যুগে যুগে নবীদের রোজা কেমন ছিল
- টিডিসি ডেস্ক
- প্রকাশ: ০১ মার্চ ২০২৫, ১০:৪৫ PM , আপডেট: ০১ মার্চ ২০২৫, ১১:২১ PM

রহমত, মাগফিরাত ও নাজাত সম্বলিত মাস রমজান। ইসলামের অন্যান্য ফরজ বিধানের ন্যায় রমজানের রোজাও ফরজ। রোজা পূর্বেকার সকল নবীদের উপর ফরজ ছিল। আল্লাহ তাআলা হজরত আদম (আ.)-কে সৃষ্টি করার পর তাঁকে একটি বিশেষ ফল আহার করতে বারণ করেছেন। এটাই মানব ইতিহাসের প্রথম সিয়াম সাধনা।
কুরআনে পাকের যে আয়াত দ্বারা উম্মাতে মুহাম্মাদির জন্য রোজাকে ফরজ করা হয়েছে, সে আয়াতেই আল্লাহ তাআলা পূর্ববর্তীদের ওপর রোজা ফরজ হওয়ার বিষয়টি জানিয়ে দেন। আল্লাহ তাআলা বলেন- ‘হে ইমানদারগণ! তোমাদের ওপর সিয়াম বা রোজা ফরজ করা হয়েছে; যেভাবে তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর ফরজ করা হয়েছিল; যাতে তোমরা তাকওয়া (আত্মশুদ্ধি) অর্জন করতে পার। (সুরা বাকারা : আয়াত ১৮৩)
আলোচ্য আয়াত থেকে জানা যায় যে, আল্লাহ তাআলা সব যুগের নবি-রাসুলদের জন্য রোজা রাখাকে আবশ্যক করে দিয়েছিলেন। ইসলামের আগে নবি-রাসুলদের রোজার কিছু তথ্য তুলে ধরা হলো-
আদম (আ.)-এর সময়ে রোজা
ফতহুল বারিতে এসেছে, ‘হজরত আদম (আ.) যখন আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করে জান্নাতের ফল খেয়েছিলেন তখন তিনি ৩০ দিন পর্যন্ত তাওবা করেছিলেন। ৩০ দিন পর আল্লাহ তাআলা তাওবা কবুল করেন। তারপর থেকে তাঁর সন্তানদের জন্য ৩০টি রোজা ফরজ করে দেয়া হয়।
নুহ (আ.)-এর সময়ে রোজা
দুনিয়ার প্রথম রাসুল ছিলেন হজরত নূহ (আ.)। সে সময়ও রোজার প্রচলন ছিল। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘হজরত নূহ (আ.) শাওয়াল মাসের ১ তারিখ এবং জিলহজ মাসের ১০ তারিখ ছাড়া সারা বছর রোজা রাখতেন।’ (ইবনে মাজাহ)
হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর সময়ে ও পরবর্তী যুগের রোজা
হজরত নূহ (আ.) পর সর্বাধিক পরিচিত নবি ছিলেন হজরত ইবরাহিম (আ.)। আল্লাহ তাআলা তাকে খলিল তথা বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করেন। বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, তাঁর যুগেও ৩০টি রোজা রাখা আবশ্যক ছিল।
আরও পড়ুন: নবী করিম (সা.) রমজান কীভাবে কাটাতেন
মুসা (আ.)-এর সময়ে রোজা
আল্লাহ তাআলা হজরত মুসা (আ.)-কে আসমানি কিতাব ‘তাওরাত’ নাজিল করার আগে ৪০ দিন রোজা রাখার নির্দেশ দিয়েছিলেন। হজরত মুসা (আ.) তুর পাহাড়ে রোজা পালনে ক্ষুধা ও পিপাসায় ৪০ দিন অতিবাহিত করেছিলেন।
সে হিসেবে মুসা (আ.)-এর অনুসারীরা ৪০ দিন পর্যন্ত রোজা পালনকে উত্তম বলে বিবেচনা করতেন। ৪০তম দিনে রোজা রাখাকে তারা ফরজ তথা আবশ্যক মনে করতো। আর তা ছিল তাদের সপ্তম মাসের (তাশরিন) দশম তারিখ। এ দশম দিন ছিল তাদের কাছে আশুরা।
এ আশুরার দিনে আল্লাহ তাআলা হজরত মুসা (আ.)-কে ১০ আহকাম দান করেছিলেন। আর এ কারণেই তাওরাতে ১০ তারিখ রোজা পালনের জন্য জোর তাগিদ করা হয়। এছাড়াও ইয়াহুদিদের অন্যান্য ছহিফাগুলোতেও অন্যান্য দিনে রোজা পালনের হুকুম পাওয়া যায়।
হজরত দাউদ (আ.)-এর সময়ে রোজা
হজরত মুসা (আ.)-এর পর আসমানি কিতাবের অধিকারী ছিলেন হজরত দাউদ আলাইহিস সালাম। তাঁর যুগেও ছিল রোজার প্রচলন। তিনি একদিন পর পর রোজা রাখতেন। (বুখারি, মুসলিম, মিশকাত) সে হিসেবে তিনি বছরের অর্ধেক সময় রোজা রেখে অতিবাহিত করতেন।
হজরত ইসা (আ.)-এর সময়ে রোজা
নিজেকে আসমানি কিতাবের ধারক হিসেবে তৈরি করতে হজরত ঈসা (আ.) কিতাব আসার আগে দীর্ঘ ৪০ দিন পর্যন্ত রোজা রেখেছিলেন। ৪০ দিন রোজা পালনের পর আল্লাহ তাআলা হজরত ঈসা (আ.)-কে আসমানি গ্রন্থ ইঞ্জিল দান করেন। আর খ্রিষ্টান ধর্মে এখনও রোজা রাখার প্রভাব বিদ্যমান রয়েছে।
হজরত ইয়াহইয়া (আ.)-এর সময়ে রোজা
হজরত ঈসা (আ.)-এর সমসাময়িক নবি ছিলেন হজরত ইয়াহইয়া (আ.)। তিনি নিজে রোজা রাখতেন এবং তার অনুসারীগণের মধ্যেও রোজা রাখার রীতি বিদ্যমান ছিল।
রোজার গুরুত্ব সম্পর্কে হজরত ঈসা (আ.)-এর বর্ণনা
হজরত ঈসা (আ.)-এর কাছে তার অনুসারীরা জিজ্ঞাসা করতো যে, আমরা আমাদের অপবিত্র অন্তরসমূহকে পূতপবিত্র করতে কী করতে পারি? বা কীভাবে অন্তরসমূহকে অপবিত্রতা থেকে পবিত্র করতে সক্ষম হবো?
হজরত ঈসা (আ.) তাদেরকে বলেছিলেন, ‘অন্তরসমূহের কলুষতা ও অপবিত্রতাকে পবিত্র রাখতে রোজা এবং দোয়ার বিকল্প নেই। অন্তর পবিত্র করতে রোজা রাখার নসিহত করেছিলেন।
প্রিয়নবির ঘোষণায় রোজার গুরুত্ব
রোজার গুরুত্ব ও তাৎপর্য তুলে ধরে প্রিয়নবি (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘যে ব্যক্তি সিয়াম পালন করেও মিথ্যা কথা বলা, পরনিন্দা ও অন্যান্য পাপাচার থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারলো না; তার পানাহার পরিত্যাগ করায় আল্লাহর কোনো প্রয়োজন নেই।’ (বুখারি)
এ কারণে পূর্ববর্তী যুগের সব নবি-রাসুলদের সময়ও এ কথার ঘোষণা ছিল যে, তোমরা যখন রোযা রাখবে তখন লোক দেখানো মনোবৃত্তি নিয়ে মানুষের মত নিজেদের মুখমন্ডলকে উদাস করে রাখবে না। কেননা, এই শ্রেণীর মানুষ নিজেদের মুখমন্ডলের আসল রূপ বিকৃত করে রোজাদার রোজাদার ভাব গ্রহণ করতো। যাতে মানুষ মনে করে যে তারা রোজাদার।
প্রাক ইসলামি যুগে আরবাসীরাও রোজা সম্পর্কে ওয়াকিফ হাল ছিল এবং তা পালনে সক্রিয় ছিল। মক্কার কুরাইশরা জাহেলিয়াতের যুগে ১০ মহররম রোজা রাখতো। এ দিনে পবিত্র কাবায় নতুন কিসওয়া বা গিলাফ পরিধান করানো হতো। (মুসনাদে আহমদ)
প্রাক ইসলামি যুগে মদিনার ইয়াহুদিরাও পৃথক পৃথকভাবে আশুরার উৎসব ও রোজা পালন করতো। (বুখারি) তাদের রোজা পালনের দিনক্ষণ ছিল তাদের নিজেদের গণনার সপ্তম মাসের ১০ম দিন। প্রিয়নবি মদিনায় হিজরতের পরও ইয়াহুদিরা রোজা পালন করতেন। যা দেখে প্রিয় নবি (সা.) বলেছিলেন, তোমাদের চেয়ে আমরাই এ রোজা রাখার হকদার বেশি।
সুতরাং মুমিন মুসলমানের আত্মায় তাকওয়ার বীজ বপনে রোজার বিকল্প নেই। রোজা রাখলেই মানুষ মুত্তাকি হয়ে যায়। রোজা মানুষকে মুত্তাকি হতে প্রস্তুত করে। আল্লাহর ভয় অর্জন করে পরিশুদ্ধ জীবন গঠনের অন্যতম প্রশিক্ষণও এ রোজা পালন।