‘তৌহিদী জনতা’ নামে হামলা কারা করছে?
- টিডিসি রিপোর্ট
- প্রকাশ: ৩০ জানুয়ারি ২০২৫, ১০:৩১ AM , আপডেট: ৩০ জানুয়ারি ২০২৫, ১০:৩৫ AM

‘তৌহিদী জনতা’ তথা ‘বিক্ষুব্ধ মুসল্লিদের’ দাবির মুখে বাংলাদেশের দিনাজপুর ও জয়পুরহাটে নারীদের ফুটবল ম্যাচ বন্ধ করে দেওয়া হয় সম্প্রতি। বিষয়টা শুধু খেলা বন্ধেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। খেলাকে কেন্দ্র করে এক জেলায় তৌহিদী জনতা ও আয়োজকদের মধ্যে সংঘর্ষও হয়। অপর জেলায় নারীদের ফুটবল ম্যাচ বন্ধ করতে মাঠে হামলা করা হয় এবং মাঠের চারপাশে দেওয়া টিনের বেড়া ভাঙচুর করা হয়।
এই দুটি ঘটনাতেই কয়েকটি ইসলামপন্থী দলের নেতা-কর্মীদের সম্পৃক্ততার বিষয়টি বিবিসি বাংলাকে নিশ্চিত করেছে স্থানীয় প্রশাসন।
বুধবার (২৯ জানুয়ারি) ঢাকাতেই ‘মুসল্লি’দের চাপে চিত্রনায়িকা অপু বিশ্বাসের একটি অনুষ্ঠান তাকে ছাড়াই অনুষ্ঠিত হয়েছে।
মূলত গত ৫ আগস্টের পর তৌহিদী জনতা বা বিক্ষুব্ধ মুসল্লিদের নামে দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রায়ই এ রকম ঘটনা ঘটাতে দেখা গেছে। এর মাঝে কখনো আছে বিভিন্ন নারীকেন্দ্রিক অনুষ্ঠান পণ্ড করা, কখনো বা মাজারে ভাঙচুর।
ক্ষমতা গ্রহণের ছয় মাস হতে যাওয়া অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে যদিও বলা হয়েছে এসব ঘটনা মোকাবিলায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। কিন্তু দৃশ্যত তার কোনো প্রমাণ মিলছে না। বরং এ ধরনের ‘মবের’ ঘটনা ঘটেই চলেছে।
ফলে প্রশ্ন তৈরি হয়েছে, এ ধরনের হামলায় আসলে জড়িত কারা? কেন তাদের নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না।
ফিরে দেখা সাম্প্রতিক সময়
সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের অন্তত ১০টি স্থানে 'বিক্ষুব্ধ জনতার' হামলার ঘটনা ঘটেছে। তার মাঝে চারটি ঘটনায় দেখা গেছে, এসব ঘটনার সঙ্গে জড়িত অনেকের একটি সাধারণ পরিচয় হলো– হয় তারা ইসলামিক রাজনীতির সঙ্গে জড়িত, অথবা ইসলামি রাজনীতির সমর্থক।
জয়পুরহাটের ঘটনার বিষয়ে জানা যায়, এই জেলার আক্কেলপুর উপজেলার তিলকপুর উচ্চবিদ্যালয় মাঠে বুধবার নারীদের ফুটবল ম্যাচ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সেই খেলা বন্ধ করতে তার আগের দিন মঙ্গলবার বিকালে এলাকার ‘বিক্ষুব্ধ মুসল্লিরা’ জড়ো হয়ে মাঠের চারপাশের টিনের বেড়া ভাঙচুর করে বলে জানায় স্থানীয় পুলিশ-প্রশাসন।
সেই ঘটনা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকেও ছড়িয়ে পড়ে। ভিডিওতে একজনকে বলতে শোনা যায়, ‘মুসলমান মেয়েদের ঘরে রাখার জন্য আল্লাহ তাআলা বলেছেন। তারা পর্দার মধ্যে থাকবেন। সেই মেয়েদের এনে লেলিয়ে দিয়ে যুবকদের পাপাচার কাজে অগ্রসর করছে। মেয়েদের লেলিয়ে দেওয়া কীভাবে মানতে পারি! যারা মেয়েদের লেলিয়ে দিয়ে অর্থ উপার্জন করতে চান, আমি তাদের সতর্ক করতে চাই। আপনারা সাবধান হন।’
ওই ব্যক্তি তার বক্তব্যে আগামী দিনে মেয়েদের খেলা বন্ধ করারও আহ্বান জানান।
কারা, কখন, কী কারণে এ ঘটনা ঘটাল, জানতে চাইলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মনজুরুল আলম বলেন, ‘আসরের নামাজের পর তারা আক্রমণ করে। এরা সম্ভবত মাদ্রাসার ছাত্র ও মুসল্লি।’
সঙ্গে এটাও তিনি বলেন, ‘আগে থেকেই তাদের মাঝে অসন্তোষ ছিল...। প্রমীলা ফুটবল তো বাংলাদেশ থেকে নিষিদ্ধ করা হয়নি। তাহলে কেন এই অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটল, সে ব্যাপারে আমরা কিছুই জানি না।’
একই দিনে দিনাজপুরের হাকিমপুরের হিলিতেও নারী ফুটবল ম্যাচ বন্ধ করাকে কেন্দ্র করে ‘তৌহিদী জনতা’ ও আয়োজকদের মাঝে সংঘর্ষ হয়েছে। এতে কয়েকজন আহতও হয়েছেন।
হাকিমপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা অমিত রায় ও হাকিমপুর থানার ওসি সুজন মিঞা, দুজনেই জানান, ‘তৌহিদী জনতার’ পরিচয় ব্যবহার করে সেখানে এ ঘটনা ঘটানো হয়।
স্থানীয় সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলা জানা যায়, স্থানীয় যুব সমাজের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া নারীদের ফুটবল খেলাকে মেনে নিতে পারছিলেন না একটি পক্ষ।
আক্কেলপুর ও হাকিমপুর, এই দুই এলাকার ঘটনাতেই এখনো কোনো থানায় কোনো অভিযোগ জমা পড়েনি বলে জানিয়েছে স্থানীয় পুলিশ।
বুধবার ঢাকার কামরাঙ্গীরচরে একটি রেস্টুরেন্ট উদ্বোধনের কথা ছিল চিত্রনায়িকা অপু বিশ্বাসের। রেস্টুরেন্ট কর্তৃপক্ষ প্রচারণা শুরু করলে ‘মুসল্লিরা’ আপত্তি জানান। অপু বিশ্বাসকে উদ্বোধনের জন্য আনা হলে বিশৃঙ্খলা হবে বলে পুলিশকে জানান তারা।
কামরাঙ্গীরচর থানার ওসি মো. আমিরুল ইসলাম বলেন, ‘আমি ফেসবুকে এ ধরনের লেখালেখির স্ক্রিনশটও পেয়েছি। এ বিষয়টা ডিসি স্যারের কাছেও জানানো হয়। আমার কাছে রেস্টুরেন্ট মালিকরাও আসেন।’
পরে রেস্টুরেন্ট মালিকদের সম্মতিতে অপু বিশ্বাসকে ছাড়াই উদ্বোধনী অনুষ্ঠান হয়।
সাম্প্রতিক সময়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনার আরেকটি হলো হেফাজতে ইসলামের হুমকির মুখে টাঙ্গাইলের কালিহাতি উপজেলায় একটি প্রসাধনী কোম্পানির বিক্রয়কেন্দ্র উদ্বোধনের অনুষ্ঠান স্থগিতের ঘোষণা। সেটি উদ্বোধন করার কথা ছিল অভিনেত্রী পরীমনির।
এর দুই মাস আগে অর্থাৎ গত বছরের নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে চট্টগ্রামে শোরুম উদ্বোধন করতে গিয়ে একই ঢঙে 'তৌহিদী জনতার' বাধার মুখে পড়েছিলেন অভিনেত্রী মেহজাবীন চৌধুরীও।
এসবের বাইরেও দেশে নানা ধরনের মবের ঘটনা ঘটছে। যেমন ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর গত ছয় মাসে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ৮০টির বেশি মাজার ও দরবারে হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করার অভিযোগ করেছে বিশ্ব সুফি সংস্থা নামে একটি সংগঠন।
তৌহিদী জনতা আসলে কারা?
বিক্ষুব্ধ মুসল্লি, বিশেষ করে তৌহিদী জনতার নামে বারবার এই ঘটনাগুলো ঘটছে। দিনাজপুরের হাকিমপুরের ঘটনায় সেখানকার প্রশাসন সরাসরি বলেছে, তৌহিদী জনতা সেখানে বিক্ষোভ করেছে। কিন্তু এই তৌহিদী জনতা কি নির্দিষ্ট কোনো দলের সদস্য বা সমর্থক?
এই প্রশ্নের সরাসরি কোনো উত্তর কেউ দিতে পারেননি।
অর্থাৎ সাধারণভাবে তাদের কোনো দলীয় পরিচয়ে সজ্ঞায়িত করা যাচ্ছে না। তবে স্থানীয় সাংবাদিক ও প্রশাসনের বক্তব্যে একটি বিষয় স্পষ্ট যে এই তৌহিদী জনতা বিভিন্ন ইসলামভিত্তিক দলের সদস্য, কর্মী বা সমর্থক।
দিনাজপুরের হাকিমপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) অমিত রায় বলেছেন, ‘গতকাল বিক্ষোভকারীরা তৌহিদী জনতার ব্যানারে এসেছিল...তাদের রাজনৈতিক পরিচয় জানি না।’
এ প্রসঙ্গে হাকিমপুর থানার ওসি সুজন মিঞা বলেন, গতকাল সেখানে কয়েক শ ‘তৌহিদী জনতা মাঠের পাশে অবস্থান নিছিল।’
তবে তারা কারা?
এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘সকলেই আসছিল। এর মাঝে মামুনুল হক সাহেবের খেলাফত মজলিসের দায়িত্বপ্রাপ্ত নুরুল হক, তার নেতৃত্বেই হয়েছিল। তবে এখানে কেউ একক কোনো রাজনৈতিক দলের না। সবাই তো কম-বেশি। ঘটনার পর জুবায়েরপন্থী বাবলু হাজী আসছিল। ইসলামিক দল ও সংগঠনের সদস্য যেমন আছে, স্থানীয় মুসল্লিও আছেন।’
দিনাজপুরের মতো জয়পুরহাটের ঘটনার বেলায় প্রশাসনের তরফ থেকে সরাসরি 'তৌহিদী জনতার ব্যানারে' কথাটা উল্লেখ করা হয়নি।
তবে আক্কেলপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আনিছুর রহমান বলেন, ‘এখানে বিভিন্ন গ্রুপের লোকজন আছে। তৌহিদী জনগণ আছে, সাধারণ লোকজন আছে। মহিলাদের খেলা, তারা চাচ্ছিল না খেলাটা হোক।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের কাছে এখনো কেউ কোনো অভিযোগ দেয়নি। তবে আমরা যতটুকু জানতে পারছি, রাজনৈতিক লোকজনও আছে। এটায় চরমোনাই গ্রুপের আছে, জামায়াত ইসলামেরও আছে। বা স্থানীয় ধর্মপ্রাণ মুসলিমরাও আছেন।’
তার বর্ণনায়, গতকালের ঘটনায় ‘ইসলামিক দলগুলোর কর্মী, সমর্থকরাই’ ছিল।
যদিও জয়পুরহাট জেলার আক্কেলপুর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মঞ্জুরুল আলম এই বিক্ষোভকারীদের বর্ণনায় ‘মাদ্রাসার ছাত্র’ ও ‘মুসল্লি’ শব্দ ব্যবহার করেছেন।