মেধাবী, ছাত্রবান্ধব ও জনমুখী সংগঠন গড়তে চায় ছাত্রদল
- মাহমুদ ইসলাম কাজল
- প্রকাশ: ০১ জানুয়ারি ২০২৫, ১১:৩০ AM , আপডেট: ০১ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০৬ PM
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের ইতিহাস ৪৬ বছরের ঐতিহ্য, সংগ্রাম ও আত্মত্যাগের ইতিহাস। আজ ১ জানুয়ারি, ১৯৭৯ সালের এই দিনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বাংলাদেশের অন্যতম ঐতিহ্যবাহী ছাত্রসংগঠন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল। এটি শুধু একটি ছাত্রসংগঠন নয়, বরং বাংলাদেশের গণতন্ত্র, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার সংগ্রামে এক বলিষ্ঠ নাম। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে প্রতিষ্ঠিত এই সংগঠন ছাত্রসমাজের অধিকার আদায় এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করে আসছে। আজ, ৪৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে পেছন ফিরে তাকালে ছাত্রদলের ইতিহাস হয়ে ওঠে গৌরবময় সংগ্রামের এক অনন্য দলিল।
১৯৭৯ সালের ১ জানুয়ারি মহান স্বাধীনতার ঘোষক শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ছাত্রদল প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে একটি নতুন ধারার ছাত্ররাজনীতির সূচনা করেন। এ সংগঠনের মূল লক্ষ্য ছিল ছাত্রসমাজকে জাতির ভবিষ্যৎ নেতৃত্বে প্রস্তুত করা এবং শিক্ষার্থীদের অধিকার রক্ষা করা। সময়ের পরীক্ষায় দাঁড়িয়ে ছাত্রদল প্রমাণ করেছে যে, এটি শুধু একটি রাজনৈতিক সংগঠন নয়, বরং ছাত্রসমাজের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন এবং দেশের প্রতি গভীর দায়িত্ববোধের প্রতীক। এরই ধারাবাহিকতায় দেশের প্রতিটি সংকটময় সময়ে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেছে এই ছাত্র সংগঠন।
শুরুটা ১৯৮০-এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এবং স্বৈরশাসক এরশাদের সামরিক শাসনের সময় থেকে বিনা ভোটের অবৈধ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী শাসনামল পর্যন্ত গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে ছাত্রদল ছিল রাজপথের প্রথম সারির সংগঠন। কঠোর দমন-পীড়নের মধ্যেও সংগঠনটি এক মুহূর্তের জন্য পিছু হটেনি।
১৯৯০-এর গণঅভ্যুত্থানে স্বৈরশাসকের পতন থেকে সবশেষ জুলাই বিপ্লব- এ রাজপথে থেকে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে স্মরণীয় ভূমিকা রেখেছে ছাত্রদল। যাদের ঐতিহাসিক অবদানের ফলস্বরূপ গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। বিগত প্রায় ১৭ বছরের ফ্যাসিস্ট শাসনামলে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের লড়াইয়ে ছাত্রদল আপোষহীন ভূমিকা পালন করেছে। মানবাধিকার লঙ্ঘন ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ধ্বংসের বিরুদ্ধে তাদের অবিরাম সংগ্রাম প্রমাণ করে যে, ছাত্রদল গণমানুষের স্বার্থে সর্বদা নিবেদিত।
এবার নতুন প্রজন্মের প্রত্যাশাকে মাথায় রেখে একবিংশ শতাব্দীর রাজনীতিতে নতুন প্রজন্মের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করে সংগঠনকে সময়োপযোগী করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। ছাত্রদল বর্তমানে আধুনিক চিন্তাধারা, প্রযুক্তি ও শিক্ষার সমন্বয়ে ছাত্ররাজনীতির মানোন্নয়নে কাজ করছে। আধুনিক কাঠামো তৈরির লক্ষ্যে নতুন প্রজন্মের চাহিদা ও যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সংগঠনের কাঠামোগত ও গুণগত পরিবর্তন আনছে ছাত্রদল। তরুণদের মাঝে দেশপ্রেমের বীজ বপন করার পাশাপাশি, তাদের নেতৃত্বের জন্য প্রস্তুত করা হচ্ছে, দেশব্যাপী কার্যক্রমকে আরও গতিশীল করা হচ্ছে। সংগঠনটি শুধু রাজনৈতিক আন্দোলনেই নয়, বরং সামাজিক ও শিক্ষাক্ষেত্রেও কার্যকর ভূমিকা রাখতে সচেষ্ট। ছাত্রদলের একটি বড় লক্ষ্য হচ্ছে ভবিষ্যতে দক্ষ নেতৃত্ব তৈরি করা। এ নেতৃত্ব হবে মেধাবী, দেশপ্রেমিক এবং জনকল্যাণে নিবেদিত।
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ছাত্রদলকে একটি আধুনিক, সৃজনশীল এবং দায়িত্বশীল ছাত্রসংগঠনে রূপান্তরিত করার জন্য নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন। তারেক রহমানের প্রত্যাশায় ছাত্রদলকে নিয়ে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিকল্পনা:
তরুণ নেতৃত্বের বিকাশ: মেধাবী ও জনমুখী নেতৃত্ব গড়ে তোলার মাধ্যমে জাতিকে ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত করা।
রাজনৈতিক নৈতিকতা: ছাত্ররাজনীতিকে কলুষমুক্ত করতে এবং নৈতিকতার ভিত্তিতে রাজনীতির নতুন ধারা তৈরি করতে কাজ করা।
ডিজিটাল দক্ষতা: ছাত্রদলকে আধুনিক প্রযুক্তি ও ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহারে পারদর্শী করে তোলা।
দেশপ্রেমের চেতনা: তরুণদের মধ্যে জাতীয়তাবাদী চেতনা এবং গণতন্ত্রের প্রতি আস্থা ও বাংলাদেশী দেশপ্রেম জাগিয়ে তোলা।
তারেক রহমান বিশ্বাস করেন, “ছাত্ররাজনীতি কেবল ক্ষমতার জন্য নয়, বরং জাতি গঠনে ইতিবাচক ভূমিকা রাখার ক্ষেত্র, এটি তরুণদের সেবার মাধ্যমে দেশের জন্য কাজ করার সুযোগ করে দেয়।”
৪৬ বছরের সংগ্রামের অভিজ্ঞতা নিয়ে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল আজ নতুন প্রজন্মের প্রতিনিধিত্ব করছে। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা এবং ছাত্রসমাজের অধিকার রক্ষায় সংগঠনটি নিরলস কাজ করে যাচ্ছে। ছাত্রদল এমন একটি বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখে যেখানে প্রতিটি শিক্ষার্থী স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশ করতে পারবে, সম্মানের সঙ্গে বেড়ে উঠবে এবং একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে জীবনযাপন করবে।
সংগঠনের সদস্য হিসেবে ভবিষ্যৎ প্রস্তাবনা: ছাত্র সংগঠনের উন্নয়ন ও দেশ গঠনে ভূমিকা
উদার গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ: গণতান্ত্রিক চর্চার মাধ্যমে নতুন নেতৃত্ব তৈরি। সহনশীলতা ও মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল মানসিকতা তৈরি। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের ভিত্তিতে ভবিষ্যৎ নেতৃত্বকে শক্তিশালী করা।
ভাষাগত দক্ষতা বৃদ্ধি: মাতৃভাষা বাংলা ও ইংরেজির পাশাপাশি তৃতীয় ভাষা (আরবি, ফরাসি, চাইনিজ) শেখায় উদ্বুদ্ধ করা। ভাষা শিক্ষা কর্মশালার আয়োজন। বহুভাষিক জ্ঞান অর্জন করে শিক্ষার্থীদের বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় এগিয়ে রাখা।
পাঠচক্র, ইতিহাস ও ঐতিহ্য: নিয়মিত পাঠচক্র ও আলোচনা সভার আয়োজন। দেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্য তুলে ধরে জাতীয়তাবোধ জাগ্রত করা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় শিক্ষার্থীদের উদ্বুদ্ধ করা।
ডাটাবেজ তৈরি: ইউনিয়ন থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত প্রতিটি ছাত্রদলের কর্মীর তথ্য সংরক্ষণ। ডিজিটাল ডাটাবেজ ব্যবস্থার মাধ্যমে সংগঠনের কার্যক্রমকে গতিশীল করা। তথ্য আদান-প্রদানে সুনির্দিষ্ট ও দ্রুত সমাধান।
প্রশিক্ষণ কর্মশালা: প্রযুক্তি, উদ্যোক্তা দক্ষতা এবং পেশাদারিত্বমূলক প্রশিক্ষণ। নেতৃত্ব ও যোগাযোগ দক্ষতায় উন্নতি। তরুণদের দেশ গঠনে ভূমিকা রাখার জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ।
নেটওয়ার্কিং: সংগঠনের আধুনিকীকরণে নেটওয়ার্কিং টুল ও সফটওয়্যার ব্যবহারের উদ্যোগ। কার্যক্রম পরিচালনায় উন্নত প্রযুক্তির সংযোগ।
ডাটাবেজ তৈরি: ইউনিয়ন থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত প্রতিটি ছাত্রদলের কর্মীর তথ্য সংরক্ষণ। ডিজিটাল ডাটাবেজ ব্যবস্থার মাধ্যমে সংগঠনের কার্যক্রমকে গতিশীল করা। তথ্য আদান-প্রদানে সুনির্দিষ্ট ও দ্রুত সমাধান।
শিক্ষা কারিকুলামে সোশ্যাল ওয়ার্ক: শিক্ষার্থীদের সমাজকল্যাণমূলক কাজে সম্পৃক্ত করা। শিক্ষা কারিকুলামে সামাজিক কাজ অন্তর্ভুক্ত করার উদ্যোগ। বাস্তব সমস্যা সমাধানের অভিজ্ঞতা অর্জনে সহায়তা।
ধর্মীয় স্বাধীনতার চর্চা: ধর্মীয় সহনশীলতা ও শ্রদ্ধাবোধ তৈরি। বিভিন্ন ধর্মের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি সম্পর্কে সচেতনতা। ধর্মীয় স্বাধীনতার ভিত্তিতে সামাজিক শান্তি প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা।
শিক্ষানীতি প্রণয়নে ছাত্রদলের ভাবনা: যুগোপযোগী শিক্ষা নীতির মাধ্যমে দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি। বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনী শিক্ষার ওপর গুরুত্ব। গবেষণা ও উন্নয়ন কাজে শিক্ষার্থীদের সম্পৃক্ত করা।
রেমিট্যান্স বৃদ্ধি ও কৃষি খাতে অবদান: ফ্রিল্যান্সিং কাজের মাধ্যমে রেমিট্যান্স বৃদ্ধিতে ভূমিকা। আধুনিক প্রযুক্তি প্রয়োগ করে কৃষি খাতে উৎপাদন ও বিপণন কার্যক্রম পরিচালনা। কর্মশালা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কৃষি ও উদ্যোক্তা তৈরিতে সহায়তা।
প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষা ও জলবায়ু পরিবর্তন: পরিবেশ সুরক্ষায় সচেতনতামূলক কর্মসূচি। প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণে শিক্ষার্থীদের সম্পৃক্ত করা। পরিবেশবান্ধব উদ্যোগ গ্রহণ ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারে উৎসাহ।
চতুর্থ শিল্প বিপ্লব: রোবটিক্স, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI), ডেটা অ্যানালিটিক্স ও ব্লকচেইনে দক্ষতা অর্জন। উদ্ভাবনী চিন্তাভাবনা বিকাশ এবং স্টার্ট-আপ উদ্যোগে শিক্ষার্থীদের সম্পৃক্ত করা। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রযুক্তিগত দক্ষতা উন্নয়ন।
এই প্রস্তাবনাগুলো বাস্তবায়িত হলে ছাত্র সংগঠনটি শুধু নিজস্ব উন্নয়নে নয়, বরং জাতীয় ও বৈশ্বিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
ছাত্রদল শুধুমাত্র ছাত্রদের অধিকার আদায়ে সীমাবদ্ধ থাকবে না, বরং আধুনিক চিন্তা-চেতনা ও মানবিক চর্চাকে অগ্রাধিকার দেবে। উদ্দেশ্যবিহীনভাবে শুধুমাত্র রাজনৈতিক কর্মী সংগ্রহ ছাত্রদলের উদ্দেশ্য নয় বরং তরুণদের দক্ষতা, জ্ঞান ও নৈতিকতার উন্নয়নের মাধ্যমে ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব তৈরি করবে। গবেষণা, উদ্ভাবন ও প্রযুক্তি-নির্ভর প্রশিক্ষণের মাধ্যমে ছাত্রদল একটি প্রগতিশীল ও উদ্ভাবনী রাষ্ট্র তৈরিতে ভূমিকা রাখবে। ছাত্রদলের এই দৃষ্টিভঙ্গি জাতির ভবিষ্যৎকে আরও সমৃদ্ধ ও উন্নত করবে।
লেখক: তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল