যেভাবে শুরু হলো হরতাল

হরতালে সাধারণত ফাঁকা থাকে নগরীর ব্যস্ততম এলাকাগুলো
হরতালে সাধারণত ফাঁকা থাকে নগরীর ব্যস্ততম এলাকাগুলো  © ফাইল ছবি

হরতাল একটি গুজরাটি শব্দ; আভিধানিক অর্থে ‘বন্ধ বা বন্ধ করে দেওয়া’। প্রাথমিক পর্যায়ে হরতাল ছিল ব্যবসায়ীদের কারবার সংক্রান্ত দাবিদাওয়া আদায়ের লক্ষ্যে চাপ সৃষ্টি ও প্রতিবাদ প্রকাশের কৌশল হিসেবে দোকানপাট, গুদামঘর প্রভৃতি বন্ধ রাখা। পৃথিবীর ইতিহাসে মিশরীয় সভ্যতায় ১১৭০ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম হরতাল বা স্ট্রাইকের তথ্য পাওয়া গেলেও উপমহাদেশে এটি আসে ১৭০০ সালের দিকে। এরপর ১৯২০ ও ১৯৩০-এর দশকে ভারতের রাজনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ করে হরতাল। এসময় মহাত্মা গান্ধী তাঁর নিজ এলাকা গুজরাটে পরপর অনেকগুলো ব্রিটিশ বিরোধী বন্ধ বা ধর্মঘটের ডাক দিয়ে হরতালকে একটি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানিক রূপ দেন। বাংলাদেশে হরতাল জনগণের দাবি আদায়ের জন্য আন্দোলনের একটি সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত রাজনৈতিক পন্থা। তবে রূপভেদে বিশ্বের প্রায় সব দেশে হরতাল থাকলেও ভারতীয় উপমহাদেশেই বেশি দেখা যায় এ রাজনৈতিক হাতিয়ারটির ব্যবহার। এটি গণতন্ত্রবিরোধী হলেও বর্তমানে গণতান্ত্রিক বিভিন্ন দাবি আদায়েও হরতাল পালন করা হয়।

সাধারণত যেকোনো ন্যায়ভিত্তিক সমাজেই সংঘবদ্ধভাবে ক্ষোভ প্রকাশের কতিপয় পথ ও পদ্ধতি থাকে, যদিও সেগুলো একেক সমাজে ভিন্নতর হতে পারে। নির্দিষ্ট দেশে সরকার পরিচালনার ধরনের উপরেও প্রতিবাদের ভাষা ও কৌশলসহ এসব পদ্ধতির হেরফের ঘটে। উদাহরণ হিসেবে নবাব মুর্শিদকুলী খানের ‘চাকলা’ ব্যবস্থার কথা বলা যায়। এ ব্যবস্থায় সকল ক্ষুদ্র জমিদারকে চাকলাদারদের মাধ্যমে সরকারি রাজস্ব পরিশোধ করতে বলা হলে ক্ষুদ্র জমিদারেরা তা মেনে নিতে পারে নি। তারা পূর্বের ন্যায় সরাসরি সরকারকে রাজস্ব দেওয়ার পক্ষে আর্জি জানিয়ে মৃদু প্রতিবাদ গড়ে তোলে। নবাবি সরকার পদ্ধতিতে দাবি-দাওয়া জানানোর জন্য আরজির উপরে অন্য কোনো পদ্ধতি সরকার সহ্য করতো না। আরজির মধ্য দিয়ে পরিচালিত আন্দোলনকে বলা হয়  হুকুমত-ই-বায়াৎ, যার অর্থ খোদ সরকার ব্যতীত অন্য কোনো কর্তৃপক্ষ তাদের নিকট গ্রহণযোগ্য নয়।

ইতিহাস:
বৈশ্বিক ইতিহাসে প্রথম দিকে রেকর্ড করা হরতাল অ্যাকশনটি ছিল খ্রিষ্টপূর্ব ১১৭০ সালের দিকে। তৎকালীন দাইর আল মদিনা যেটি বর্তমান মিশর সেখানকার মন্দিরের কর্মীরা তাদের দাবি আদায়ে প্রথম স্ট্রাইক বা আমাদের পরিচিত হরতাল পালন করে। এরপর ষোড়শ শতাব্দীতে স্ট্রাইক হয় ইংল্যান্ডে। পরবর্তী সপ্তদশ শতাব্দীতে এটি জনপ্রিয়তা পায়। তারপর বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দাবি আদায়ের অন্যতম মাধ্যম হয়ে ওঠে হরতাল। আঠারো ও উনিশ শতকে ইউরোপ, আমেরিকা ও এশিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশেই নিয়মিতভাবে পালিত হয় হরতাল। আর বিংশ ও একবিংশ শতাব্দীতে এমন কোনো বছর ছিল না যে যখন কোনো হরতাল পালিত হয়নি। উন্নত, উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশগুলোতে বিভিন্ন সময়ে নানা কারণে পালিত হয়েছে হরতাল। এসব হরতাল পালন করেছে বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও নাগরিক সংগঠন; তবে এতে বেশি অবদান ছিল রাজনৈতিক দলগুলোরেই।

বিভিন্ন দাবিতে স্টাইক করেন উন্নত বিশ্বের নাগরিকরাও

উপমহাদেশের ইতিহাস বলছে, রংপুরের প্রজা সমাজ ১৭৮৩ সনে ইজারাদার দেবী সিংহের অত্যাচারের বিরুদ্ধে ডিং বা বিদ্রোহ ঘোষণা করে। ডিং ছিল দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত খাজনা দেয়া বন্ধ রাখার আন্দোলন। এই আন্দোলনে প্রজারা সরকারের বিরুদ্ধে নয়, বিদ্রোহ প্রকাশ করেছিল সরকার কর্তৃক নিয়োগকৃত স্থানীয় কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে। রংপুরের প্রজাদের এই ডিং আন্দোলনের আদলে পরবর্তী সময়ে যশোহর-নদীয়া-পাবনার নীলচাষীদের ডঙ্কা আন্দোলন গড়ে ওঠে। ডঙ্কা এক রকমের ঢোল। ১৮৫৯-৬০ সনের এই আন্দোলনে বাংলার নীল চাষিরা ডঙ্কা বাজিয়ে ঘোষণা দেয় যে, তারা আর নীল চাষ করবে না। একটি ডঙ্কার আওয়াজ শোনামাত্র দূরে আরেকটি ডঙ্কা বাজানো মানে ছিল সেখানেও ওই আন্দোলনের শরিকরা সংহতি ঘোষণা করছে। 

একইভাবে ১৮৫০ ও ১৮৬০-এর দশকে ফরায়জি আন্দোলনের কৌশল ছিল ‘জোট’। জমিদার কর্তৃক বেআইনি ও অন্যায়ভাবে আরোপিত আবওয়াব (খাজনাতিরিক্ত চাঁদা) আদায়ের বিরুদ্ধে প্রজারা জোট গঠন করে প্রতিরোধ রচনা করে। প্রতি পরগণায় কৃষকদের নিয়ে জোট গঠন করা হয়। স্থানীয় জোটগুলো সংশ্লিষ্ট হয় আঞ্চলিক জোটের সঙ্গে। আঞ্চলিক জোট সমন্বয়ে গঠিত হয় কেন্দ্রীয় জোট। ১৮৭৩ সালের পাবনা কৃষক বিদ্রোহ সংগঠকরা যে আন্দোলন পরিচালনা করে তা ছিল আজকের ধর্মঘটের অনুরূপ। ‘ধর্মঘট’ হচ্ছে হিন্দু কৃষক পরিবারের এক দেবতার প্রতীকস্বরূপ পাত্র। এই পাত্র স্পর্শ করে প্রজারা প্রতিজ্ঞা করে যে প্রচলিত ও প্রতিষ্ঠিত খাজনা হারের উপরে তারা কোনো বাড়তি খাজনা দেবে না।

শিল্প বিপ্লবের পর ইংল্যান্ডে প্রায়ই স্ট্রাইক করে বঞ্চিতরা

নিজেদের ন্যায্য দাবি আদায়ের জন্য সংগঠিতভাবে প্রতিবাদ ব্যক্ত করা বাংলার ইতিহাসে নতুন কিছু নয়। শুধু সময় ও স্থানভেদে এর ধরন ও পদ্ধতিতে পরিবর্তন ঘটেছে। ইউরোপীয় ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন দ্বারা প্রভাবিত হয়ে শিল্প শ্রমিকরা বিশ শতকের ত্রিশের দশক থেকে মাঝেমধ্যেই ধর্মঘটের আয়োজন করে আসছে। শিল্পশ্রমিকদের ধর্মঘট পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক অঙ্গনেও বিস্তৃত হয়। রাজনৈতিক ধর্মঘট, যা প্রায়শই হরতাল নামে অভিহিত হয়, ঔপনিবেশিক শাসকদের উৎখাতের আন্দোলনে একটি শক্তিশালী উপাদান হিসেবে আবির্ভূত হয়। ১৯২০-এর দশক থেকে পঞ্চাশের দশক অবধি হরতাল ও ধর্মঘটকে সমার্থক হিসেবেই গণ্য করা হত। 

আর ষাটের দশক থেকে রাজনৈতিক আন্দোলনে হরতালকেই ধর্মঘটের চেয়ে অধিকতর জোরদার মাধ্যম হিসেবে গণ্য করা হতে থাকে। মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে গণমানুষকে আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ করতে হরতাল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ১৯৮০-র দশকে হরতাল বাংলাদেশের রাজনৈতিক আন্দোলনে একটি বহুল ব্যবহৃত কৌশল হিসেবে আবির্ভূত হয়। বিরোধী দলসমূহ জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ-এর শাসনকে (১৯৮২-৯১) অবৈধ ঘোষণা করে ঘন ঘন হরতাল ডেকে প্রশাসনকে অকেজো করে দেয় এবং তাঁর সরকারের পতন ঘটে। পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বিরোধী দলসমূহ বেগম খালেদা জিয়ার সরকারকে (১৯৯১-১৯৯৬, ২০০১-২০০৬)  উপর্যুপরি হরতালের মাধ্যমে তীব্র চাপে রাখে। শেখ হাসিনার প্রশাসনও (১৯৯৬-২০০১) হরতালের চাপ থেকে মুক্ত ছিল না।

হরতালে যে-সব কার্যক্রম থাকে:
শান্তিপূর্ণ হরতালের মূল কার্যক্রম হয়ে থাকে প্রতিবাদ মিছিল এবং সমাবেশ। সাধারণত হরতাল সমর্থকরা রাজপথে বেরিয়ে একত্র হয়ে উচ্চস্বরে নিজেদের দাবি-দাওয়া জানান দিয়ে থাকেন। কিন্তু কখনও কখনও এই পদ্ধতির ব্যবহার করতে গিয়ে মাত্রাতিরিক্ত কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়া, কিংবা আইন-বহির্ভূত কাজে নেমে যাওয়া হরতালকে শান্তিপূর্ণ রাখে না। তখন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী হরতাল সমর্থকদের বাধা দিতে বিভিন্ন পদ্ধতির ব্যবহার করে থাকেন। এ ধরনের দাঙ্গা মোকাবেলায় পুলিশের বিশেষ দাঙ্গা বাহিনী নিয়োজিত হয়ে থাকে। 

সময়ের পরিক্রমায় দাবি আদায়ের অন্যতম হাতিয়ার ছিল স্ট্রাইক বা হরতাল

পুলিশ সাধারণত লাঠি দিয়ে আঘাত করা (লাঠিচার্জ), গরম পানি ছিটিয়ে দেয়া, কাঁদানে গ্যাস (টিয়াল শেল) ছুঁড়ে দেয়া, কিংবা রাবার-বুলেট দিয়ে গুলি করে আহত করে হরতাল সমর্থকদেরকে ছত্রভঙ্গ করা হয়। কিছু ব্যতিক্রম ক্ষেত্রে পুলিশও বেআইনিভাবে বন্দুকের বাট, কিংবা বুট দিয়ে পিকেটারদের উপর চড়াও হতে দেখা গেছে। পুলিশের এই মারমুখী আচরণ অধিকাংশ সময়ই হরতাল সমর্থকরা সুনজরে দেখেন না। এবং এজন্য তারা পাল্টা আক্রমণ করতে ইট-পাটকেল ছোঁড়েন কিংবা নিরাপত্তা বাহিনীর ছুঁড়ে দেয়া টিয়ার শেল তুলে আবার নিরাপত্তা বাহিনীর দিকেই ছুঁড়ে মারেন। এতে অনেক ক্ষেত্রেই উভয়পক্ষেই হতাহতের ঘটনা ঘটতে দেখা যায়। আর এসব ক্ষেত্রে ধৃত পিকেটারদের গ্রেফতার করে কারাগারে নিয়ে যায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

পরিসংখ্যান যা বলছে:
যদিও হরতাল গণতন্ত্রের ঘোর বিরোধীতাস্বরপ, তবুও বর্তমানে গণতান্ত্রিক দাবি আদায়ে হরতাল পালন করে রাজনৈতিক দলগুলো। বাংলাদেশে মোট কতবার হরতাল হয়েছে তার কোন সুনির্দিষ্ট হিসাব না থাকলেও পরিসংখ্যান বলছে, দেশ বিভাগের পর ১৯৪৭ সালের পর থেকে ২০১৩ সালের অক্টোবর পর্যন্ত দেশে মোট ৪৫৯ দিন জাতীয়ভাবে হরতাল পালিত হয়েছে। আর বেসরকারি সংস্থা সিপিডির তথ্য বলছে, ১৯৪৭ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত বছরে গড়ে তিন দিন হরতাল হয়েছে।

এরপর ১৯৭১ থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত বছরে গড়ে সাত দিন এবং ১৯৮৩ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত প্রতিবছর ১৭ দিন গড়ে হরতাল হয়েছে। আর গণতান্ত্রিক সরকার আসার পর ১৯৯১ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত প্রতিবছর গড়ে ৪৬ দিন করে হরতাল হয়েছে। ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে ৪৭ দিন জাতীয়ভাবে হরতাল পালিত হয়েছে। এর বেশির ভাগ হরতাল হয়েছে ১৯৬৬ সালের ছয় দফা থেকে শুরু করে ১৯৭০ সালের মার্চ পর্যন্ত।

স্বাধীনতার পর ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট পর্যন্ত জাতীয় হরতাল হয়েছে মাত্র পাঁচ দিন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৮২ সালের ২৩ মার্চ পর্যন্ত দেশে ছয়টি হরতাল পালিত হয়েছে। স্বাধীন বাংলাদেশে হরতালের ব্যাপক প্রচলন শুরু হয় ১৯৮২ সালে এরশাদ ক্ষমতায় আসার পর। ১৯৮২ সালের মার্চ থেকে ৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৭২ দিন জাতীয়ভাবে হরতাল পালিত হয়েছে। এরশাদ সরকারের পতনের পর ১৯৯১ সালের ফেব্রুয়ারিতে সাধারণ নির্বাচনে বিএনপি ক্ষমতায় আসে। ১৯৯১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনাকে লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণের অভিযোগে ১৪ সেপ্টেম্বর হরতাল পালন করে আওয়ামী লীগ। সেই থেকে আবার হরতাল কর্মসূচির শুরু।

বাঙালির স্বাধীকার আন্দোলনেও ছিল সফল হরতাল পালনের ইতিহাস

১৯৯৪ সালে মাগুরার উপনির্বাচনের পর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে শুরু হয় টানা হরতাল। ১৯৯৬ সালের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত ২১ বার হরতাল পালন করা হয়। আর ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারির নির্বাচনকে কেন্দ্র করে টানা ৩৯ দিন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে অসহযোগ আন্দোলন চলে। ১৯৯০ সালের ৭ ডিসেম্বর থেকে ১৯৯৬ সালের মার্চ পর্যন্ত দেশে ৮১ দিন জাতীয়ভাবে হরতাল হয়েছে।

১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে। ১৯৯৬ সালের মার্চ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত বিএনপি ৪৫ দিন হরতাল করেছে। ২০০১ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত বিরোধী দলে আওয়ামী লীগ সব মিলিয়ে ১৩০ দিন হরতাল করেছে। আর ২০০৯ সালে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর ৩০ অক্টোবর পর্যন্ত দেশে ৭০ দিন হরতাল পালিত হয়েছে। এর মধ্যে চলতি বছরেই ৪০ দিন ছিল হরতাল।

সব মিলিয়ে এখন পর্যন্ত মোট ৪৫৯ দিন হরতাল হয়েছে। এর মধ্যে আওয়ামী লীগ বিরোধী দল থাকার সময়ে দুই আমলে মোট হরতাল করেছে ২০১ দিন, আর বিএনপি করেছে ৮৫ দিন। কেবল জাতীভাবে নয়, দেশে স্থানীয়ভাবেও অনেক হরতাল পালিত হয়েছে। জাতীয় ও স্থানীয়ভাবে ধরলে স্বাধীনতার পর থেকে এই পর্যন্ত দেশে প্রায় এক হাজার ৭০০ দিন অর্থাৎ প্রায় সাড়ে চার বছরই হরতাল ছিল দেশে।

দেশে দেশে আইন ও সনদ যা বলছে: 
দি ইউনিভার্সাল ডিক্লারেশন অফ হিউম্যান রাইটস (১৯৪৮), ইন্টারন্যাশনাল কভোনেন্ট অন সিভিল অ্যান্ড পলিটিক্যাল রাইটস (১৯৭৬) ও ইউরোপিয়ান কনভেনশন অন হিউম্যান রাইটস (১৯৫০) মতে, ‘মৌলিক অধিকার পালনে বাধা সৃষ্টি করা যাবে না। তবে মৌলিক অধিকার পালন করতে অন্যের অধিকার খর্ব করা যাবে না’।

কানাডার দণ্ডবিধিতে রয়েছে, ‘বেআইনিভাবে বা প্রচলিত আইন অমান্য করে যেকোনো মৌলিক অধিকার পালন দণ্ডযোগ্য অপরাধ’। আর অস্ট্রেলিয়ান সংবিধানের ২১ ধারা মোতাবেক, ‘অন্যের অধিকার খর্ব করে কেউ তার মৌলিক অধিকার পালন করতে পারবে না’। আমেরিকা, জার্মানি ভারতসহ সব দেশে এ রকম বিধি-নিষেধ আছে।

বাংলাদেশ সংবিধানের ২৬ থেকে ৪৭ পর্যন্ত অনুচ্ছেদে মৌলিক অধিকারের কথা উল্লেখ রয়েছে। তবে সেখানে বলা আছে, ‘জনশৃঙ্খলা ও জনস্বাস্থ্যের স্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত বাধা নিষেধ সাপেক্ষে মৌলিক অধিকার পালন করা যাবে’। মৌলিক অধিকারের কথা বলে হরতাল ডাকা হলেও বর্তমান সময়ের হরতালে দণ্ডবিধির বেশ কয়েকটি ধারা অমান্য করা হয়। যেমন সহিংসতা ও পিকেটিং ১৪১ ও ১৪৬ ধারা অনুসারে অপরাধ। তবে হরতালের সহিংসতার বিরুদ্ধে বিশেষ ক্ষমতা আইন-১৯৭৪, সন্ত্রাস বিরোধী আইন-১৯৯২ ব্যবহার করা যেতে পারে। যদিও হরতালের সহিংসতায় যারা গ্রেফতার হয় তাদেরকে রাজনৈতিক বন্দি হিসেবে মুক্তি দাবি করা হয়।

ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে মাহাত্মা গান্ধীর হরতাল

প্রস্তাবনায় হরতাল নিয়ে উচ্চ আদালতের একটি রায় উল্লেখ করা হয়েছে। যাতে বলা হয়, ১৯৯৯ সালে হরতালের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করা হয়। ২০০০ সালের ২৫ অক্টোবর হাইকোর্টের বিচারপতি মাইনুর রেজা চৌধুরী রায়ে বলেন, কোনো প্রকার ভয়-ভীতি না দেখিয়ে হরতাল ডাকা একটি বৈধ কর্মকাণ্ড এবং সেটা প্রতিবাদ প্রকাশের স্বাধীনতার মধ্যে পড়ে, যা সংবিধানের ৩৯ (২) (এ) সংরক্ষিত। এখানে ভয়-ভীতি না দেখিয়ে বিষয়টির প্রতি সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। যদি হরতাল আহ্বান এর সঙ্গে ভয়-ভীতি প্রদর্শন জড়িত থাকে বা হরতাল পালনে কাউকে কোনোভাবে বাধ্য করা হয়, তাহলে হরতাল ডাকা অবৈধ হবে। কারণ সেটা নাগরিকের মৌলিক অধিকারকে খর্ব করে।

বিচারপতি সৈয়দ জে আর মোদাচ্ছিরের মতে, হরতাল শান্তিপূর্ণভাবে পালন করতে হবে। একাধারে যেমন হরতালের পক্ষে কোনো বেআইনি কাজ করা যাবে না, তেমনি হরতাল পালনের বিরোধী কর্মী দ্বারা হরতালের বিপক্ষে বিরক্তি, উসকানি, হস্তক্ষেপ এবং কোনো ধরনের আগ্রাসন করা যাবে না। অন্যদিকে জাতীয় সংসদে ২০১৩ সালের ৯ নভেম্বর জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য মজিবুল হক চুন্নু একটি হরতাল নিয়ন্ত্রণ আইন প্রস্তাব আকারে পেশ করেন। কিন্তু তা পাস হয়নি।


সর্বশেষ সংবাদ