সংকট ও সম্ভাবনার সন্ধিক্ষণে: নতুন বাংলাদেশের পথচলা

জাহিদুল ইসলাম
জাহিদুল ইসলাম  © সংগৃহীত

বাংলাদেশ ছাত্র-নেতৃত্বাধীন আন্দোলনের এক উজ্জ্বল ইতিহাসবাহী দেশ। দীর্ঘযুগ ধরে জাতি সংকটময় সময়ে যুব সমাজের সক্রিয়তাকে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট গঠনে প্রভাবশালী ভূমিকায় দেখেছে। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৭১ সালের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ-পরবর্তী স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৯০ সালের স্বৈরাচারবিরোধী গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলনে ছাত্ররা সব সময় ন্যায়ভিত্তিক সমাজ এবং গণতন্ত্রের পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন।

চব্বিশের জুলাই-আগস্টের ছাত্রজনতার সফল গণ-অভ্যুত্থানও বাংলাদেশের ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত হিসেবে লিখিত থাকবে, যেটা স্বৈরশাসকের চ্যালেঞ্জের মুখে সম্মিলিত উদ্যোগের শক্তিকে তুলে ধরে। যা একটি তরুণ এবং গতিশীল জনগোষ্ঠীর জাতীয় আকাঙ্ক্ষাগুলো পূরণে রাষ্ট্রের কাঠামোগত সংস্কারের জরুরি প্রয়োজনকেও নির্দেশ করে।

বিশেষ করে জুলাই-আগস্টের বিপ্লব-পরবর্তী অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে দেশের জনগণের প্রত্যাশা তুঙ্গে। কারণ, বাংলাদেশের মানুষের ইতিহাস বারবার অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে রক্তদানের হলেও, প্রতিবারই তারা স্বপ্নভঙ্গের তিক্ত অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছে। সার্বভৌম ও স্বাধীনতার অর্ধশত বছর অতিবাহিত হলেও স্বৈরাচারী মনোভাবের জন্য কোনো রাজনৈতিক দল বা ক্ষমতাসীন সরকার গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানসমূহকে নিরপেক্ষ ও কার্যকর অবস্থানে নিতে দেয়নি। সাম্য ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গঠনে গণতন্ত্রের যে গুরুত্বপূর্ণ উপাদানসমূহ, যেমন জাতীয় সংসদ, নির্বাহী বিভাগ, বিচার বিভাগ, নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন, স্বাধীন গণমাধ্যম, সিভিল সোসাইটি সংগঠন (অ্যাডভোকেসি গ্রুপ, বেসরকারি সংস্থা, গবেষণা প্রতিষ্ঠান বা থিঙ্কট্যাংক), আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও নিরাপত্তা বাহিনী এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহকে অনৈতিক ও রাজনৈতিক স্বার্থে নানা উপায়ে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে দলীয়করণ, নিস্ক্রিয় এবং প্রভাবিত করা হয়েছে। 

এরই পরিপ্রেক্ষিতে আওয়ামী ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার নেতৃত্বে জুলাই-আগস্টে হাজার প্রাণ ও অজস্র রক্ত বিসর্জনের বিনিময়ে সফল গণ-অভ্যুত্থান হয়েছে। যা পরবর্তী সময়ে সব স্বৈরাচারী সরকার ও রাজনৈতিক দলের জন্য রাজনৈতিক শিক্ষার নিদর্শন হয়ে থাকবে। তবে জাতি এই সন্ধিক্ষণে অনেক আশা ও প্রত্যাশা নিয়ে জুলাইয়ের বিপ্লব-পরবর্তী বাংলাদেশের ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে এবং নাগরিক সাধারণ উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠায় দিন গুনছে। কারণ জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের পর জাতি এক অস্থির সময় অতিক্রম করেছে, যেখানে রাজনৈতিক সংকট, অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ এবং সামাজিক বিভাজন এবং বিদেশি গোষ্ঠীসমূহের ষড়যন্ত্র একসঙ্গে জাতীয় উন্নয়নে বাধা সৃষ্টি করছে। যে বাধাসমূহকে মোকাবেলা করার ক্ষেত্রে গণতন্ত্রের মূল্যবোধকে অধিষ্টিত করা অতি প্রয়োজনীয়। এ বিষয়ে বিশিষ্ট চিন্তাবিদ ড. সলিমুল্লাহ খান বলেছেন, ‘গণতন্ত্র রক্ষার জন্য সক্রিয় উদ্যোগ প্রয়োজন। তিনি উল্লেখ করেন যে, রাজনৈতিক সংকট দূর করতে জনগণের সরাসরি সম্পৃক্ততা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, নতুবা গণতন্ত্র হুমকির সম্মুখীন হতে পারে।’

ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা রাষ্ট্রীয় কাঠামোর প্রধান প্রতিষ্ঠানসমূহ তার রাজনৈতিক স্বার্থে পঙ্গু করে গিয়েছেন। আর এসব রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বিশেষ করে আওয়ামী লীগ-সমর্থিত সরকারি উচ্চপদস্থ আমলারা দেশের বর্তমান সামগ্রিক সংস্কারে কাঙ্ক্ষিত দায়িত্ব ও সহযোগিতা করছেন না। এরই ফলশ্রুতিতে দেশে বর্তমানে উল্লেখযোগ্য সংকট তৈরী হচ্ছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এই সংকট সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে এবং দুঢ় অবস্থান নিতে ব্যর্থ হচ্ছে। সুশাসকের মতো দক্ষ কৌশল বা সমন্বিত পদক্ষেপও দেখা যাচ্ছে না। এছাড়া অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের সিদ্ধান্ত গ্রহণে দক্ষতার অভাব, স্থবিরতা এবং বিশেষজ্ঞদের মতামত যথাযথভাবে কাজে লাগানোর ঘাটতি স্পষ্ট। অগ্রাধিকার ঠিক করে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষেত্রেও ঘাটতি রয়েছে। এই পরিস্থিতির অব্যবস্থাপনা চলতে থাকলে অরাজকতা সৃষ্টি হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। সেক্ষেত্রে বিপ্লব-পরবর্তী এই নতুন বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ পুনর্বিবেচনা করার জন্য দৃঢ় ও কঠিনতম পদক্ষেপ নেওয়ার মাধ্যমে সর্বক্ষেত্রে কার্যকরী সংস্কার জরুরি। যদিও অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সাবেক ফ্যাসিস্ট সরকার কর্তৃক পঙ্গুত্ব বরণ করা কিছু রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান সংস্কারের জন্য সংস্কার কমিশন গঠন করেছে। কিন্তু এসব পদক্ষেপ বিপ্লব থেকে সমাধানের পথে পর্যাপ্ত না। 

একটি জাতির সন্ধিক্ষণে রক্ত- বিপ্লবের প্রতিধ্বনি যে পরিবর্তনের কণ্ঠস্বর ও নতুন পথের সন্ধান আবিষ্কার করেছেন সেখানে রাস্তাঘাট থেকে রাষ্ট্রীয়, সকল পর্যায়ের নাগরিক ও প্রতিষ্ঠানের অংশগ্রহণ জরুরি। সে ক্ষেত্রে জাতীয় স্বার্থে নীতিনির্ধারণী গঠন ও বাস্তবায়নের জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পাশাপাশি, সকল সাধারণ নাগরিক, রাজনৈতিক দল, ধর্মীয় সংগঠন, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক চাপসৃষ্টিকারী প্রতিষ্ঠান ও মানবাধিকার সংস্থাসমূহের অংশগ্রহণ, সমন্বয় ও ঐক্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ এবং এই প্রক্রিয়াটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পরবর্তী যেকোনো সরকারের জন্য প্রযোজ্য। এই বিষয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. আবদুল লতিফ মাসুম মনে করেন, অস্থায়ী সরকারের সফলতা, সার্থকতা ও সুনাম-সুখ্যাতি শতভাগ জাতীয় ঐক্য ও সংহতির উপর নির্ভরশীল, যেখানে বহুসংখ্যক মানুষ, ব্যাপকসংখ্যক বিষয় আমলে নেয় এবং বৈচিত্র্যপূর্ণ বিষয়গুলোতে তারা একমতে উপনীত হয়।

এ জন্য নতুন বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে প্রধান সংস্কারের পাশাপাশি যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়সমূহ পুনর্বিবেচনায় রাখতে হবে সেগুলো হলো, স্বচ্ছ রাজনৈতিক ক্ষেত্র, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা, কৃষি ও শিল্প খাতের সম্প্রসারণ, শিক্ষার মান উন্নয়ন এবং সামাজিক ও জাতীয় রাজনৈতিক ঐক্য। জুলাই-আগস্ট বিপ্লব-পরবর্তী নতুন বাংলাদেশ গড়ে তুলতে হলে জনগণকে নেতৃত্বে রাখতে হবে এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও পরিবেশগত সংস্কারগুলো কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। এটি কেবল একটি জাতিকে সংকট থেকে রক্ষা করবে না, বরং একটি উন্নত, সমৃদ্ধ, এবং সমানাধিকারের বাংলাদেশ গড়ে তোলার পথও প্রশস্ত করবে। মনে রাখতে হবে, এই অস্থিরতাকে শুধু সংকট হিসেবে দেখলে চলবে না, বরং এটি একটি সুযোগ হতে পারে নতুনভাবে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎকে গড়ে তোলার জন্য।

লেখক: শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়


সর্বশেষ সংবাদ