বিপাকে বেসরকারি শিক্ষক নিয়োগ প্রত্যাশীরা
তৃতীয় গণবিজ্ঞপ্তিতে সুপারিশপ্রাপ্ত শিক্ষক হয়েও রড মিস্ত্রির কাজ করছেন গোলাম রাব্বানী। নিজের ফেসবুক আইডিতে স্ট্যাটাসে লিখেন ‘থাকার কথা স্কুলে কিন্তু কাজ করছি রড মিস্ত্রির’। বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ (এনটিআরসিএ) কর্তৃক নিয়োগের অপেক্ষায় প্রহর গুনছেন রব্বানীর মতো ৩৮ হাজার ২৮৬ জন। দিন দিন অপেক্ষা আরো বাড়ছে। রাব্বানীর অনেকেই হয়তো জীবিকার তাগিদে অন্য কোন পেশা বেছে নিয়েছেন।
নিয়োগ প্রত্যাশী গোলাম রব্বানীর বাড়ি নীলফামারী জেলার কিশোরগঞ্জে। ১৫তম শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় কৃতকার্য হন তিনি। তার এখন ব্যস্ত থাকবার কথা স্কুলের ক্লাসরুমে। কিন্তু এখন কাজ করছেন কোন দালান কোঠা নির্মাণে। জাতির ভবিষৎ গড়ার কারিগর গড়ছে ইমারত। ২৩ মাসের সন্তানকে নিয়ে আছেন মহাবিপদে। তাই বাধ্য হয়ে গত ২৭ দিন হলো শুরু করেছেন কঠোর পরিশ্রমের রড মিস্ত্রির কাজ।
আরও পড়ুন: লোকবল সংকটে এনটিআরসিএর কার্যক্রমে ধীরগতি
এই কাজে প্রতিদিন ৪৫০ টাকা করে পান । খরচ শেষে তার থাকে ৩০০ টাকা। মাসখানেক কাজ করার পর ৯ হাজার টাকা নিয়ে যাবেন বাড়িতে। এই ৯ হাজার টাকা দিয়ে ২ মাস চলতে চান তিনি।
এর আগে রংপুরে টিউশনি করাতেন। কিন্তু করোনার কারণে মিলছে না টিউশনি। পরিবারে আছেন বাবা, মা, দুই ভাই, চার বোন। বাবা প্রধান শিক্ষক ছিলেন। ২০১৩ সালে চাকরি শেষ হয় তার। তিনি বলেন, এলাকায় টিউশনির মূল্য নেই। টাকাও দিতে চায় না। ২/৩ মাস পড়ালে ১ মাসের টাকা দেয়। বাবা অবসরে যাবার পর যে টাকা পান তা দিয়ে বোনেদের বিয়ে ও দুই ভাইকে বাড়ি করে দেন। তিনি বলেন, বাবার হাতে এখন কোনো টাকাই নেই। জমি সব বন্ধকে আছে। এরমধ্যে কিছু বিক্রিও করতে হয়েছে।
আরও পড়ুন: ১৭তম নিবন্ধনের প্রিলি নিয়ে সুখবর নেই
এনটিআরসিএ নিয়ে রব্বানী বলেন, প্রতিষ্ঠানের কোনো কাঠামো নেই। সঠিক সময়ে নিয়োগ হলে আজকে এই পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হতোনা। এখন প্রাইভেট কোম্পানিতে যদি সার্টিফিকেট জমা দেই। আবার হঠাৎ করে যদি যোগদানের তারিখ দেয়- এই ভয়ে কোনো স্থানে যোগদান করিনি। তাই মনে করছি চাকরিতে যোগদান না করে এখানে মাসখানেক কাজ করে যে টাকা পাই তা নিয়ে বাড়ি যাবো।
দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের পর বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অর্ধ লাখের বেশি শিক্ষক নিয়োগের গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ ছিল ২০২১ সালের অন্যতম ঘটনা। তবে প্রিলি-লিখিত ও ভাইভার ধাপ পার করলেও ভেরিফিকেশন শেষ না হওয়ায় ৩৮ হাজার ২৮৬ জন চাকরিপ্রার্থীর অপেক্ষা দীর্ঘায়িত হচ্ছে। চাকরিতে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েও কাজে যোগ দিতে না পারায় হতাশ নিয়োগের জন্য সুপারিশ পাওয়া চাকরিপ্রত্যাশীরা।
নিয়োগ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বলছে, নিয়োগের প্রাথমিক সুপারিশ পাওয়া প্রার্থীদের ভেরিফিকেশন কার্যক্রম চলছে। তবে সবার পুলিশ ভেরিফিকেশন শেষ হয়নি। ভেরিফিকেশন প্রক্রিয়া শেষ হলে নিয়োগপ্রক্রিয়া শেষ হবে। তাদের দাবি, আন্তরিকতা নিয়েই পুলিশ প্রতিবেদন শেষ করার কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে।
আরও পড়ুন: লকডাউন হলে ভেরিফিকেশন কার্যক্রম পেছাবে
এদিকে চাকরির জন্য প্রাথমিকভাবে সুপারিশ পাওয়া অনেক প্রার্থী পুলিশ ভেরিফিকেশন নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন। তারা বলছেন, শিক্ষক নিয়োগের জন্য প্রথম ও দ্বিতীয় গণবিজ্ঞপ্তিতে পুলিশ ভেরিফিকেশনের বিষয়টি ছিল না। পুলিশ ভেরিফিকেশন না থাকায় প্রথম গণবিজ্ঞপ্তিতে চূড়ান্ত ফল প্রকাশের ৩০ দিনের মধ্যে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল এবং দ্বিতীয় গণবিজ্ঞপ্তিতে ১৫ দিনের মধ্যে নিয়োগ দেওয়া হয়।
প্রার্থীরা জানান, তিন বছর অতিবাহিত হলেও তৃতীয় গণবিজ্ঞপ্তির কার্যক্রম শেষ করতে পারেনি এনটিআরসিএ। চূড়ান্তভাবে উত্তীর্ণ হয়েও নিয়োগ না পাওয়ায় হতাশা ও অনিশ্চয়তায় দিন পার করছেন তারা। সব ধাপে উত্তীর্ণ হয়েও নিয়োগ না পাওয়ায় ক্ষোভ জানিয়েছেন প্রার্থীরা। এভাবে আর কত অপেক্ষা করতে হবে সেই প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছেন কর্তৃপক্ষে কাছে।
আরও পড়ুন: মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা পেলে ভেরিফিকেশন ছাড়াই যোগদান: এনটিআরসিএ
এ প্রসঙ্গে তৃতীয় গণবিজ্ঞপ্তিতে সুপারিশ পাওয়া প্রার্থী মো. আলী জানান, শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং এনটিআরসিএ চাইলে ভেরিফিকেশন চলমান রেখেও সুপারিশপত্র দিতে পারে। তবে সেটি তারা করছে না। কবে সবার ভেরিফিকেশন শেষ হবে আর কবে যোগদান করতে পারবো সেই অনিশ্চয়তা কাটছে না।
তৃতীয় গণবিজ্ঞপ্তিতে সুপারিশ পেয়ে বেসরকারি এনজিওর চাকরি ছেড়ে দিয়েছি জানিয়ে আরেক প্রার্থী মো. জয়নাল জানান, বেসরকারি একটি এনজিওতে চাকরি করতাম। তৃতীয় গণবিজ্ঞপ্তিতে সুপারিশ পাওয়ার পর চাকরি ছেড়ে দিয়েছি। ৩ মাসের বেশি সময় হয়ে গেলেও এখনো চূড়ান্ত যোগদানপত্র পাইনি। পরিবার নিয়ে খুব কষ্টের মাঝে দিন পারতে করতে হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (বেসরকারি মাধ্যমিক) ফৌজিয়া জাফরীন দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সুপারিশপ্রাপ্তদের ভেরিফিকেশন কার্যক্রম দ্রুত শেষ করা হবে। এর বেশি কিছু বলা সম্ভব নয়।
আরও পড়ুন: ১৭তম নিবন্ধনের নতুন বিজ্ঞপ্তি জানুয়ারি অথবা ফেব্রুয়ারিতে
এনটিআরসিএ সূত্র জানায়, সারা দেশে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে ৫৪ হাজার ৩০৪ জন শিক্ষক নিয়োগের জন্য ২০১৮ সালের ২৮ নভেম্বর বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। ১৫তম শিক্ষক নিবন্ধনের এই প্রিলিমিনারি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয় ২০১৯ সালের ১৯ এপ্রিল। প্রিলিমিনারিতে উত্তীর্ণ প্রার্থীদের লিখিত পরীক্ষা হয় ২০১৯ সালের জুলাইয়ে। এরপর মৌখিক পরীক্ষা হয় ২০১৯ সালের ১২ নভেম্বর থেকে ২০২০ সালের ৫ জানুয়ারি পর্যন্ত। প্রিলিমিনারি, লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা শেষে চূড়ান্ত ফল প্রকাশ করা হয় গত বছরের ১৫ জানুয়ারি।
এদিকে, ২০২১ সালের ৩০ মার্চ ৫৪ হাজার শূন্যপদের বিপরীতে গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। তবে বিভিন্ন নিবন্ধনের রিটকারীদের জন্য ২ হাজার ২০০টি পদ সংরক্ষণ করে বাকি পদগুলোতে শিক্ষক নিয়োগের উদ্যোগ নেয়া হয়। আবেদন না পাওয়ায় এবং মহিলা কোটায় যোগ্য প্রার্থী না থাকায় ১৫ হাজার ৩২৫টি পদ ফাঁকা রেখে ৩৮ হাজার ২৮৬ পদে নিয়োগের সুপারিশ করা হয়। তবে ৬ হাজার ৩ জন প্রার্থী পুলিশ ভেরিফিকেশনের ফরম পূরণ করে না পাঠানোয় ৩২ হাজার ২৮৩ জনের পুলিশ ভেরিফিকেশন করা হচ্ছে। এই কার্যক্রম শেষ না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন প্রার্থীরা।
আরও পড়ুন: ১৭তম নিবন্ধনের সংশোধিত সিলেবাস প্রকাশ
এ বিষয়ে জানতে চাইলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (বেসরকারি মাধ্যমিক) ফৌজিয়া জাফরীন বলেন, বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সুপারিশপ্রাপ্তদের ভেরিফিকেশন কার্যক্রম দ্রুত শেষ করা হবে। এর বেশি কিছু বলা সম্ভব নয়।
এদিকে ভেরিফিকেশন ছাড়াই যোগদান অথবা ভেরিফিকেশন চলমান রেখে যোগদানের জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা প্রয়োজন বলে জানিয়েছেন বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তারা। তারা বলছেন প্রার্থীদের দ্রুত চূড়ান্ত সুপারিশপত্র আমরাও দিতে চাই। তবে মন্ত্রণালয়ের লিখিত নির্দেশনা ছাড়া এটি বাস্তবায়ন সম্ভব নয়।
আরও পড়ুন: ২৭ ডিসেম্বরের মধ্যে বাদ পড়াদের ভি রোল ফরম পাঠানোর নির্দেশ
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সুরক্ষা সেবা বিভাগের এক কর্মকর্তা জানান, সরকার যদি আবার লকডাউন ঘোষণা করে তাহলে তো ভেরিফিকেশন কার্যক্রম চলমান রাখা সম্ভব হবে না। কেননা আগে জীবন, পড়ে জীবিকা।
এদিকে বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষের (এনটিআরসিএ) কর্মকর্তারা বলছেন, লকডাউন হলে পুলিশ ভেরিফিকেশন কার্যক্রমে ধীরগতি আসবে। তবে সে ধরনের পরিস্থিতি যেন তৈরি না হয় সেটিই প্রত্যাশা থাকবে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে এনটিআরসি সদস্য (পরীক্ষা মূল্যায়ন ও প্রত্যয়ন) এ বি এম শওকত ইকবাল শাহীন দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, শিক্ষকদের পুলিশ ভেরিফিকেশন কার্যক্রম চলমান রয়েছে। দ্রুত সময়ের মধ্যে ভেরিফিকেশন শেষ করার জন্য আমরা সময় সুরক্ষা সেবা বিভাগের সাথে যোগাযোগ রাখছি। তারাও এ বিষয়ে আন্তরিক।