আনিসুজ্জামানের মৃত্যুর কারণ ‘করোনা’ নয়

জাতীয় অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামানের মৃত্যুর পর জানা গেল তিনি করোনা পজিটিভ। কিন্তু মৃত্যুর আগে দুইবার টেস্টের ফল নেগেটিভ এসেছিল। বৃহস্পতিবার বিকেলে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল (সিএমএইচ)-এ চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান জাতীয় অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান।

তাঁর চিকিৎসা পরামর্শক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ, ইউনিভার্সেল মেডিকেল কর্তৃপক্ষ ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের সাথে কথা বলে করোনা সংক্রান্ত এই তথ্য জানা গেছে। শেষ পর্যন্ত করোনা পজিটিভ হওয়ায় তাঁকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইড লাইন মেনে শুক্রবার সকালে আজিমপুর কবরস্থানে তাঁর বাবার কবরের পাশে দাফন করা হয়।

দাফনের আগে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাঁকে গার্ড অব অনার দেয়া হয়। জানাজায় পরিবারের পক্ষ থেকে অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের ছেলে আনন্দ জামান, ভাই আখতারুজ্জামান ও মেয়ে জামাই আজিমুল হক উপস্থিত ছিলেন। সকাল পৌনে ১১ টার দিকে দাফনের কাজ শেষ হয়।

অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের ছেলে আনন্দ জামান জানান, ‘‘১০ মে একবার বাবার করোনা টেস্ট হয়েছিল সিএমএইচ-এ৷ তখন নেগেটিভ আসে। কিন্তু আবারো টেস্টে করা হয়ে মৃত্যুর পর জানা যায় তার করোনা পজিটিভ।’’ তিনি জানান, ‘‘শুক্রবার ভোরে জ্বর আসার পর করোনা টেস্টের জন্য স্যাম্পল নেয়া হয়৷ কিন্তু রেজাল্ট আসার আগেই তিনি মারা যান। মারা যাওয়ার পরে রাতেই রিপোর্ট আসে করোনা পজিটিভ।’’

এমন হওয়ার কারণ জানতে চাইলে আনন্দ জামান বলেন, ‘‘তার করোনার সেরকম কোনো সিম্পটমও আগে দেখা যায়নি। আর সিএমএইচ-এর আগে তিনি ইউনিভার্সেল মেডিকেলে ছিলেন। সেখানে তার করোনা পরীক্ষা করা হয়নি।’’ করোনা প্রসঙ্গে পরিবারের পক্ষ থেকে আর চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলা হয়নি। আনন্দ জামান বলেন, ‘‘এখন আর কথা বলে কী হবে! তিনি তো মারাই গেছে।’’

অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের ছোটভাই আখতারুজ্জামান বলেন, ‘‘আমরা আগে কোনো টেস্টেই করোনার কথা জানতে পারিনি। তিনি মারা যাওয়ার পর হাসপাতাল থেকে বলা হলো করোনা টেস্ট করা হবে। রেজাল্ট পেতে সাড়ে ছয় ঘণ্টা লাগবে। তার আগে লাশ দেয়া যাবে না। রেজাল্টে তার করোনা পজিটিভ জানানো হয়।’’ তবে তিনি আরো জানান, ‘‘তার শারীরিক অবস্থা খুব খারাপ ছিল। চিকিৎসকরা বলছিলেন তার ওপর ওষুধ তেমন কাজ করছে না।’’

অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের বয়স হয়েছিল ৮৩ বছর। ২৭ এপ্রিল এই শিক্ষাবিদকে ঢাকার ইউনিভার্সেল কার্ডিয়াক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়৷ তাঁর হার্ট, কিডনি, ফুসফুস, উচ্চ রক্তচাপ, পারকিনসন ডিজিজসহ নানা শারীরিক জটিলতা ছিল।

৯ মে প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগে তাঁকে সিএমএইচ-এ স্থানান্তর করা হয়। উভয় হাসপাতালেই তাঁর চিকিৎসার ব্যাপারের নিয়মিত পরামর্শ দেন প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক, মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ। তিনি বলেন, ‘‘সিএমএইচ-এ নেয়ার পর ৯ মে তার প্রথম করোনা টেস্ট করা হয়। এরপর ১০ মে আবার টেস্ট করা হয়। দুইবারই করোনা নেগেটিভ আসে। তার করোনার সিম্পটমও ছিলোনা। তবে মৃত্যুর পর টেস্টে করোনা পজিটিভ আসে।’’

আর ইউনিভার্সেল কার্ডিয়াক হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আশীষ চক্রবর্তী বলেন, ‘‘আমাদের এখানে স্যার ২৭ এপ্রিল থেকে ৯ মে সকাল পর্যন্ত চিকিৎসাধীন ছিলেন৷ তখন আমরা তার কোনো করোনা টেস্ট করিনি৷ কারণ, তার মধ্যে আমরা করোনার উপসর্গ দেখিনি।’’

‘মৃত্যুর মূল কারণ হার্ট অ্যাটাক’: ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ বলেন, ‘‘ইউনিভার্সেল মেডিকেল এবং সিএমএইচে চিকিৎসকরা তার চিকিৎসার ব্যাপারে আমার সঙ্গে নিয়মিত পরামর্শ করেছেন। তিনি নানা ধরণের জটিল রোগে ভুগছিলেন। হার্ট, ব্রেইন স্ট্রোক, ডায়াবেটিস, প্রেসার, কিডনি সমস্যা ছিল। তার পিঠের কাছে কয়েকটা হাড়ও ভাঙা ছিল।’’

দুইবার নেগেটিভ আসার পর পজিটিভ আসার কারণ কী হতে পারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘এটা স্যাম্পল কালেকশনের ওপর নির্ভর করে। অথবা তার করোনা সংক্রমণ পরেও হতে পারে, আগে হয়তো ছিল না। সিএমএইচ-এ তো অনেক করোনা রোগী আছে। তবে তার মৃত্যুর মূল কারণ হার্ট অ্যাটাক।’’

বিষয়টি নিয়ে সিএমএইচ-এর সঙ্গে কথা বলা যায়নি। আইএসপিআর জানিয়েছে, ‘তাঁর পরিবার যে স্টেটমেন্ট দিয়েছে সেটা। সিএমএইচ আলাদা কোনো স্টেটমেন্ট দেবে না।’’

‘আগে নেগেটিভ, পরে পজিটিভ হতে পারে’: আইইডিসিআর-এর সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মোশতাক আহমেদ বলেন, ‘‘করোনা নেগেটিভ আসা মানে এই নয় যে, তিনি করোনামুক্ত৷ উপসর্গ ডেভেলপ করার আগে টেস্টে পজিটিভ রেজাল্ট আসার সম্ভাবনা অনেক কম। সর্বোাচ্চ দুইদিন আগে পজিটিভ আসতে পারে। যখন পরীক্ষা করা হয়েছে তখন ধরা না পড়লেও পরে ধরা পরতে পারে। আর তিনি হাসপাতালে ছিলেন, তার কাছে আত্মীয়-স্বজন গেছেন, চিকিৎসায় নানা ধরনের যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হয়েছে৷ যে কোনো সূত্র থেকে তিনি ইনফেকটেড হতে পারেন৷ হাসপতালে করোনা সংক্রমণের নানা সূত্র থাকতে পরে। যেদিন তিনি মারা গেছেন. সেদিন সকাল থেকে তার জ্বর ছিল। তখন সিম্পটম দেখা গেছে।’’

তিনি মনে করেন, ‘‘করোনা পরীক্ষার স্যাম্পলেও ত্রুটি থাকতে পারে। স্যাম্পল কালেকশন, সংরক্ষণ বা পরিবহণে কোনো ত্রুটি থাকলেও সঠিক ফল না-ও আসতে পারে। যেমন গলা বা নাকের ঠিক যে জায়গা থেকে স্যাম্পল নেয়ার কথা সেখান থেকে যদি না নেয়া হয়৷ এটা অনুমান করে বলছি৷ কিন্তু সিএমএইচে এটা হওয়ার কথা নয়৷ কারণ, সেখানে প্রশিক্ষিত লোকজন কাজ করেন।’’ তাঁর মতে, ‘‘ যারা এটা নিয়ে কাজ করেছেন. তারা, ভাইরোলেজিস্টদের সাথে মিলে রিপোর্ট অ্যানালাইসিস করে হয়তো সঠিক তথ্য দিতে পারেন।''

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের পরিবার। তাঁর ছোটভাই আখতারুজ্জামান জানান, ‘‘প্রধানমন্ত্রী সার্বক্ষণিকভাবে তার চিকিৎসার খোঁজ-খবর নিয়েছেন। যা করা প্রয়োজন, সব উদ্যোগ নিয়েছেন। আমরা তাঁর কাছে ঋণী। শুধু দুঃখ একটাই করোনা পজিটিভ হওয়ার কারণে স্বাভাবিকভাবে তার দাফন করতে পারলাম না। সবাই মিলে তাকে শেষ বিদায় জানাতে পারলাম না।’’ সূত্র: ডয়েচে ভেলে


সর্বশেষ সংবাদ