সৌদির সঙ্গে বাংলাদেশের যেসব জেলায় আজ রোজা শুরু

চাঁদপুরের হাজীগঞ্জের সাদ্রা দরবার শরিফ
চাঁদপুরের হাজীগঞ্জের সাদ্রা দরবার শরিফ  © সংগৃহীত

সৌদি আরবে শুক্রবার (২৮ ফেব্রুয়ারি) পবিত্র রমজান মাসের চাঁদ দেখা গেছে। সে মোতাবেক আজ শনিবার থেকে দেশটিতে রোজা শুরু হয়েছে। এদিকে বরাবরের মতো পরদিন বাংলাদেশে অর্থাৎ আগামীকাল রোববার থেকে রোজা পালন শুরু হবে।

তবে দীর্ঘ বছর ধরে সৌদি আরবের সঙ্গে মিল রেখে রোজা ও ঈদ উদযাপন করে আসছে বাংলাদেশের কয়েকটি জেলার মানুষ। আজ দেশের কয়টি জেলায় রোজা শুরু হয়েছে, জেনে নেওয়া যাক-

চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায় রোজা শুরু
সাতকানিয়ার মির্জারখীল দরবারের অনুসারীরা দীর্ঘদিন ধরে সৌদি আরবের সঙ্গে মিল রেখে রোজা ও ঈদ উদযাপন করে আসছে।

স্থানীয় সূত্র জানায়, মির্জারখীল ছাড়াও উপজেলার সোনাকানিয়া, ছোটহাতিয়া, আছারতলি, সাইরতলি, গারাঙ্গিয়া, এওচিয়া, খাগরিয়া, ছদাহা, গাটিয়াডাঙ্গা এবং লোহাগাড়া উপজেলার কলাউজান, বড়হাতিয়া, পুটিবিলা, চরম্বা ও চুনতি, বাঁশখালী উপজেলার জালিয়াপাড়া, ছনুয়া, মক্ষিরচর, চাম্বল, শেখেরখীল, ডোংরা, তৈলারদ্বীপ ও কালিপুর পটিয়া উপজেলার হাইদগাঁও, বাহুলী, ভেল্লাপাড়াসহ ৫০ গ্রামের অর্ধ লক্ষাধিক মানুষ আজ শুক্রবার রাতে প্রথম রোজার সেহরি খেয়ে শনিবার রোজা রেখেছেন।

এ ছাড়া চট্টগ্রামের হাটহাজারী, সন্দ্বীপ, ফটিকছড়ি, বান্দরবানের লামা, আলীকদম, নাইক্ষ্যংছড়ি, কক্সবাজার সদর, টেকনাফ, মহেশখালী, কুতুবদিয়ার বেশ কয়েকটি গ্রামে মির্জাখীল দরবার শরিফের অনুসারী রয়েছেন তারাও শুক্রবার রাতে সেহরি খেয়েছেন।

আরও পড়ুন : ঢাবির হলে ছাত্রদল নেতাকে তিন ঘণ্টা পেটায় ছাত্রলীগ, পুলিশে দেন প্রক্টর

মির্জাখীল দরবারের মির্জাখীল দরবার শরীফের মেঝ সাহেবজাদা মোহাম্মদ মাসুদুর রহমান সরফরাজ গতকাল গণমাধ্যমকে বলেন, ‘প্রায় আড়াইশ বছর আগে সাতকানিয়া উপজেলার মির্জারখীল গ্রামে হযরত মাওলানা মোখলেছুর রহমান (রহ.) হানাফি মাজহাবের ফতোয়া অনুযায়ী পৃথিবীর যেকোনো দেশে চাঁদ দেখা গেলে রোজা, ঈদুল ফিতর, ঈদুল আজহাসহ সব ধর্মীয় উৎসব পালন করার ফতোয়া দিয়েছেন। তারই ধারাবাহিকতায় অনুসারীরা একই নিয়মে সব ধর্মীয় উৎসব পালন করে আসছেন।

চাঁদপুরে অর্ধশত গ্রামে রোজা শুরু
সৌদি আরবের সঙ্গে মিল রেখে চাঁদপুরের অর্ধশত গ্রামে রোজা শুরু হয়েছে আজ শনিবার (১ মার্চ)। সকালে হাজীগঞ্জের সাদ্রা দরবার শরিফের মুখপাত্র রাসেল মুন্সী তথ্যটি নিশ্চিত করেছেন।

তিনি বলেন, বহু আগে থেকেই আমরা সাদ্রা দরবার শরিফের অনুসারীরা প্রতিবছরই সৌদি আরবের সঙ্গে মিল রেখে রোজা ও ঈদ উদযাপন করি। এবারও তার ব্যতিক্রম হচ্ছে না।

স্থানীয়রা জানান, ১৯২৮ সাল থেকে হাজীগঞ্জের সাদ্রা দরবার শরিফের মরহুম পীর মাওলানা ইসহাক (রহ.) সৌদি আরবের সঙ্গে মিল রেখে রোজা ও দুই ঈদ উদযাপনের প্রচলন করেন। তার দেখাদেখি হাজীগঞ্জ ছাড়াও ফরিদগঞ্জ ও মতলব উত্তরের বেশ কিছু গ্রামসহ সব মিলিয়ে প্রায় অর্ধশত গ্রামে এভাবে রোজা ও ঈদ করা হয়।

এ বিষয়ে সাদ্রা দরবার শরিফের বর্তমান পীরজাদা মাওলানা আরিফ চৌধুরী জানান, সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর চন্দ্রমাস হিসাব করে আমরা রমজান, ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা উদযাপন করে থাকি। এটি আমাদের দীর্ঘদিনের ধর্মীয় প্রচলন। চাঁদপুরের এই বিশেষ ঐতিহ্য প্রতি বছরই আলোচনায় আসে। যা জেলার ধর্মীয় ও সামাজিক বৈচিত্র্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।

রোজা শুরু ভোলার ১০ গ্রামে
সৌদি আরবের সঙ্গে মিল রেখে প্রথম তারাবির নামাজ আদায় ও সাহরি খেয়ে পবিত্র মাহে রমজানের আনুষ্ঠানিকতা শুরু করেছেন ভোলার সাতকানিয়া মির্জাখালী দরবার শরীফ ও সুরেস্বর দরবার শরীফের অনুসারীরা। শুক্রবার (২৮ ফেব্রুয়ারি) দিবাগত রাতে প্রথম তারাবি ও সাহরি খাওয়ার মধ্য দিয়ে শনিবার (১ মার্চ) থেকে প্রথম রোজা রেখেছেন তারা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ভোলার সাত উপজেলার মধ্যে ভোলা সদর উপজেলা, দৌলতখান, বোরহানউদ্দিন, তজুমুদ্দিন, লালমোহন, চরফ্যাশন ও মনপুরায় উপজেলাতে প্রায় ৫ হাজার সাতকানিয়া মির্জাখালী দরবার ও সুরেস্বর দরবার শরীফের অনুসারী রয়েছেন। তাদের মধ্যে প্রায় ৩ হাজার অনুসারী রয়েছেন ভোলার বোরহানউদ্দিন উপজেলা টবগী ইউনিয়নের মুলাইপত্তন গ্রামে।

বোরহানউদ্দিনের টগবী ইউনিয়নের মুলাইপত্তন গ্রামের যুবক মো. রুবেল ও মো. আকরাম বলেন, সৌদি আরবের সঙ্গে মিল রেখে শুক্রবার রাতে আমাদের গ্রামের মসজিদে প্রথম খতমে তারাবির নামাজ অনুষ্ঠিত হয়েছে। রাতে সাহরি খেয়ে রোজা রেখেছি। প্রতিবছর আমরা সৌদি আরবের সঙ্গে মিল রেখে রোজা, ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহা পালন করি।

আরও পড়ুন : জাতীয় নাগরিক পার্টি নিয়ে বিএনপি-জামায়াতের প্রতিক্রিয়া

ওই গ্রামের গ্রামের আমিন মিয়া চৌকদার বাড়ি জামে মসজিদ কমিটির সভাপতি মো. মাসুম পারভেজ বলেন, ভোলা জেলার ১০টি গ্রামে সাতকানিয়া মির্জাখালী দরবার ও সুরেস্বর দরবার শরীফের আমরা প্রায় ৫ হাজার অনুসারী আছি। তাদের মধ্যে প্রায় ৩ হাজার অনুসারী আছি বোরহানউদ্দিনের টগবী ইউনিয়নের মুলাইপত্তন গ্রামে। সৌদি আরবের সঙ্গে মিল রেখে এক দিন আগে রোজা শুরু করেছি এবং এক দিন আগেই পবিত্র ঈদুল ফিতর উদযাপন করব।

পিরোজপুরে ১০ গ্রামে রোজা আজ
সৌদি আরবের সঙ্গে মিল রেখে বাংলাদেশে রমজান মাস শুরুর আগের দিনই রোজা পালন করছেন পিরোজপুরের তিন উপজেলার ১০ গ্রামের আট শতাধিক পরিবার। গতকাল রাতে তারাবির নামাজ আদায়ের মধ্যে দিয়ে শনিবার (১ মার্চ) থেকে ওই সব পরিবার রোজা পালন করছেন।

শরীয়তপুরের শুরেশ্বর দরবার শরীফের মুরিদ পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া উপজেলার মিরাজ খন্দকার রোজা রাখার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

মিরাজ খন্দকার বলেন, আমার দাদার বাবা ইনাম উদ্দিন খন্দকার থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত আমরা সৌদির সঙ্গে মিল রেখে রোজা-ঈদ পালন করে আসছি, মঠবাড়িয়া প্রায় ৭ শতাধিকের বেশি পরিবার এটা পালন করে। আমার এখানে ৮০ বছরের মতো সৌদি আরবের সঙ্গে মিল রেখে রোজা-ঈদ পালন করে আসছি।

জানা যায়, শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার শুরেশ্বর গ্রামের হজরত মাওলানা আহমেদ আলী শুরেশ্বর পীরের অনুসারীরা ১৫০ বছর ধরে প্রতি বছর সৌদি আরবের সঙ্গে মিল রেখে আগাম রোজা রাখাসহ ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা পালন করে থাকেন। সৌদি আরবের সঙ্গে মিল রেখে ওইসব পরিবার রোজা পালন করছে বলে তারা জানান।

স্থানীয় একাধিক সূত্রে জানা যায়, জেলার মঠবাড়িয়া উপজেলার সাপলেজা ইউনিয়নের ভাইজোড়া, কচুবাড়িয়া, সাপলেজা, ঝাটিবুনিয়া, খেতাছিড়া ও চকরগাছিয়া এ ৬ গ্রামের প্রায় ৭ শতাধিক, জেলার কাউখালী উপজেলার বেতকা, শিয়ালকাঠী ও পারসাতুরিয়া ইউনিয়নের প্রায় ৭৫ থেকে ৮০ পরিবার, জেলার নাজিরপুর উপজেলার শেখমাটিয়া ইউনিয়নের খেজুরতলা গ্রামের ৩৫ পরিবার, জেলার সদর উপজেলার কদমতলা ইউনিয়নের কদমতলা ও একপাই জুজখোলা গ্রামের প্রায় ৬০ পরিবার সৌদি আরবের সঙ্গে মিল রেখে আগাম রোজা রাখছেন।

আরও পড়ুন : যুদ্ধ বন্ধ নিয়ে ট্রাম্প-জেলেনস্কির বাগযুদ্ধ, তর্ক-উত্তেজনায় পণ্ড বৈঠক

নাজিরপুরের রঘুনাথপুর গ্রামের আল-আমিন জামে মসজিদের ইমাম মাওলানা কামরুজ্জামান বলেন, আমরা শুরেশ্বর পীরের অনুসারীরা প্রতিবছর সৌদি আরবের সঙ্গে মিল রেখে রোজা ও ঈদুল ফিতর এবং ঈদুল আজহা উদযাপন করে আসছি। এ বছরও একইভাবে গতকাল রাতে তারাবির নামাজ পড়ে সাহরি খেয়ে আজ রোজা পালন করছি।

নাজিরপুর উপজেলার শেখমাঠিয়া ইউনিয়নের রঘুনাথপুর গ্রামের ৩ নং ওয়ার্ড ইউপি সদস্য বাবুল খান বলেন, আমরা ৩৫টি পরিবার প্রায় ১৫ থেকে ১৭ বছর ধরে সৌদি আরবের সঙ্গে মিল রেখে রোজা, নামাজ, ঈদ পালন করে থাকি।

এদিকে তাদের দেখাদেখি পার্শ্ববর্তী বাগেরহাট জেলার অনেক পরিবার এভাবে পালন করে আসছে বলে জানান তিনি।

জামালপুরের ১৭ গ্রামে রোজা
প্রতি বছরের মতো এ বছরও সৌদি আরবের সঙ্গে মিল রেখে শনিবার থেকে রোজা রাখবেন জামালপুরের ১৭ গ্রামের মানুষ। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন জেলার সরিষাবাড়ির বলারদিয়ার জামে মসজিদের খতিব মাওলানা আজিম উদ্দিন।

শুক্রবার এশার নামাজ পর তারাবি নামাজের মধ্যে দিয়ে রোজার আনুষ্ঠানিকতা শুরু করেছেন তারা। জেলার মেলান্দহ উপজেলার রামভদ্রা, ইসলামপুরের সাপধরীর পশ্চিম মন্ডলপাড়া সরিষাবাড়ির বলারদিয়া, সাতপোয়া, সাঞ্চারপাড়, পঞ্চপীর, পাখাডুবি, বনগ্রাম, বালিয়া, বাউসী, হোসনাবাদ, পাটাবুগা, পুঠিয়ারপাড় ও বগারপাড়সহ ১৭ টি গ্রামের প্রায় ৫ শতাধিক মানুষ সৌদির সঙ্গে মিল রেখে রোজা রাখবেন।

সরিষাবাড়ির বলারদিয়ার জামে মসজিদের খতিব মাওলানা আজিম উদ্দিন জানান, অনেক দিন আগে থেকেই প্রতিবছর সৌদি আরবের সঙ্গে মিল রেখে আন্তর্জাতিক চাঁদ দেখা কমিটির সিদ্ধান্ত মোতাবেক এ এলাকার অন্তত ১৬ গ্রামের মানুষ রোজা রাখে এরই ধারাবাহিকতায় এবছরও রোজা রাখা হবে।

তিনি আরও বলেন, আধুনিক প্রযুক্তির এই যুগে সব খবর মুহূর্তের মধ্যেই পাওয়া যায়। আমাদের ধর্মীয় বিষয়ে সব কিছুই যখন সৌদি আরবকে অনুকরণ করা হয় সেহেতু ঈদ করলে দোষের কী। তাই সৌদি আরবের সঙ্গে মিল রেখে রোজা ঈদ বা অন্যান্য ধর্মীয় অনুষ্ঠান করা দোষের কিছু নয়।


সর্বশেষ সংবাদ