স্মার্ট ও স্বনির্ভর বাংলাদেশ বিনির্মাণে কেন দক্ষতাভিত্তিক শিক্ষাক্রম দরকার?

ড. মো. আকতারুজ্জামান
ড. মো. আকতারুজ্জামান  © টিডিসি ফটো

উন্নত দেশ হতে হলে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা উন্নত হতে হবে। এর জন্য ভিত্তিটা শক্ত হওয়া দরকার, যার শুরু হয়েছে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে নতুন শিক্ষাক্রম প্রণয়নের মাধ্যমে। আমরা স্বনির্ভর স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে চাই অথচ প্রচলিত ধ্যান-ধারণা থেকে বের হতে চাই না। এটাই মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের সবচেয়ে বড় বাঁধা। চারটি কবিতা আর দশটি রচনা মুখস্থ করে পরীক্ষায় লেখার যে মূল্যায়ন পদ্ধতিতে আমরা আবহমান কাল থেকে অভ্যস্ত তা উন্নত বিশ্ব বহু আগে থেকে বাদ দিয়েছে। এর পরিবর্তে তারা সহযোগিতামূলক ও প্রকল্পভিত্তিক শিক্ষায় গুরুত্ব দিচ্ছে। গুগল, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই), চ্যাটজিপিটির যুগে আমাদের প্রকৃত মূল্যায়নের দিকে ঝুঁকতে হবে।

কর্ম এবং শিক্ষার জগৎ ক্রমবর্ধমানভাবে বিশ্বজুড়ে মিলে যাচ্ছে। শিক্ষাকে শুধু জ্ঞান সংগ্রহের মাধ্যম হিসাবে চিন্তা না করে বরং আমাদের সাধারণ শিক্ষা ও কর্মমুখী শিক্ষার সমন্বিত পদ্ধতির দিকে মনোনিবেশ করতে হবে। ৪র্থ বলেন আর ৫ম বলেন কোন শিল্পবিপ্লবের যুগেই রোবট এসে আপনার বাড়ির পানি বা বিদ্যুতের লাইন ঠিক করবে না। তাই কর্মমুখী শিক্ষার গুরুত্ব দিন দিন বাড়বে। একজন গ্রাজুয়েটের দেশে ও বিদেশে চাকরি বা উদ্যোক্তা হওয়ার সম্ভাবনা যদি ২৫% হয়, তবে সেটা ৯৫% হবে ডিগ্রির সাথে কমপক্ষে ২টি কারিগরি দক্ষতা সম্পন্ন করা থাকে।


এখন দেখি উন্নত দেশগুলোতে কি ধরনের শিক্ষার প্রচলন রয়েছে। ২০২২-২৩ সালে আমেরিকান স্টেট ডিপার্টমেন্টের ফেলোশিপে থাকাকালীন দক্ষ জনবল তৈরি নিয়ে কাজ করেছি আমেরিকা ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে। ধারণা ছিল ওরা আমাদের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ঘুরে দেখাবে। কিন্তু অবাক করা বিষয় ছিল বেশিরভাগ সময় ওরা আমাদের হাইস্কুল ও কলেজের বিভিন্ন কার্যক্রম পরিদর্শনে নিয়ে যেতো। সেখানে ৮/৯/১০ম শ্রেণিতে বাচ্চাদের একসাথে অর্থবহ গ্রুপ প্রজেক্ট করতে দেখেছি। ওরা স্কুলে মুখস্থ বিদ্যা প্রয়োগের চেয়ে প্রকল্প ভিত্তিক মূল্যায়নের উপর অধিক গুরুত্ব দেয়। নতুন শিক্ষাক্রমে এ ধরনের প্রকল্প ভিত্তিক শিক্ষাকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে।

যদি উন্নত দেশের সাথে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার একটি পার্থক্য বলতে হয়, তবে সেটি অবশ্যই আমাদের দেরিতে চাকরির কথা চিন্তা করা। আমরা স্নাতক বা স্নাতকোত্তর না করে চাকরির চিন্তা করি না বা আমরা সেটার সুযোগ তৈরি করতে পারিনি। আর উন্নত দেশে ছেলেমেয়েরা হাইস্কুলে ৮-১২ শ্রেণিতে থাকতেই নিয়মিত কোর্সের সাথে ২-৩টা বৃত্তিমূলক দক্ষতা সম্পন্ন করে যেমন চিকিৎসা সহকারী, অটোমোবাইল, কার্পেন্টিং, ইলেকট্রিশিয়ান, প্লাম্বিং,নার্সিং বা অন্য কিছু। বর্তমানে প্রচলিত এবং চাকরিতে কাজে লাগবে এমন দক্ষতা দরকার। আমরা যদি দেশে এভাবে চিন্তা করি তাহলে আমাদের একদিকে যেমন রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের (বেশিরভাগ হাইস্কুল বা কলেজে থাকতে বিদেশে যায়) কর্মদক্ষতা ও বেতন বৃদ্ধি পাবে, তেমনি দেশে বিরাট দক্ষ জনশক্তি তৈরি হবে। যে বয়সে কাজ করার সময় সেটি না করে বেশি বয়সে করলে, গড়ে জনপ্রতি ৫-১০ বছরের কর্মঘণ্টা নষ্ট হয়। 

শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী এমপি যথার্থ বলেছেন, প্রয়োজনের নিরিখে মূল্যায়ন পদ্ধতিতে পরিবর্তন আসতে পারে। আর স্বনির্ভর বাংলাদেশ গড়তে হলে কারিগরি উপাদান প্রচলিত শিক্ষার সাথে যুক্ত করতেই হবে। তার মানে এই নয় যে লোহালক্কড়, হার্ডওয়্যার, হাতুড়ি নিয়ে সারাদিন কাজ করতে হবে। যেকোন ভাষা শেখাও একটা দক্ষতা, কম্পিউটারে প্রোগ্রামিং শেখাও একটা দক্ষতা, রান্না শেখাও একটি দক্ষতা। আমাদের এমন একটা শিক্ষাব্যবস্থা তৈরি করতে হবে যাতে দক্ষ জনশক্তি তৈরির মাধ্যমে দেশের আর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। শিক্ষার উদ্দেশ্য শুধু চাকরি নয় তবে যে শিক্ষা দু'বেলা খাবারের যোগান দিতে পারে না সেটা অর্থহীন। নতুন শিক্ষাক্রম দিয়ে পরিবর্তনের সূচনা হবে এমনটাই দেশ ও জাতি আশা করে।

ধরুন একটা ক্লাসে ১০০ জনের মধ্যে ২০-৩০ জন ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার বা অফিসার হয়, বাকি ৭০-৮০ জন কোথায় যাবে? অনেক ক্ষেত্রে রেজাল্টের সাথে চাকরির ক্লাস সম্পর্কযুক্ত নয়। কেউ কেউ ভারতের উদাহরণ দেন- ওদের ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, আইটি প্রফেশনাল কতজন বিদেশ যায় আর অন্য সাধারণ জনতা কতজন যায়, একটু হিসেব করলেই দেখতে পাবেন সেটা ১:৪ এর মতো। ক্লাসের উপরের সারির ২০-৩০ জনের চিন্তা না করে ৭০-৮০ জনের ভবিষ্যৎ চিন্তা করায় ভাল। আমরা সাধারণ শিক্ষায় পড়ে শিক্ষিত বেকার হবো, দেশ ও পরিবারের বোঝা হব তবুও কারিগরি শিক্ষা গ্রহণ করবো না- এ মানসিকতা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। দেশের প্রধান আয়ের উৎস গার্মেন্টস ও রেমিট্যান্স, তাই অফিসারের চেয়ে দক্ষ শ্রমিক হওয়া বেশি জরুরি। 

উন্নত দেশে একজন গাড়ির মেকানিক অনেক ক্ষেত্রে একজন অধ্যাপকের চেয়ে কম আয় করে না এবং তাদের সামাজিক মূল্যায়নে তেমন কোন পার্থক্য নেই, তার অর্থ এই নয় যে কারোর অধ্যাপক হওয়ার দরকার নেই। একজন অধ্যাপক হতে বহু কাঠখড়ি পোড়াতে হয়, অথচ ৬-১২ শ্রেণিতে সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি কিছু কারিগরি শিক্ষার মৌলিক ধারণা দিতে পারলে বিদেশে সহজে একটি সার্টিফিকেশন করে মেকানিক হওয়া যায়। এমনটাই প্রচলন রয়েছে অষ্ট্রেলিয়া ও আমেরিকায়। সেখানে একজন অটো মেকানিক গড়ে ৭-৮ হাজার ডলারের আয় করে আর কাজের জন্য তাদের দেখা পাওয়া অনেক ক্ষেত্রে দুরূহ। সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার কারণে মাত্রাতিরিক্ত বেকার তৈরি হচ্ছে। নতুন শিক্ষাক্রমে তাই একটি পরিবর্তনের সূচনা হতে পারে।

দ্বাদশ শ্রেণির আগে সকল শিক্ষার্থীদের কমপক্ষে দুটি দক্ষতার কোর্স ও দুটি ভাষার কোর্সে প্রত্যয়িত হতে হবে। যারা উচ্চশিক্ষায় আগ্রহী, তাদের স্নাতক শেষ করার পাশাপাশি একই দক্ষতা অর্জন করতে হবে। এক্ষেত্রে ‘Academic Bank of Credits (ABC)’ খুবই ভাল উদ্যোগ হতে পারে। এছাড়া বিদেশি প্রতিষ্ঠানের সাথে অংশীদারিত্ব দরকার যেমন সিঙ্গাপুর, জার্মানি, অষ্ট্রেলিয়া বা আমেরিকার। শিক্ষিত বেকার দেশ, সমাজ ও পরিবারের জন্য বোঝা। তাই দেশ ও বিদেশে প্রয়োজনের নিরিখে দক্ষ জনবল তৈরি করতে পারলে দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের পাশাপাশি রেমিট্যান্স আয় আগামী ১০ বছরে ৫-৭ গুণ বাড়তে পারে। 

গত মাসে মেলবোর্নের একটি স্কুলে পড়ুয়া আমার ছেলের জন্যে একটি পড়ার টেবিল কিনলাম। মনে করেছি হয়ত ফিট করা টেবিল দিয়ে যাবে বা ২-৩ টি অংশ থাকবে যা সহজেই একত্রিত করতে পারবো। বাস্তবতা ছিল ভিন্ন! প্যাকেটে ৩০-৪০টি অংশ পেলাম - দেখে আমার মাথায় হাত! তখন ছেলে বললো, ‘ডোন্ট ওয়ারি, আই উইল ডু ইট’। ওদের সপ্তম শেণিতে STEM শিক্ষায় Product Design (Wood) এ এগুলো শিখিয়েছে। এবার সে অষ্টম শ্রেণিতে উঠেছে, Cooking Technology কোর্স পড়বে। উন্নত দেশগুলোতে এটাই প্রচলন। আমাদের দেশে যদি এমনটি হলে আমরা ঐ স্কুলের বারোটা বাজাতাম, ট্রল করতাম, না হয় বলতাম - আমরা কি কাঠুরে হবো, এগুলো কেন পড়বো? আর যদি কাঠের জায়গায় রান্না করা হতো, তাহলে বলতাম এটা মেয়েদের কাজ, আমি কি গরীব? আমার চারটি কাজের বুয়া আছে, পাঁচটি সহকারী আছে ইত্যাদি। 

শিক্ষাক্রম একটি চলমান প্রক্রিয়া। কপিরাইট ইস্যু, ধর্মীয় মূল্যবোধ ও রীতিনীতি এবং অন্যান্য কিছু ভুলত্রুটি বিষয়ে আরো সতর্ক হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু দুনিয়ায় কোনোকিছু শতভাগ সঠিক হয়ে শুরু হয় না, পরিমার্জন ও পরিবর্ধন এজন্যই যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। মানুষ সবসময় তার প্রচলিত চেনা পথেই হাঁটতে চায়, ব্যাপক পরিবর্তন সহজে মানতে চায় না। কম্পিউটার যখন প্রথম দেশে এসেছিল ৯০ এর দশকে, অনেকে এটা ভালোভাবে নেয়নি, ঠিক একইভাবে এখন অনেকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) বা জেনারেটিভ এআই যেমন চ্যাটজিপিটি কে সহজে মানতে পারছে না। কিন্তু সহসাই এগুলো মানুষের প্রাত্যহিক কাজের অংশ হবে। 

একটা কথোপকথন দিয়ে শেষ করি– সম্প্রতি একজন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত আমেরিকান গবেষকের সাথে কথা বলছিলাম। জনৈক গবেষকঃ দুনিয়ার কোনো দেশে এমন উদ্ভট শিক্ষাক্রম নেই। আমিঃ ইউরোপ, অষ্ট্রেলিয়া ও আমেরিকায় এমনটি রয়েছে। গবেষকঃ আমাদের সংস্কৃতি ভিন্ন, আমরা কেন ওটা অনুসরণ করবো, ওরা ভায়োলিন বা রান্না শিখলে আমরা কেন তা কপি করবো? আমিঃ আমেরিকান শিক্ষাক্রম কেমন? গবেষকঃ ঐটা তো ভুয়া, আমাদেরটা ভাল ছিল গবেষক হওয়ার জন্যে, এখন খারাপ হচ্ছে। আমিঃ দেশের একটি শ্রেণিকক্ষের কত শতাংশ গবেষক হয়, ০.০১% তো না? অনেক সময় আমরা জানি না আমরা আসলে কি চাই? তাই তর্ক বিতর্ক বাদ দিয়ে চলুন নতুন শিক্ষাক্রমকে কিভাবে আরো সুন্দর ও উপযোগী করা যায়, সেই চিন্তা করি। আপনার সুচিন্তিত মতামত দিয়ে একটি চলমান প্রক্রিয়ার অংশ হোন, দেশ ও জাতিকে সমৃদ্ধ করুন। 

লেখক: শিক্ষাক্রম, ডিজিটাল শিক্ষা ও সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ, মেলবোর্ন, অস্ট্রেলিয়া


সর্বশেষ সংবাদ