বাগত জানানো, সৈনিকদের অনার গার্ড, পিয়ংইয়ং এর সড়ক জুড়ে ভ্লাদিমির পুতিন এবং কিম জং আনের বিশাল সব পোট্রেট পাশাপাশি রাখা- এর সবই করা হয়েছে পশ্চিমাদের চিন্তায় ফেলার জন্য।

২০০০ সালের পর প্রথমবারের মতো পুতিনের পিয়ংইয়ং সফর ছিল রাশিয়া এবং উত্তর কোরিয়ার মধ্যে একটি বন্ধুত্বের প্রদর্শনীর সুযোগ। এবং কিমের ইউক্রেন আগ্রাসনে রাশিয়ার প্রতি ‘পূর্ণ সমর্থন’ ঘোষণার মধ্য দিয়ে তারা সেটাই করেছেন। সিউল, টোকিও, ওয়াশিংটন এবং ব্রাসেলস গভীর বিপদ খুঁজে পাবে এসব শব্দের মধ্যে এবং সাজানো বৈঠকগুলোর মধ্যে।

কিন্তু প্রকৃত সত্য হলো দুই নেতাই অনুভব করেছেন যে তাদের পরস্পরকে প্রয়োজন পুতিনের যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার জন্য গোলাবারুদ দরকার আর নিষেধাজ্ঞার কবলে থাকা উত্তর কোরিয়ার দরকার অর্থ। যদিও ওই অঞ্চলের প্রকৃত শক্তি পিয়ংইয়ং নয় এবং তারা তা হতেও চায়নি। রাশিয়া আর উত্তর কোরিয়া- দুই দেশের এই নতুন করে যে বন্ধনের সূত্রপাত তা কৌশলগত কারণেও খুব গুরুত্বপূর্ণ।

কারণ এটি ছিল চীনের দরজায় এবং বেইজিংর জন্য যাতে উস্কানি না হয় সে আশঙ্কা নিয়ে সতর্ক থাকতে হয়েছে দুই দেশকে। বেইজিং পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞায় থাকা উভয় দেশের জন্য বাণিজ্য ও প্রভাবের গুরুত্বপূর্ণ উৎস। যদি পুতিন ‘প্রগাঢ় বন্ধুত্বের’ জন্য কিমের প্রশংসা করেছেন। কিন্তু তিনি অবশ্যই জানেন তারও একটি সীমা আছে। আর সেই সীমাটি হলো চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং।

‘সতর্ক বেইজিং সব দেখছে’

এরই মধ্যে কিছু লক্ষণ দেখা যাচ্ছে, শি তার দুই সহযোগী দেশের মধ্যে ক্রমবর্ধমান সখ্যতায় খুব একটা সন্তুষ্ট নন। খবর বেরিয়েছিল যে বেইজিং পুতিনকে গত মে মাসে প্রেসিডেন্ট শি’র সাথে বৈঠকের পর পিয়ংইয়ং সফরে না যেতে সরাসরিই বলেছিল। মনে হচ্ছে চীনা কর্মকর্তারা সেই সফরে উত্তর কোরিয়াকে টেনে আনাটা পছন্দ করেননি।

শি মস্কোকে সমর্থন দেয়ার বিষয়ে এবং ইউক্রেন যু্দ্ধে সহায়তা হয়- এমন কিছু বিক্রি না করতে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের চাপের মধ্যে আছেন। এবং তিনি এসব সতর্কতা পুরোপুরি উপেক্ষাও করতে পারেন না। এটা শুধু এজন্য নয় যে বিশ্বকে চীনা বাজারের প্রয়োজন। বরং বেইজিংয়ের বিদেশী পর্যটক এবং বিনিয়োগও দরকার বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি হিসেবে নিজের অবস্থান ধরে রাখার জন্য।

দেশটি এখন ইউরোপের একাংশ, থাইল্যান্ড এবং অস্ট্রেলিয়ার জন্য ভিসা মুক্ত ভ্রমণ সুবিধা দিচ্ছে। এবং দেশটির পাণ্ডা আবারো বিদেশের চিড়িয়াখানায় ছাড়া হচ্ছে। চীনের উচ্চাভিলাষী নেতা বৈশ্বিক পর্যায়ে আরো বড় ভূমিকা রাখতে চান এবং যুক্তরাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ করতে চান। তিনি নতুন করে পশ্চিমা চাপ আর চাইবেন না। একইসাথে তিনি মস্কোর সাথেও সম্পর্ক বজায় রাখবেন।

যদিও তিনি ইউক্রেনে আগ্রাসনের নিন্দা করেননি। কিন্তু তিনি রাশিয়ায় উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সামরিক সহায়তাও দিতে পারেননি। সম্ভবত পারমাণবিক অস্ত্র এগিয়ে নিতে কিমের চেষ্টাকে একটি রাজনৈতিক সুরক্ষা দিচ্ছে চীন বার বার জাতিসঙ্ঘে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার প্রস্তাব ঠেকিয়ে দিয়ে। তবে শি সাহসী কিম জং উনের ভক্ত নন।

পিয়ংইয়ংয়ের পারমাণবিক অস্ত্র পরীক্ষা জাপান এবং দক্ষিণ কোরিয়াকে নিজেদের তিক্ততাকে একপাশে ঠেলে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে একটি প্রতিরক্ষা চুক্তিতে নিয়ে এসেছে। উত্তেজনা বাড়লে যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধজাহাজ দেখা যায়, প্রশান্ত মহাসাগরে যা ‘ইস্ট এশিয়ান নেটো’ বিষয়ে শি’র ভয় বাড়িয়ে দিয়েছে।

বেইজিংয়ে অননুমোদন হয়তো উত্তর কোরিয়ায় রাশিয়ান সামরিক প্রযুক্তির বিক্রি বাড়িয়ে দিতে পারে। সেটাও যুক্তরাষ্ট্রের বড় উদ্বেগের কারণ হতে পারে। এনকে নিউজের পরিচালক আন্দ্রেই ল্যাংকভ বলেছেন, আমি মনে করি না রাশিয়া উত্তর কোরিয়াকে বিশাল পরিমাণে কোনো সামরিক প্রযুক্তি দেবে। সেটি করলে রাশিয়ার জন্য ভবিষ্যতে সমস্যা দেখা দিতে পারে।

যদিও উত্তর কোরিয়ার গোলাবারুদ পুতিনের যুদ্ধ প্রচেষ্টাকে সহায়তা করবে, তবে এর জন্য ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তির বিনিময় তার জন্য ভালো চুক্তি হবে না। এছাড়া পুতিন হয়তো উপলব্ধি করবেন যে চীনকে বিরক্ত করার জন্য এটা যথেষ্ট কিছু হবে না। দেশটি রাশিয়া থেকে তেল ও গ্যাস কিনছে যখন বিশ্বে এখন সে অনেকটাই বিচ্ছিন্ন।

পিয়ংইয়ং- এর চীনকে দরকার আরো বেশি। এটি একমাত্র দেশ যেখানে কিম সফর করেছেন। উত্তর কোরিয়ার এক চতুর্থাংশ থেকে অর্ধেক পর্যন্ত তেল আসে রাশিয়া থেকে কিন্তু ৮০ ভাগ ব্যবসাই চীনের সাথে। পুতিন এবং কিম নিজেদের সহযোগী হিসেবে দেখালেও চীনের সাথে তাদের সম্পর্ক আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

চীনকে হারানোর গুরুত্ব বেশি

রাজনীতি বিশ্লেষকেরা মনে করেন, সাম্রাজ্যবাদী পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ঘোষণা সত্ত্বেও, এটা একটি যুদ্ধকালীন অংশীদারিত্ব। এটি আরো অগ্রসর হতে পারে। কিন্তু এখন সেটা অনেকটাই লেনদেনভিত্তিক, এমনকি তাদের অংশীদারিত্বের মাত্রা বাড়লেও। দুই দেশের মধ্যে সমন্বিত কৌশলগত অংশীদারিত্ব চুক্তি সত্ত্বেও পিয়ংইয়ং গোলাবারুদ সরবরাহ অব্যাহত রাখবে এমন নিশ্চয়তা নেই।

বিশ্লেষকরাও মনে করেন রাশিয়া এবং উত্তর কোরিয়া ভিন্ন ধরণের অপারেটিং সিস্টেমে কাজ করে। উত্তর কোরিয়ার মান নিয়েও প্রশ্ন আছে। আরো গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, দেশ দু’টি কয়েক দশক ধরে তাদের সম্পর্ককে অগ্রাধিকার দেয়নি। যখন পশ্চিমাদের সাথে সম্পর্ক ভালো ছিলো তখন পুতিন দু’বার পিয়ংইয়ংয়ের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিলেন এবং উত্তর কোরিয়া যাতে পারমাণবিক কর্মসূচি বন্ধ করে সেজন্য যুক্তরাষ্ট্র, চীন, দক্ষিণ কোরিয়া এবং জাপানের সাথে সুর মিলিয়েছিলেন।

যখন কিম ২০১৮ সালের কূটনৈতিকভাবে প্রবল চাপের মুখোমুখি হয়েছিলেন, তখন তিনি একবার ভ্লাদিমির পুতিনের সাথে সাক্ষাৎ করেছিলেন। তার পর কিমের চওড়া হাসি, আলিঙ্গন ও হাত মেলানো ছিল দক্ষিণ কোরিয়া প্রেসিডেন্টের সাথে। তারা তিনবার পরস্পরের সাথে সাক্ষাৎ করেছেন। তিনি কথিত ‘প্রেমপত্র’ বিনিময় করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাথে। পরে তাদের মধ্যে বৈঠকও হয়েছে।

অন্যদিকে শি ছিলেন তার জন্য প্রথম কোনো আন্তর্জাতিক নেতা, যার সাথে তিনি বৈঠক করেছিলেন। তারা তিনবার বৈঠক করেছেন। সুতরাং বন্ধু তালিকায় পুতিন নতুন। উত্তর কোরিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ত সংবাদপত্রে রাশিয়ার নেতা যে কলাম লিখেছেন সেখানে পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে নিজেদের স্বার্থের কথা বলেছেন।

তবে সেখানে শি’র বিষয়টি আসেনি, যাকে তিনি 'ঘনিষ্ঠ ভাই' হিসেবে সম্বোধন করেছিলেন। এমনকি তার পরিবার চীনা ভাষা শিখছে বলেও বলেছিলেন। তিনি নিশ্চয়ই প্রেসিডেন্ট শিকে ঘণ্টা ধরে অপেক্ষমাণ রাখার সাহস দেখাবেন না, যেমনটি পিয়ংইয়ং এ হয়েছে। তারা দু’জনই চীনের সাহায্যপ্রার্থী এবং চীনকে ছাড়া তাদের শাসন সঙ্কটে পড়বে। ফলে উভয় দেশের দ্বিপাক্ষিক বা বহুপাক্ষি বিষয়ে চীনের ভূমিকা থাকবেই। [সূত্র : বিবিসি]

 

সর্বশেষ সংবাদ