প্রভোস্ট হলেন হোটেল ম্যানেজার, প্রক্টর নিরাপত্তা কর্মকর্তা

ড. মো. কামরুল হাসান মামুন
ড. মো. কামরুল হাসান মামুন  © টিডিসি ফটো

বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রভোস্ট, প্রক্টর ইত্যাদি পোস্টকে খুবই উচ্চমানের পদ হিসেবে দেখা হয়। অথচ এই দুটি পোস্টে শিক্ষকদের নিয়োগ দেওয়ারই কথা না। আমাদের দেশের কু-রাজনৈতিক সংস্কৃতির কারণে এইসব পদে শিক্ষকদের নিয়োগ দেওয়া হয় এবং শিক্ষকদের একটা বড় অংশই এইসব পদ পাওয়ার জন্য নিজেকে যতটা নামতে এই পদ পাওয়া যায় ততটাই নামবে।

প্রভোস্টের কাজ?

ইউরোপ, আমেরিকা এবং কানাডায় প্রভোস্টের হলো একটা একাডেমিক পোস্ট। প্রায় আমাদের প্রো-ভিসিদের মত। তাদের কাজ হলো curricular ঠিক করা, instructional, and research affairs দেখভাল করা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভোস্ট পদটি আমদানি করা হয়েছিল অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের আদলে। সেখানে আবাসিক হলগুলোতে আসলে আবাসিক শিক্ষক ও প্রভোস্ট নিয়োগ দেওয়া হতো এবং শিক্ষার্থীদের ভাগ করে আবাসিক শিক্ষকদের পড়াশুনার দেখভালের দায়িত্ব দেওয়া হতো আর প্রভোস্ট এই কাজটি ওভারসাইট করতো। যার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড বলা হতো। কিন্তু বরাবরের মতই আমরা "প্রভোস্ট" দায়িত্বকে ভিন্ন দিকে নিয়ে গেছি।

বাংলাদেশের বর্তমান পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভোস্টের কাজ হয়ে গেছে হোটেলের জেনারেল ম্যানেজারের মত। হলে সিট বন্টন যার একটি অন্যতম দায়িত্ব। প্রকৃত অর্থে এটিও এখন সরকার দলীয় ছাত্রসংগঠনই করে। প্রভোস্টের বাকি কাজ হলো হলের ক্যান্টিন ও ডাইনিং ব্যবস্থাপনা করা, আবাসিক হলের শিক্ষার্থী ও কর্মচারীদের পরিচালিত করা, শিক্ষার্থীদের খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড দেখভাল করা ইত্যাদি। প্রভোস্টের এই কাজে সহায়তার জন্য আবাসিক শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়। আবাসিক হলের কোন কাজই বর্তমানে একাডেমিক না।

আরও পড়ুন- বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হতে পিএইচডি ডিগ্রি ন্যূনতম যোগ্যতা হওয়া উচিত 

বর্তমান বিশ্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হল চালায় কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা। এক দুইজন শিক্ষককে দায়িত্ব দেওয়া যেতে পারে পুরো কাজটির supervise করার জন্য যা দৈনন্দিন কাজের অংশ না। আমাদের দেশে ছাত্র রাজনীতির নামে যা ঘটে সেই কারণে ধরে নেওয়া হয় শিক্ষক ছাড়া অন্য কাউকে এই দায়িত্ব দিলে শিক্ষার্থীরা মানবে না। আমিও আবাসিক শিক্ষক ছিলাম। দেখেছি যে এইসব কাজ অন্তত শিক্ষকদের মানায় না। এইসব কাজ করলে শিক্ষকদের শিক্ষকতা ও গবেষণায় সময় দিতে পারবে না। আমাদের ছাত্ররা যদি জাতীয় রাজনীতি না করে সত্যিকারের ছাত্র রাজনীতি করতো আর শিক্ষার্থীরা সুশৃঙ্খল হতো তাহলে আবাসিক হলগুলো কয়কেজন কর্মকর্তাই চালাতে পারতো। আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রভোস্টের কাজগুলো আসলে উন্নত বিশ্বে এর ৮০%ই exist করে না। এই কাজগুলো আমাদের খারাপ সংস্কৃতি থেকে উদ্ভুত। আমরা যদি সভ্য হতাম তাহলে এই কাজগুলো থাকতোই না। তাহলে ভেবে দেখুন কত শিক্ষকের কত ক্রিয়েটিভ কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। অথচ এই প্রভোস্ট পদের জন্য শিক্ষকরা মুখিয়ে থাকে। এই পদকে কত বড় পদ ভাবা হয়।

একই কথা বলা চলে প্রক্টরের ক্ষেত্রে। প্রক্টরিয়াল কাজ একটি পুলিশি কাজ। এই কাজ কখনো একজন শিক্ষকের হতে পারেনা। আমি শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকার সময় অধ্যাপক জাফর ইকবাল, অধ্যাপক ইয়াসমীন হকসহ আমার অনেক সহকর্মীদের অনুরোধে সেখানকার প্রক্টর হয়েছিলাম। ১ মাসের মধ্যে বুঝে গেছি এইটা কোন শিক্ষকের কাজ না। তাই এই পদ ছেড়ে দিতে একটা অজুহাত খুঁজতে লাগলাম। ৫ মাস লাগলো সেই অজুহাত পেতে। এই সময়টা আমার শিক্ষকতা জীবনের সবচেয়ে খারাপ সময় কেটেছে। আমাকে পুলিশ, মেয়র, মেম্বার ইত্যাদি মানুষের সাথে যোগাযোগ রাখতে হতো, ছাত্রনেতাদের সাথে মিটিং করতে হতো। এত unproductive কাজ যা শিক্ষকতার সাথে একদম যায় না। অথচ এই পদ পাওয়ার জন্যও অনেক শিক্ষক মুখিয়ে থাকে। প্রক্টর হতে পারে একজন অবসরপ্রাপ্ত সেনা অথবা পুলিশের বড় কর্মকর্তা।

আরও পড়ুন- শুধু শিক্ষার্থী না, লেখাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেকের না বলা কথা

আমাদের দেশে প্রভোস্ট হলো সিম্পলি হোটেলের ম্যানেজার। প্রক্টর মানে নিরাপত্তা কর্মকর্তা। আমরা কবে এইসব বুঝব?


সর্বশেষ সংবাদ