শিক্ষায় বৈষম্য দূরীকরণের বাজেট চাই

রাশেদ ইসলাম
রাশেদ ইসলাম  © টিডিসি ফটো

বিশ্ব আজ এক ধ্বংসযজ্ঞের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। করোনাভাইরাস সংক্রমণ ঠেকাতে গোটা মানবজাতিকে এক রকম ঘরবন্দী জীবনযাপন করতে হচ্ছে। ফলে থমকে দাঁড়িয়েছে পৃথিবী। আমাদের দেশেও এর বাইরে নয়।

আগামী মাসেই জাতীয় সংসদে ২০২১- ২২ অর্থবছরের বাজেট উপস্থাপন করা হবে। এ বাজেটে শিক্ষাখাতে কেমন বাজেট হবে সেটাই ছাত্রসমাজের জন্য চিন্তার বিষয়।

করোনায় প্রায় ১৪ মাস ধরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ। শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবন তছনছ। বড় ধরনের ক্ষতির দিকে শিক্ষা ব্যবস্থা।

কিন্তু এই ক্ষতি পোষাতে দীর্ঘমেয়াদী সুনির্দিষ্ট কোনো পরিকল্পনা নেই। শিক্ষার্থীদের কতটুকু ক্ষতি হলো, তা এক বছরেও মূল্যায়ন করে দেখাতে পার নি শিক্ষা মন্ত্রণালয়। কত শিক্ষার্থী পড়াশোনার বাইরে চলে গেলো, তার সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য পাওয়া যায় নি।

করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে রাখতে দেশের স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গত বছরের ১৭ মার্চ থেকে ছুটি চলছে। আগামী কত দিনে খোলা হবে সে নিশ্চয়তাও নেই।

অবশ্য এ সংকট শুধু বাংলাদেশে নয়, বিশ্বব্যাপী। জাতিসংঘের শিশু সংস্থা ইউনিসেফের গত মার্চে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, কোভিড-১৯ লকডাউনের কারণে বিশ্বব্যাপী ১৬ কোটি ৮০ লাখের বেশি শিশুর জন্য স্কুল প্রায় এক বছর ধরে পুরোপুরি বন্ধ রয়েছে।
বিভিন্ন পত্রিকার প্রতিবেদনে উঠে এসেছে বেশি দিন স্কুল বন্ধ থাকা ১৪টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশেও নাম রয়েছে।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার কারণে শিক্ষার্থীদের বহুমাত্রিক সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। দীর্ঘদিন শ্রেণিকক্ষের বাইরে থাকার কারণে বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থী পড়াশোনা ভুলে যাচ্ছে। পরীক্ষা নিয়ে দক্ষতা যাচাই না করে উপরের ক্লাসে উঠে যাচ্ছে।
গ্রামে ও বস্তি এলাকায় কিশোরীরা বাল্যবিবাহের শিকার হচ্ছে। অনেক শিক্ষার্থীর মানসিক ও শারীরিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।

বর্তমানে প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত আমাদের দেশে প্রায় ৪ কোটি শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে। করোনা কালে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার মধ্যে রাখতে কিছু উদ্যোগ নিয়েছিল সরকার। এর মধ্যে গত বছরের ২৯ মার্চ থেকে মাধ্যমিক এবং ৭ এপ্রিল থেকে প্রাথমিকের রেকর্ড করা ক্লাস সংসদ টেলিভিশন প্রচার করছে। এছাড়াও রেডিও, অনলাইন ও মোবাইলের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা ক্লাসে অংশগ্রহণ করতে পারবে। খুবেই ভালো উদ্যোগ শুভ কামনা জানাতে হয়।

কিন্তু বিষয়টা পরিষ্কার হয়েছে তখনি যখন বেসরকারি সংস্থাগুলোর মোর্চা গণস্বাক্ষরতা অভিযানের ‘এডুকেশন ওয়াচ ২০২০-২০২১’ সমীক্ষার অন্তর্বর্তীকালীন প্রতিবেদনে, গত জানুয়ারিতে বলা হয় দূর শিক্ষণের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ ছিল সাড়ে ৩১ শতাংশ। এছাড়াও অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অনলাইনে ক্লাসই হয় না সেই চিত্র উঠে এসেছে।

শিক্ষা মন্ত্রণালয় এ বছরের জন্য সংক্ষিপ্ত পাঠ্যসূচিতে ৬০ দিন ক্লাস করিয়ে এসএসসি এবং ৮০ দিন ক্লাস করিয়ে এইচএসসি পরীক্ষা নেওয়ার পরিকল্পনা করেছিল, সেটি বাস্তবায়ন হবে কি না ঘোলাটে অবস্থা।

তবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে প্রাথমিকের শিক্ষার্থীদের বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে শিক্ষকেরা শিখন কার্যক্রম চালাবেন বলে আলোচনায় ছিলো কিন্তু সেটিও সম্ভব হচ্ছে না। শুধু মাত্র অ্যাসাইনমেন্টের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের সক্রিয় রাখার চেষ্টা করা হলেও বাস্তবে তা সঠিক মত হচ্ছে না। তারা নিজে না করে অন্যের দ্বারায় সমাধান করে নিচ্ছে।

সন্তানদের শিক্ষক রেখে প্রাইভেট পড়ানোর আর্থিক সামর্থ্য তাদের নেই। অধিকাংশ পরিবারেই কোন এনড্রয়েড মোবাইল ফোন নেই। তাই অনলাইন ক্লাস করার সুযোগ নেই তাদের। ফলে নিয়মিত পড়াশুনা অব্যাহত রাখা সম্ভব হবে না এবং অনেকেই ঝরে যাবে শিক্ষা থেকে। এই পরিস্থিতিতে শিক্ষাক্ষেত্রে বৈষম্য ব্যাপকভাবে বেড়ে যাবে।

যেসব পরিবার অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল তাদের সন্তানদের নানাভাবে বিকল্প ব্যবস্থা রেখে পড়াশোনা করানোর সুযোগ রয়েছে। কিন্তু যেসব পরিবারে পর্যাপ্ত খাবার জোগাড় করাই কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে, তাদের পরিবারের শিক্ষার্থীদের অনেকেই হয়তো শিক্ষাক্ষেত্র থেকে ঝরে পরবে।

করোনা দুর্যোগে শিক্ষা গ্রহণ যেন বন্ধ না হয়ে যায় সেই লক্ষে গত বছরের এপ্রিলে সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট এর উদ্যোগে স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে বিনাবেতনের স্কুল অদম্য পাঠশালা (করোনায় থামবে না পড়া) এর কার্যক্রম সারা দেশে যতটুকু সম্ভব স্বাস্থ্যবিধি চালু হওয়াতে ব্যাপক সাড়া পড়েছিল।

একটি মাত্র ছাত্র সংগঠনের পক্ষে যদি করোনায় বিকল্প পদ্ধতিতে পড়াশোনা চালিয়ে নিতে পারে। আমাদের সরকারের এত গুলো শিক্ষক থাকার সত্বেও পারছেনা না কেন? না কি শিক্ষাখাত নিয়ে তাদের কোনো মাথা ব্যথা নেই।

শিক্ষাখাতে বরাদ্দ জাতীয় বাজেটের ১০ থেকে ১২ শতাংশের মধ্যেই ঘুরপাক খাচ্ছে। যেখানে ইউনেস্কো বলেছেন মানসম্মত শিক্ষা ব্যবস্থা গড়তে হলে অবশ্যই দেশের বাজেটের ২৫% ও জিডিপির ৬ ভাগ শিক্ষাখাতে বরাদ্দ থাকা বাঞ্ছনীয়।

স্বাস্থ্য খাতে যে বেহাল দশা এই করোনা ভাইরাস উন্মোচন করেছে তা স্বাস্থ্যমন্ত্রী নিজেও বলেছেন এবং সেটা সবার সামনে স্পষ্ট। টেস্টিং যে পর্যাপ্ত না তার প্রমাণ একজন জাতীয় অধ্যাপক মারা যাবার পর তার রিপোর্টে করোনা পজিটিভ আসে। এই ক্রান্তিলগ্নে দাঁড়িয়ে রাষ্ট্র যদি এই উপলব্ধিতে পৌঁছাতে না পারে, তাহলে আমাদের কষ্টার্জিত স্বাধীনতার আর কোন অর্থ থাকবে না।

শিক্ষাখাতে ২৫% ও স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ বৃদ্ধিসহ করোনাকালীন সময়ে অসচ্ছল শিক্ষার্থীদের আর্থিক সহযোগিতা করতে হবে এবং পাশাপাশি গ্রামের শিক্ষার্থীদের জন্য বিশেষ ক্লাসের ব্যবস্থার মাধ্যমে গ্রাম ও শহরের শিক্ষায় বৈষম্য দূরীকরণে রাষ্ট্রের একান্ত দায়িত্ব।

লেখক: শিক্ষার্থী, জয়পুরহাট সরকারি কলেজ।


সর্বশেষ সংবাদ