প্রীতি নেই, রয়ে গেছে মায়ের বুকচেরা আক্ষেপ

সামিয়া আফনান প্রীতি
সামিয়া আফনান প্রীতি   © ফেসবুক থেকে সংগৃহীত

খোলা আকাশটা আজ নীরব, মেঘের গর্জন নেই। খোলা আকাশে উড়ে বেড়ানো মেয়েটি এখন ভিন্ন জগতে। চঞ্চল সেই মেয়েটি আর কখনো এই খোলা আকাশের নিচে ফিরবে না। মেয়েটিকে কেউ আর বলবে না বিচিত্র বিশ্বাস নীল-এর কবিতার চরণ ‘তোমার কী ভালো লাগে একবার বলো তো নীলান্তি? এই পৃথিবীর নীল আকাশ আর আলোকিত-জ্যোৎস্না দেখতে ইচ্ছে করে তো?’

বৃহস্পতিবার রাতে শাহজাহানপুরে মতিঝিল থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল ইসলাম টিপুকে হত্যার উদ্দেশ্যে গুলি চালায় দুর্বৃত্তরা। সেই গুলিতে রিকশায় থাকা সামিয়া আফনান জামাল প্রীতি নিহত হন।

মেয়ে প্রীতি নেই। তবে মেয়ের স্মৃতিতে মুড়ানো জিনিসপত্র আঁকড়ে বেঁচে আছেন মা। মা-বাবা জানেন প্রীতি আর ফিরবে না। প্রীতি ফিরবেই না। তবুও প্রীতির আঙ্গুলের পরশ মাখা পানি খাওয়ার মগটিও সযত্নে রেখে দেওয়া হয়েছে। এই মগে আর কেউ পানি খাবে না। আছে বই, রয়ে গেছে পড়ার সেই টেবিল। তবে প্রীতি! সে আজ পরকালের বাসিন্দা। পুরো বাড়ি আনন্দে মাতিয়ে রাখতো সে। সেই বাসায় আজ শোকের মাতম।

ঘ
প্রীতি ও তার বিড়াল 

শখ করে বিড়াল পালন করতেন প্রীতি। এ নিয়ে মাঝেমধ্যে বন্ধু মহলেও আলাপ হতো। প্রীতির ফেসবুক পোস্টে সেই বিড়াল নিয়েও একাধিক স্মৃতি শেয়ার করেছেন তিনি। তিনি লিখেছিলেন, ‘বিলাই পালবা আর কামড় খাইবা না? তা কি হয়?’

চারদিন হয় মেয়ে বান্ধবীর বাসায়। বাসায় ফেরেনি। মা মেয়ে একত্রে বসে আড্ডাও জমেনি। কেউ রান্না ঘরে এসে বলছে না। মা, ও মা! একটু বাহিরে যাই?

প্রীতি ফেসবুক আইডি ঘেঁটে দেখা যায়, মার সঙ্গে বাহিরে যাওয়া নিয়ে খুঁটিনাটি গল্প করতেন প্রীতি। ২০২১ সালের ২৭ মার্চের পোস্ট থেকে জানা যায় প্রীতি লিখেছেন, আমি ও আমার মায়ের মধ্যে অল্প কথাবার্তা, বাহিরে যাওয়ার অনুমতি চাওয়া প্রসঙ্গে আলাপচারিতা।

শান্তিবাগের নিজ বাসায় বৃহস্পতিবার ফেরার কথা ছিল প্রীতির। বাসার প্রায় সন্নিকটে এসেই জানতে পারলেন বাসায় মামা-মামী এসেছেন। মা কল করে বললেন, ‘আজকে আর তোর বাসায় আসার দরকার নেই। আরেকদিন বান্ধবীর বাসায় থাকতে হবে।’

মায়ের কথায় প্রীতির সে রাতে আর বাসায় ফেরা হয়নি। হয়নি বান্ধবীর সঙ্গেও খোশগল্প। প্রীতি শুক্রবার বাসায় ফিরেছে। তবে মা-মেয়ের মুখে ভাষা নেই। মায়ের মধ্যে বিষণ্ণতা। মায়ের চোখভরা পানি। আর বুকভরা আক্ষেপ- মেয়ে আর ফিরবে না, মা বলে ডাকবে না। ঘাতকের বুলেটের আঘাতে প্রাণ হারিয়েছে তার মেয়ে প্রীতি।

প্রীতির বান্ধবী সুমাইয়া জানান, মা-বাবা ও ছোট ভাইয়ের সঙ্গে পশ্চিম শান্তিবাগে ভাড়া বাসায় থাকত প্রীতি। রিকশার ওঠার কিছুক্ষণ পরই একটি শব্দ শুনতে পারি। এরপরই দুইজনই রিকশা থেকে পড়ে যাই। প্রীতির গায়ে রক্ত দেখে আশেপাশের লোকজন বলেন গুলি লেগেছে।

ঘটনা শুনেই হতভম্ব হয়ে গেছে প্রীতির মা। হাসপাতালে এসেই  বাকরুদ্ধ তিনি। ‘আমি কী জানতাম এমন দুর্ঘটনা ঘটবে’ এ বলেই মাতম করছেন তিনি।

গঝজ
নিজে নিজে মেহেদি পরেছেন প্রীতি  

 

প্রীতির বাবা জামাল উদ্দিন জানান, প্রীতির মোবাইল থেকে একটা কল আসে। পুলিশ পরিচয়ে ঢাকা মেডিকেলে আসতে বলেন। এসে দেখি প্রীতি আর নেই।

প্রীতির বাবা জামালউদ্দিন রাজধানীর মিরপুরে একটি প্লাস্টিক কারখানায় চাকরি করতেন। কষ্টের সংসারে ছেলেমেয়ে নিয়ে ভালোই ছিলেন। প্রীতি প্রায়ই বলতো, সে চাকরি পেলে আমাদের আর চিন্তা থাকবে না। পরিবারের অবস্থা বিবেচনা করে ১৫ হাজার টাকায় একটা অফিসে চাকরি নিয়ে ছিল প্রীতি। এপ্রিল থেকে চাকরিতে যোগ দেওয়ার কথা ছিল প্রীতির। তবে মেয়েটার সেই স্বপ্ন পূরণ হল না বলে আক্ষেপ করেন জামাল উদ্দিন।

প্রীতি
বান্ধবীদের সঙ্গে প্রীতি 

অবসরে প্রীতি মেহেদি পরতেন। আপন আঙিনার হৃদ গহীনে থাকা নকশায় নকশায় মেহেদির রঙে নিজেকে সাজাতেন। প্রীতির ফেসবুক আইডি থেকে এ তথ্য পাওয়া যায়। 

তবে মেয়ে হত্যায় মামলা করবে না প্রীতির পরিবার। গণমাধ্যমে তার বাবা জানিয়েছিলেন, আমার মেয়ে প্রীতি হত্যায় কোন মামলা করবো না। আমরা কখনো মামলায় জড়াই নাই। আমরা নিরীহ-সাধারণ মানুষ।

তিনি আরও জানিয়ে ছিলেন, আমি মুক্তিযোদ্ধার সন্তান। সাধারণ জীবনযাপন করি। বিচার চেয়েই বা কী হবে? বাংলাদেশে তো বিচার নাই। বিচার কার কাছে চাব, বলেন? সন্তানের কাছেই বাবার বিচার থাকে না। আর এ তো প্রশাসন। আমি নিরীহ মানুষ নিরীহভাবেই থাকতে চাই, ঝামেলায় জড়াতে চাই না।

আরও পড়ুন : যাদের গুলিতে প্রীতি মারা গেছে তাদের মনটা খুব খারাপ

তবে প্রীতির হত্যার ব্যাপারে জানতেন না ভাড়াটে খুনি মাসুম উরফে আকাশ। সংবাদ মাধ্যম থেকে এ তথ্য জেনেছেন তিনি। প্রীতি হত্যার বিষয়ে মাসুম কী জানিয়েছে প্রশ্নে ডিবির প্রধান এ কে এম হাফিজ আক্তার বলেন, প্রীতি নিহতের বিষয়ে মাসুম আগে জানতেন না, পরে জেনেছেন বলে তিনি আমাদের জানিয়েছেন। মাসুম যখন গুলি করছিলেন, তখন অস্ত্রের ট্রিগার চেপে ধরে রেখেছিলেন। সেই গুলিতে টিপুর সঙ্গে নিহত হন রিকশা আরোহী সামিয়া আফরান জামাল প্রীতি। আর এই ঘটনা পরে জেনেছেন মাসুম। 

প্রীতি নেই, তবে রয়ে গেছে প্রীতির মা-বাবার আক্ষেপ। আগামীর দিনগুলোয় মেয়ের প্রীতির স্মৃতি জড়ানো ভালবাসায় বাঁচতে চান তারা।


সর্বশেষ সংবাদ