আম আদমি পার্টির পাঞ্জাব জয়

অরবিন্দ কেজরিওয়াল ও মো. নিজাম উদ্দিন
অরবিন্দ কেজরিওয়াল ও মো. নিজাম উদ্দিন  © টিডিসি ফটো

ভারতের পাঞ্জাব প্রদেশের ১১৭ আসনের বিধান সভার নির্বাচনে ৯২টি আসনে জয়ী হয়েছে অরবিন্দ কেজরিওয়ালের আম আদমি পার্টি। এটি হচ্ছে আম আদমি পার্টির জন্য দ্বিতীয় কোনো প্রদেশ যেখানে সরকার গঠন করতে যাচ্ছে দলটি। অরবিন্দ কেজরিওয়ালের নেতৃত্বে দিল্লিতে অনেক আগে থেকেই আম আদমি পার্টি ক্ষমতায়। ক্ষমতার রাজনীতিতে দিল্লি থেকে কীভাবে একটি নবীন রাজনৈতিক দল খুব কম সময়ে পাঞ্জাবের ক্ষমতায় চলে আসলো?এটা বিস্ময়কর হলেও আম আদমি পার্টি তা করে দেখিয়ে দিল।

২০১২ সালে অরবিন্দ কেজরিওয়াল আম আদমি পার্টি প্রতিষ্ঠা করেন। সে হিসাবে দলটির বয়স মাত্র এক দশক। ভারতের মতো একটি দেশে নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করে ক্ষমতায় চলে আসা খুব সহজ বিষয় নয়। কিন্তু আম আদমি পার্টি এই অসম্ভব কাজটিই সহজ করে দেখিয়ে দিচ্ছে কীভাবে একটা রাজনৈতিক দল শুধু মাত্র কাজের মাধ্যমে খুব কম সময়ে মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে নিতে পারে। এমন কী জাদু জানে কেজরিওয়াল? কী সেই পলিসি আম আদমি পার্টির? প্রশ্ন অনেকের।

অরবিন্দ কেজরিওয়াল ছিলেন সরকারি চাকরিজীবী। তবে সৎ চাকরিজীবী। দুর্নীতিকে বিদায় জানাতেই তার রাজনীতিতে পদার্পন। ২০১১ সালে ভারতে যে সাড়া জাগানো দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলন হয়েছিল,সেখানে আন্না হাজারের সাথে নেতৃত্বে ছিলেন অরবিন্দ কেজরিওয়ালও। আন্না হাজারে ওই আন্দোলনকে সরাসরি রাজনৈতিক রুপ দেওয়ার বিরোধী ছিলেন কিন্তু আন্না হাজারের সহকর্মী অরবিন্দ কেজরিওয়াল ছিলেন সম্পর্ক এই মতের সম্পূর্ণ বিরোধী।

রাজনৈতিক উদ্যোগ ছাড়া দেশ থেকে দুর্নীতি মুক্ত করা যে অসম্ভব- এটা বুঝতে মিস্টার কেজরিওয়াল খুব সময় নেননি। ফলে আন্না হাজারের সাথে অরবিন্দ কেজরিওয়ালের মতাদর্শগত দ্বন্দ্ব তৈরি হয় এবং আন্না হাজারের সংগ ত্যাগ করে কেজরিওয়াল আম আদমি পার্টি প্রতিষ্ঠা করেন। বলছি ২০১২ সালের কথা। তখন থেকেই দিল্লি হয়ে সমগ্র ভারতে আলোচনার কেন্দ্র বিন্দুতে চলে আসে আম আদমি পার্টি ও অরবিন্দ কেজরিওয়াল। দলের প্রতীক ঝাড়ু।কেজরিওয়াল দেশ থেকে ঝাড়ু দিয়ে দুর্নীতিকে ঝেটিয়ে বিদায় করতে চান,তাই এই প্রতীক।

আরও পড়ুন: বিশ্বের বৃহত্তম ভোট উৎসব শুরু ভারতে

মানুষ কেন একটি নতুন রাজনৈতিক দলের দিকে ঝুকে পড়ল? দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল ও তার দল আম আদমি পার্টি জাত পাতের রাজনীতির সম্পূর্ণ বিরোধী। আম আদমি পার্টি মূলত সমস্যা সমাধানের রাজনীতি করে। কোনো ইজম প্রতিষ্ঠা করতে চায় না, তারা চায় নাগরিকদের প্রতিটি সমস্যার সমধান, কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। আর সমস্যা সমাধানের এই রাজনীতিই এখন আম আদমি পার্টিকে দিল্লির পর পাঞ্জাবেও সরকার গঠন করতে ভূমিকা রাখছে।

এবার ভারতের পাঁচটি প্রদেশে বিধান সভার নির্বাচন হলো। প্রদেশ গুলো হচ্ছে- উত্তর প্রদেশ, উত্তরাখন্ড, গোয়া, মণিপুর ও পাঞ্জাব। পাঞ্জাব ছাড়া অন্য চারটি আসনে পূর্বে বিজেপি ক্ষমতায় ছিল এবং এখনো বিজেপিই ক্ষমতায় থাকছে। পাঞ্জাব প্রদেশে ক্ষমতায় ছিল ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস কিন্তু তাকে হাড়িয়ে ক্ষমতায় চলে আসলো এবার আম আদমি পার্টি।

এ এক বিস্ময়ই বটে। পাঁচটির মধ্য চারটি প্রদেশে বিজেপির জয় এবং একটিতে আম আদমি পার্টির মত একটি নবীন দলের কাছে ভারতের অন্যতম প্রাচীন দল কংগ্রেসের হেড়ে যাওয়াটা একটা এমন রাজনৈতিক কেস স্টাডি যা দক্ষিণ এশিয়ার অনেক রাজনৈতিক দলের জন্যই একটি বড় শিক্ষা। ভারতের পাঁচটি প্রদেশের বিধান সভার নির্বাচনের যে ফলাফল ঘোষিত হলো তাতে স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে আম আদমি পার্টি ভারতের কেন্দ্রীয় রাজনীতির অনেক বড় ফ্যাক্টর হয়ে উঠছে, সবার দৃষ্টি যাচ্ছে অরবিন্দ কেজরিওয়ালের দিকে।

উত্তর প্রদেশের মত ভারতের রাজনীতির একটা বৃহৎ প্লে গ্রাউন্ডে যোগী আদিত্য নাথের মত বিজেপি নেতার দ্বিতীয় মেয়াদে উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী হওয়াটা উদারপন্থী রাজনৈতিক ব্যবস্থার জন্য কোনো সুসংবাদ বহন করে না। ভারতের পাঁচটি প্রদেশে বিধান সভার এই নির্বাচনকে ২০২৪ সালের অনুষ্ঠিতব্য ভারতের লোকসভার নির্বাচনের একটা রাজনৈতিক মহড়া হিসাবে ধরা হচ্ছিল। যেখানে বিজেপি তার উপস্থিতি বেশ ভালো ভাবেই জানান দিচ্ছে। ২০২৪ সালেও বিজেপি ক্ষমতা থেকে গেলে অবাক হব না।

দিল্লিতে অরবিন্দ কেজরিওয়াল মুখ্যমন্ত্রী হয়ে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বিদ্যুৎ, পানি, নিরাপদ নগর, দুর্নীতি রোদ এবং নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধে কার্যকর ভূমিকা গ্রহণ এবং যৌন নির্যাতনের বিষয়গুলোকে সামনে নিয়ে আসেন।অন্যান্য রাজনৈতিক দল গুলো যেখানে মতাদর্শ গত লড়াই নিয়ে ব্যস্ত থেকেছে, আম আদমি পার্টি সেখানে করেছে সমস্যা সমাধানের রাজনীতি।

আরও পড়ুন: ভারতের হরিয়ানায় নির্বাচনে ভরাডুবি ক্ষমতাসীন বিজেপির

দিল্লির সরকারি স্কুলগুলোর শিক্ষার মান উন্নয়নে অসাধারণ ভূমিকা পালন করছে আম আদমি পার্টি। সরকারি হসপিটালের চিকিৎসা সেবাকে সাধারণ মানুষের জন্য সহজ করা হয়েছে। ফলে প্রাইভেট হসপিটালের দৌরাত্ম্য কমেছে। দিল্লিতে দুর্নীতি,স্বজনপ্রীতি কমেছে। পানি বিদ্যুৎতের দাম নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে। জনগণ দিল্লির অরবিন্দ কেজরিওয়ালের এই ধরনের জনবান্ধন রাজনৈতিক উদ্যোগকে বলছে বলছে ‘দিল্লি মডেল’।

আম আদমি পার্টি দিল্লির অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে পাঞ্জাবেও দেখিয়ে দিল, না সম্ভব। পাঞ্জাবে আম আদমি পার্টির ক্ষমতায় চলে যাওয়ায় অরবিন্দ কেজরিওয়ালকে কেউ কেউ ২০২৪ সালে ভারতের লোকসভার যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে সেখানে নরেন্দ্র মোদির প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবা শুরু করছেন। বিজেপির বাইরের বিরোধী দলগুলোর জোট হলে এত দিন আলোচনা ছিল রাহুল না মমতা কে হবে বিরোধী জোটের নেতা- এমন যে আলোচনাটি চলছিল সেখানে বোধহয় আরেকজন প্রতিদ্বন্দ্বীর নাম যোগ হলো যার নাম অরবিন্দ কেজরিওয়াল।

আম আদমি পার্টি দিল্লি থেকে পাঞ্জাব দখল মাত্র দশ বছরে কীভাবে সম্ভব হলো? এই প্রশ্নের উত্তর হলো দলের সময়োপযোগী পলিসি। কংগ্রেস কেন পাঞ্জাবে আম আদমি পার্টির কাছে চরম ভরাডুবি হলো? তারও উত্তর পার্টির দুর্বল পলিসি। নিকট অতীতে ভারতের কৃষক আন্দোলনে আম আদমি পার্টির ভূমিকার ইতিবাচক প্রভাব পাঞ্চাবের নির্বাচনে পড়েছে।

আম আদমি পার্টি দেখিয়ে দিল কীভাবে খুব অল্প দিনের মধ্যেই একটা ছোট রাজনৈতিক দল তার কার্যকর পলিসি দিয়ে নিজের অবস্থান শক্ত করে নিতে পারে। কংগ্রেসের চরম ভরাডুবি এবং আম আদমি পার্টির উত্থান যেকোনো রাজনৈতিক দলের জন্যই অনেক বড় শিক্ষা।

লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক


সর্বশেষ সংবাদ