অর্থনৈতিক সংকট কাটাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের ৩ সিদ্ধান্ত কতটুকু কার্যকর?

জান্নাতুল ফেরদৌস
জান্নাতুল ফেরদৌস  © টিডিসি ফটো

দেশের অর্থনীতিতে চলমান উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও রিজার্ভ কমে যাওয়ার মতো জটিল পরিস্থিতি মোকাবিলা করে অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে তিনটি বড় সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ বড় সিদ্ধান্তগুলোর প্রথমটিই হলো— ডলারের বিপরীতে টাকার দাম আরও সাত টাকা কমিয়ে ১১৭ টাকা করা। ডলারের বিপরীতের টাকার এ দরপতন দেশের আমদানি-রপ্তানি বাজারে নিয়ে এসেছে বিশাল এক অস্থিরতা। টাকার এ দরপতনের ফলে আমদানি নির্ভর বাংলাদেশের নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য আরও বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। যার ফলে অনেক দ্রব্যই সাধারণ মানুষের ক্রয়সীমার বাইরে চলে যাবে। 

বাংলাদেশে সরকারিভাবে ডলারের দাম বৃদ্ধির ঘোষণার এক সপ্তাহের মধ্যেই পণ্যের দামের উপর সেটির প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। ইতোমধ্যেই বেড়ে গেছে চাল, ডাল, আটা এবং ভোজ্য তেলের মতো নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম। ব্যবসায়ীরা বলছেন, ডলারের দাম বৃদ্ধির ফলে পণ্যের আমদানি ও পরিবহণ খবর বেড়ে যাওয়ায় বাজারে জিনিসপত্রের বাড়াতে বাধ্য হচ্ছেন তারা।  

তবে রপ্তানিকারক ও প্রবাসীদের জন্য এটি আশীর্বাদ হতে পারে। কারণ তারা ডলারের বিপরীতে বেশি টাকা পাবেন। যদিও আমদানিকারকদের পণ্য আমদানি করতে বেশি টাকা খরচ করতে হবে। কেও আবার মনে করছেন সুদ ও টাকার নতুন বিনিময় হার বাংলাদেশ থেকে অর্থপাচার কমাতে সহায়তা করবে।

ব্যাংকটির দ্বিতীয় সিদ্ধান্ত হলো—ব্যাংক খাতে ঋণের সুদ হার পুরোপুরি বাজারভিত্তিক করা হয়েছে। ফলে চার বছর আগে ব্যাংকগুলোর ওপর আরোপিত 'কমান্ড অ্যান্ড কন্ট্রোল মেকানিজম' থেকে এটি একটি বড় পরিবর্তন আনা হলো। সুদের হার বাড়ায় অর্থনীতির গতি আরও ধীর হতে পারে। 

এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন মনে করছেন, বাজারভিত্তিক সুদের হার নতুন নয়। নব্বইয়ের দশকে অর্থনৈতিক উদারীকরণের সময় থেকেই বাংলাদেশ তা মেনে চলছে। তাই উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। ব্যাংক ও অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো এ ধরনের ব্যবস্থায় কার্যক্রম পরিচালনায় যথেষ্ট অভিজ্ঞ।

সর্বশেষ সিদ্ধান্তটি হলো—নীতি সুদহার ৫০ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে সাড়ে আট শতাংশ করা হয়েছে। মূলত মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে নীতি সুদহার বাড়ানো হয়। বিষয়টি হলো, কেন্দ্রীয় ব্যাংক যদি মনে করে, সমাজে অর্থের সরবরাহ বেশি এবং সে কারণে মূল্যস্ফীতির সূচক বাড়ছে, তাহলে অর্থপ্রবাহ কমাতে নীতি সুদহার বৃদ্ধি করে তারা। নীতি সুদহার বৃদ্ধির অর্থ হলো, ব্যাংকগুলোকে অতিরিক্ত সুদ দিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ করতে হবে। ফলে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো গ্রাহকদের যে ঋণ দেয়, তার সুদহার বাড়ে। নীতি সুদহার বেশি থাকলে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে টাকা ধার করতে নিরুৎসাহিত হয়। নীতি সুদহার হলো রেপো।

এর সঙ্গে রিভার্স রেপো রেটের আলোচনাও প্রাসঙ্গিকভাবে চলে আসে। যেমন কেন্দ্রীয় ব্যাংক যদি মনে করে বাজারে অতিরিক্ত তারল্য আছে, তাহলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ওই তারল্য তুলে নিতে পারে। এই তুলে নেওয়ার জন্য সুদের নির্দিষ্ট হার থাকে। অর্থ তুলে নেওয়ার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে যে হারে সুদ দেয়, তাকে বলা হয় রিভার্স রেপো। সাধারণত নীতি সুদহার বা রেপো রেটের তুলনায় রিভার্স রেপোর সুদহার কম থাকে।  
তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ সিদ্ধান্তে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে টাকা ধার করতে নিরুৎসাহিত হবে। তখন গ্রাহকদের মধ্যেও অর্থের জোগান কমে। এতে সার্বিকভাবে দেশে মূল্যস্ফীতি হ্রাস পাবে। তবে বাংলাদেশে বিভিন্ন কারণে মুদ্রাস্ফীতি হওয়ায় এই নীতি কাজে না ও দিতে পারে। 

এক্ষেত্রে বাজার ব্যবস্থাপনায় নজর দেওয়াটাই উচিত হবে। যথাযথ প্রতিযোগিতামূলক বাজার গড়ে তুলতে পারলে এবং যারা বড় অঙ্কের অর্থ আত্মসাৎ করছে তাদের দমাতে পারলে মুদ্রাস্ফীতি থেকে উত্তরণ সম্ভব।

লেখক: শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।


সর্বশেষ সংবাদ