কেন মেধাবীরা শিক্ষকতা পেশায় আসতে আগ্রহ হারাচ্ছেন?

ড. মোর্ত্তূজা আহমেদ
ড. মোর্ত্তূজা আহমেদ  © টিডিসি ফটো

ইউরোপ এবং আমেরিকায় শিক্ষকদের মর্যাদা সাধারণত উচ্চ। বেশিরভাগ দেশেই শিক্ষকতাকে একটি সম্মানজনক এবং গুরুত্বপূর্ণ পেশা হিসেবে গণ্য করা হয়। শিক্ষকেরা সমাজের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে গড়ে তোলার মূল কারিগর হিসেবে বিবেচিত হন। বিশেষ করে ফিনল্যান্ড, জার্মানি, নেদারল্যান্ডস, কানাডা এবং যুক্তরাষ্ট্রের কিছু অংশে শিক্ষকদের মর্যাদা অত্যন্ত উচ্চ। বেতনের দিক থেকে ইউরোপ এবং আমেরিকার শিক্ষকদের মধ্যে কিছু পার্থক্য রয়েছে। বেশিরভাগ উন্নত দেশে শিক্ষকদের বেতন সঠিকভাবে নির্ধারিত হয় এবং তারা উপযুক্ত পারিশ্রমিক পান।

ফিনল্যান্ডে শিক্ষকদের বেতন সাধারণত উচ্চ এবং তারা বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধাও পান। জার্মানিতে শিক্ষকদের বেতন বেশ ভালো এবং তারা পেনশনসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকেন। যুক্তরাষ্ট্রে শিক্ষকদের বেতন রাজ্য ও জেলার উপর নির্ভর করে ভিন্ন হতে পারে। সম্মানের ক্ষেত্রে ইউরোপ এবং আমেরিকার অনেক দেশেই শিক্ষকদের উচ্চ মর্যাদা দেয়া হয়। ফিনল্যান্ডে শিক্ষকরা সমাজে অত্যন্ত সম্মানিত এবং প্রশংসিত হন। নরওয়েতে শিক্ষকরা তাদের পেশার জন্য যথেষ্ট সম্মান পান এবং শিক্ষাব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে বিবেচিত হন। যুক্তরাষ্ট্রের কিছু অঞ্চলে শিক্ষকদের সম্মান অনেক বেশি। সুতরাং শিক্ষককে বাদ দিয়ে উন্নত ও সভ্য রাষ্ট্র তৈরি করা অসম্ভব।

এবার আসুন বাংলাদেশের শিক্ষকদের মর্যাদা ও সম্মান প্রসঙ্গে। শুরুটা আইয়ুব খানের পাকিস্তান আমলে হলেও এই পদ্ধতিতে বাংলাদেশ সৃষ্টির পর থেকেই শিক্ষার মান কমতে শুরু করেছে। ব্রিটিশ আমলে সরকারি কলেজের লেকচারারের বেতন ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচারারের চেয়ে এক গ্রেড উপরে। যে কারণে, অনেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ে কয়েক বছর শিক্ষকতা করে তারপর সরকারি কলেজের শিক্ষক হওয়ার জন্য চেষ্টা করতেন।

এমনকি পাকিস্তান আমলেও শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক পদটি ছিল সচিব মর্যাদার, নাম ছিল “ডিপিআই” ব্রিটিশ আমলের “ডিপিআই বাহাদুর” সম্বোধনটি তখনো প্রচলিত ছিল। ঢাকা থেকে ডিপিআই সাহেব রাজশাহী গেলে রাজশাহীর বিভাগীয় কমিশনার (যুগ্মসচিব মর্যাদার) প্রটোকল অনুযায়ী তাঁকে বিমান বন্দরে রিসিভ করতে যেতেন। 

ব্রিটিশ আমলে লেকচারারের বেতন ম্যাজিস্ট্রেটের এক গ্রেড উপরে ছিল। আইয়ুব আমলে লেকচারারদের বেতন এবং ম্যাজিস্ট্রেটদের বেতন একই স্কেলে থাকলেও লেকচারারদের একটা অতিরিক্ত ইনক্রিমেন্ট দিয়ে চাকরিতে ঢোকানো হতো, আর ফার্স্টক্লাস থাকলে দুটো। আইয়ুব খান সিএসপি নামের আমলাতন্ত্র চালু করে মেধাবীদেরকে শিক্ষক হওয়ার পরিবর্তে আমলা হওয়ার পথে আকর্ষণ করার ব্যবস্থা করেছিল।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর সেই আমলাতন্ত্র জেঁকে বসলো শিক্ষার উপরে। শিক্ষকদের পদে পদে অপমান করা শুরু হলো। ধীরে ধীর গত পঞ্চাশ বছরে অবস্থাটা এমন দাঁড়ালো- যে ডিপিআই বাহাদুরকে একদা জয়েন্ট সেক্রেটারি গিয়ে প্রটোকল দিত, সেই মাউশির মহাপরিচালককে এখন সিনিয়র অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারিরা ধমক দিয়ে আদেশ এবং নির্দেশ দেয়। তাই শিক্ষক ও সুধী সমাজের ভিতর প্রশ্ন উঠেছে কেন শিক্ষকতা পেশা কে অনাকর্ষণীয় করা হচ্ছে?

বাংলাদেশের শিক্ষকতার পেশার প্রথম সর্বনাশ করেছে মিলিটারি শাসক আইয়ুব খান এবং সর্বশেষ সর্বনাশ করেছে সাবেক অর্থ মন্ত্রী আবুল মল আবদুল মুহিত। মুহিত সাহেব শিকক্ষদের প্রথম শ্রেণি প্রাপ্তির ইনক্রিমেন্ট এবং পিএইচডি ডিগ্রির ইনক্রিমেন্ট বাদ দিয়ে দিলেন। শিক্ষকদের পদোন্নতি এবং আমলাদের পদোন্নতি এক করে দিলেন। ফার্স্ট সেকেন্ড থার্ড ক্লাস পাওয়া সকলকেই একই কাতারে নিয়ে আসলেন। তখন থেকেই মূলত শিক্ষকদের ভিতর অসন্তোষের দানা বাড়তে থাকে। সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সার্বজনীন পেনশন স্কিমে অন্তর্ভুক্ত করার পর এ অসন্তোষ মহীরুপ ধারণ করে। কেন শিক্ষকদের শেষ জীবনের আর্থিক নিরাপত্তায় হাত দিতে হবে? 

শিক্ষকতা পেশার প্রতি রাষ্ট্রের এত অনীহা কেন? বাংলাদেশে বিসিএসে ২৬টি ক্যাডার রয়েছে এর মধ্যে মেধাবীদের কাছে সব থেকে কম পছন্দ শিক্ষা ক্যাডার। সব থেকে অবাক করা বিষয় হলো শিক্ষকতা করেও তাদের প্রথম পছন্দে শিক্ষা ক্যাডার ছিল না। তাদের অধিকাংশের প্রথম পছন্দ ছিল পররাষ্ট্র , প্রশাসন বা পুলিশ। অথচ হওয়ার কথা ছিল উল্টা মেধাবীদের প্রথম পছন্দ হওয়া উচিত ছিল শিক্ষা ক্যাডার। কেন মেধাবীদের শিক্ষা ক্যাডার পছন্দ না? এর প্রধান কারণ হলো বৈষম্য যেমন অন্য সব ক্যাডারে সঠিক সময়ে পদোন্নতি হলেও শিক্ষা ক্যাডারে ঠিক সময়ে পদোন্নতি হয় না। অনেক শিক্ষক ১০ থেকে ১৫ বছর পর্যন্ত প্রভাষক হিসাবে থাকে। তাদের বেতন কাঠামোয় গ্রেড ৪ এর উপর যাওয়ার সুযোগ নেই। অন্য সব ক্যাডার থেকে সচিব হতে পারলেও শিক্ষা ক্যাডার থেকে কেউ কোনোদিন সচিব হতে পারবে না। 

এ ছাড়াও স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে অবকাঠামোগত সমস্যাগুলি খুবই জটিল এবং বহুমাত্রিক। প্রায়শই দেখা যায় যে শিক্ষকদের বসার জন্য পর্যাপ্ত রুমের অভাব রয়েছে। বিশেষত গ্রামীণ এলাকায় এসব প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিকাঠামো খুবই দুর্বল। অনেক স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে পর্যাপ্ত শ্রেণীকক্ষের অভাব, পানীয় জলের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না থাকা, স্যানিটেশন সুবিধার অভাব এবং আলোর স্বল্পতা প্রতিনিয়তই ছাত্র-ছাত্রী এবং শিক্ষকদের অসুবিধার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এছাড়াও, শিক্ষকদের যথাযথ প্রশিক্ষণের অভাব তাদের দক্ষতা বৃদ্ধিতে বাধা সৃষ্টি করে। এই সকল কারণে শিক্ষকদের মনোবল দুর্বল থাকে, যা শিক্ষা প্রদানের মানকে প্রভাবিত করে। শিক্ষার মান উন্নত করতে শিক্ষক স্বল্পতা একটি বড় সমস্যা হিসেবে বিদ্যমান।

অন্যদিকে দেশে যুগ্ম সচিবের পদ আছে ৩৩২ টি কিন্তু যুগ্ম সচিব পদে কর্মরত আছেন ৯৯৩ বেশি। সচিব, উপসচিবসহ অন্যান্য সকল পদের চিত্র একই। শুধু পদ না। সুবিধার দিকেও এরা চরম এগিয়ে। তারা কোটি টাকার SUV ছাড়া অফিসে যেতে পারেন না। অন্যদিকে সরকারি কলেজের অধ্যক্ষদেরও নেই কোন গাড়ি তারা সরকারের বিভিন্ন মিটিংয়ে অংশগ্রহণ করেন পায়ে হেঁটে অথবা রিকশায় করে। পদ না থাকলেও সুপার নিউমারারি পদ সৃষ্টি করে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার থেকে পুলিশ সুপার পদমর্যাদায় ২৯০ জন ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেয়া হয় বিগত নির্বাচনের সময়।

এসব অতিরিক্ত কর্মকর্তার রাষ্ট্রের কোন প্রয়োজন নাই অথচ তাদের বেতন ভাতা দেওয়া হচ্ছে বছরের পর বছর। অন্যদিকে কলেজে যেখানে এইচএসসি, ডিগ্রি পাস, অনার্স এবং মাস্টার্স পড়ানো হয় সেখানে শিক্ষক থাকার কথা ন্যূনতম ২৫ জন অথচ আছে মাত্র চার পাঁচ জন শিক্ষক। এইক্ষেত্রে সরকার সুপার নিউমারী পদ সৃষ্টিতে শুধু উদাসীনই নয় বরং শিক্ষকদের ঠিকমতো পদোন্নতি দিতেও তাদের আগ্রহের অভাব দেখা যায়। মেধাবীরা পেশা বেছে নেওয়ার আগে এ সকল বিষয় বিবেচনা করে থাকেন।

শিক্ষক ও শিক্ষার ক্ষতি মানেই দেশের অগ্রগতির ক্ষতি। নিম্ন মানের শিক্ষকদের কাছ থেকে উচ্চ মানের শিক্ষার্থী আশা করা বোকামি। নিম্ন মানের শিক্ষার ফলাফল হলো অব্যাহত দুর্নীতি, বিদেশে অর্থ পাচার, কাজে ফাঁকি, ওজন কম দেওয়া, এবং আইন অমান্য করা। আমাদের নেই কোনো নিজস্ব নীতি, নেই কোনো নিজস্ব প্রযুক্তি, সব কিছুই আমাদের ধার করে আনতে হয়।

শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য হলো আলোকিত মানুষ তৈরি করা, আর এটি করতে দরকার উপযুক্ত শিক্ষক। অথচ দেশের মেধাবীরা এই পেশায় আসতে চায় না। এটি রাষ্ট্রের ব্যর্থতা, এটি আমাদের রাজনীতিবিদদের ব্যর্থতা। প্রতি বছর শিক্ষা খাতে বাজেট কমানো হচ্ছে। সম্প্রতি একটি প্রতিবেদনে দেখা যায় দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে কম বেতন বাংলাদেশের শিক্ষকদের দেওয়া হয়। শিক্ষকদের অভাব অনটনে রেখে রাষ্ট্রকে সুখী ও সুন্দর করা অসম্ভব।

সরকার স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার ভিশন নিয়েছে। স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে হলে শুধু জিডিপির অন্তত ৫.৫% শিক্ষা খাতে বরাদ্দ দিন। শিক্ষা ব্যবস্থাকে স্মার্ট করুন, স্মার্ট শিক্ষা ব্যবস্থার বাইপ্রোডাক্টই হবে স্মার্ট বাংলাদেশ। যেখানে প্রতিটি সেক্টরের মেধাবীদের প্রথম পছন্দের পেশা হবে স্কুল, কলেজ, এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়া। আপনারা কি চান না, আপনাদের সন্তান দেশের সবচেয়ে মেধাবী শিক্ষকদের কাছ থেকে পড়ালেখা শিখুক?

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, ব্যবসায় প্রশাসন ডিসিপ্লিন, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়।


সর্বশেষ সংবাদ