এক্সে বাংলাদেশ নিয়ে অপতথ্য ছড়ানো নতুন অ্যাকাউন্ট দুই মাসে বেড়েছে ২১৪ শতাংশ

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও ভারতীয় গণমাধ্যমে বাংলাদেশ নিয়ে অপতথ্য ছড়ানো বেড়েছে
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও ভারতীয় গণমাধ্যমে বাংলাদেশ নিয়ে অপতথ্য ছড়ানো বেড়েছে  © সংগৃহীত

চলতি বছরের আগস্ট মাসে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর দেশের রাজনৈতিক পট পরিবর্তন হয়েছে নাটকীয়ভাবে। ব্যাপক বিক্ষোভের মুখে পতন হয় ১৫ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকা দলটির। তবে এ সময়ের আগে এবং পরে বাংলাদেশ নিয়ে অপতথ্য ছড়িয়েছে ব্যাপকহারে। এ জন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স (সাবেক টুইটার), ফেসবুক ও ইউটিউবের মতো প্ল্যাটফর্মগুলো ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হয়।

বিশেষ করে এমন অপতথ্য ছড়াতে এক্সে নতুন আইডি খোলার হার বেড়েছে ২১৪ শতাংশ। এসব অ্যাকাউন্ট থেকে ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িক উস্কানি ছাড়াও অন্তবর্তী সরকার নিয়ে ভুয়া তথ্য ছড়িয়েছেন ব্যবহারকারীরা। টেক গ্লোবাল ইনস্টিটিউটের একে প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। ‘দ্যা এনাটমি অব ডিসইনফরমেশন অন এক্স’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনে বিদেশে অপতথ্য প্রচারের বিস্তারিত তুলে ধরা হয়েছে। শামস ওয়াহিদ শাহাত, আপন দাস এবং মোহাম্মদ আরাফাত এ প্রতিবেদন তৈরি করেছেন।

অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিজিটিং পলিসি ফেলো সাবহানাজ রশীদ দিয়া ফেসবুকে প্রতিবেদনটি শেয়ার করে লিখেছেন, শুধু অক্টোবর থেকে নভেম্বরের মধ্যে এক্স-এ নতুন অ্যাকাউন্ট ২১৪ শতাংশ বেড়েছে। এসব বাংলাদেশে ধর্মীয় এবং সাম্প্রদায়িক অপতথ্য ‍ও উস্কানি ছড়াতে ব্যবহার হয়েছে। এমন বিভ্রান্তির ৩৫ শতাংশের বেশি তথ্য প্ল্যাটফর্মজুড়ে এবং তারও দুই গুন বেশি ব্যক্তিগত বার্তা পরিষেবার মাধ্যমে ছড়িয়েছে।

এতে দেখানো হয়েছে, আগস্ট মাসে অপতথ্য ছড়ানোর ক্যাম্পেইন সবচেয়ে বেশি চলেছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্য এক্সে, প্রায় ৭৭ শতাংশ। সেপ্টেম্বর মাসে ৩৫ শতাংশ কনটেন্ট এক্স, ফেসবুক ও ইউটিউবে একত্রে ছাড়া হয়েছে। অক্টোবর মাসে ফেসবুক ও ইউটিউবে ছাড়া হয়েছে ২৩ শতাংশ। নভেম্বর মাসে আর ভাইবার, মেসেঞ্জার ও হোয়াটসঅ্যাপের মতো ব্যক্তিগত মেসেজিং অ্যাপের মাধ্যমে ছড়ানো হয়েছে ৭১ শতাংশ।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ ধরনের তথ্য ছড়াতে এক্স’র নতুন অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করা হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে ভেরিফাইড মার্ক ব্যবহার করে সবাইকে বিভ্রান্ত করা হয়েছে। শীর্ষ ২০ হ্যাশট্যাগের মধ্যে #সেভহিন্দুসইনবাংলাদেশ এবং #বাংলাদেশিহিন্দুসজেনোসাইড সবচেয়ে বেশি প্রচলিত ছিল। এর সব তথ্যই ছিল ভুয়া। অ্যাকাউন্টগুলো ভারতীয়দের উদ্দেশ্য করে চালানো হয়েছে। রাশিয়া ও চীনের মতো করে অতি ডানপন্থী দলগুলো এ পন্থা অনুসরণ করেছে।

প্রতিবেদনে ভুল তথ্য ছড়ানোর কয়েকটি পন্থার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। প্রথমত, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেলের একটি ঘটনার ছবি দিয়ে তথ্য ছড়ানো হয়, বাংলাদেশে শরীয়াহ আইন ঘোষণা করা হয়েছে। ইসলামিস্টরা ক্লাসরুমে শিক্ষার্থীদের উৎপীড়ন করছেন। একই ছবি শেয়ার করে বাংলাদেশে তালেবানের শাসনের সঙ্গে তুলনা ও ক্লাসরুমের ব্যক্তিকে নিষিদ্ধ সংগঠন হিজবুত তাহরীরের বলে দাবি করা হয়।

পরে বাংলাদেশের ফ্যাক্ট চেকাররা জানান, এসব তথ্য মিথ্যা। ছবির ব্যক্তিটির নাম জুবায়ের আলী। তিনি মানসিক ভারসাম্যহীন এবং হিযবুত তাহরীরের কেউ না। পরে তাকে গ্রেপ্তারও করা হয়। এ ঘটনায় শিক্ষার্থীরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভিডিও দিলে সেটিই অপতথ্য ছড়ানোর কাজে ব্যবহার করা হয়। বেশি ছড়ানো হয় এক্স-এ।

একইভাবে গত ১৩ অক্টোবর রাধারমন দাস নামের আইডি থেকে দুই তরুণীর ছবি ছড়িয়ে দাবি করা হয়, বিজয়া দশমী থেকে ফেরার পথে দুই হিন্দু নারীকে নৃসংশভাবে হত্যা করা হয়েছে। এটিতে হিন্দুবিরোধী মনোভাবের কথা তুলে ধরে অন্তর্বর্তী সরকার সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা দিতে পারছে না বলে দাবি করা হয়। পরে ফ্যাক্টচেকাররা এটি নিয়ে অপতথ্য ছড়ানো হয়েছে বলে নিশ্চিত করেন। পরে বাংলাদেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়, পূজা বিশ্বাস ও রত্না সাহা নামে ফরিদপুরের দুই ছাত্রী পূজা উৎসব থেকে ফেরার পর বিষক্রিয়ায় (বিষাক্ত মদপান) মারা যান। এ বিষয়ে পরে আর বিস্তারিত তথ্য আর আসেনি।

দ্বিতীয়ত রাশিয়ায় ছড়ানো তথ্যের মতো হিন্দুদের হত্যা ও সহিসংতার বিষয়েও অতিরঞ্জিত তথ্য ছড়ানো হয়েছে। গত ৫ নভেম্বর চট্টগ্রামের হাজারি গলিতে হিন্দুদের ওপর হামলা চালানোর তথ্য ছড়ানো হয়। ৬ নভেম্বর বাবা বানারস আইডি থেকে কিছু ভিডিও ছড়িয়ে দাবি করা হয়, জামায়াতে ইসলামী এবং সেনাবাহিনীর হামলায় ৫০ হিন্দু হতাহত হয়েছেন। আগের হ্যাশট্যাগ ব্যবহার করেই হিন্দুদের ওপর হামলার দাবি করা হয় পোস্টে।

তবে পরে ফ্যাক্টচেকার প্রতিষ্ঠান রিউমার স্ক্যানার জানায়, চট্টগ্রামে একটি বিক্ষোভে কয়েকজন আহত হয়েছেন। কোনও মৃত্যুর ঘটনা ঘটেনি। এছাড়া তিন মাসে ২৭ হাজার হিন্দুকে হত্যার তথ্য ছড়ানো হলে সে তথ্য মিথ্যা বলে জানান ফ্যাক্টচেকাররা।

তৃতীয়ত, অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সখ্যতা আছে বলে তথ্য ছড়ানো হয়। ৭ আগস্ট ভারতীয় গণমাধ্যমে দাবি করা হয়, জেএমবি, হুজি-বির মতো জঙ্গি গোষ্ঠীর ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়েছে। তবে পরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ফ্যাক্ট চেকারদের জানিয়ে দেন, এমন ঘটনা ঘটেনি। আড়াই মাস পর লেখক তসলিমা নাসরিন এক্স পোস্টে লেখেন, হিজবুত তাহরীর ও আহসানউল্লাহ বাংলা টিমের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়েছেন তিনি ( ড. মুহাম্মদ ইউনুস)। পরে এর কোনও প্রমাণ পাওয়া যায়নি। সরকারি কোনও কর্মকর্তাও গণমাধ্যমকে এ তথ্য নিশ্চিত করেননি।

আরো পড়ুন: ভুয়া মামলাকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে: স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা

একইভাবে উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম, শেখ বসির উদ্দিন, মোস্তফা সরয়ার ফারুকি ও মাহফুজ আলমের বিরুদ্ধেও চরমপন্থী ও পাকিস্তানি জঙ্গীদের সঙ্গে সম্পৃক্ততার কথা তোলা হয় এক্স ও ভারতীয় কিছু গণমাধ্যমে। পরে ফ্যাক্ট চেকাররা জানতে পারেন, গ্রেফতার হিযবুত তাহরীর সদস্য মাহফুজ এবং উপদেষ্টা মাহফুজ আলম এক ব্যক্তি নন। অন্য অভিযোগের বিষয়েও কোনও প্রমাণ মেলেনি।

চতুর্থত সংখ্যালঘূ অধিকারের কথা বিভিন্ন তথ্য প্রচার করা হয়। কয়েকজন শিক্ষকের জোর করে পদত্যাগের কথা উল্লেখ করে বিভিন্ন ভিডিও এবং তথ্য ছড়ানো হয়েছিল। তবে পরে গণমাধ্যমের খবরে উঠে আসে ভিন্ন তথ্য। পঞ্চমত সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ছড়াতে মূল ধারার গণমাধ্যমকে কাজে লাগানো হয়। চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে গ্রেপ্তারসহ নানা ইস্যুতে ভারতীয় গণমাধ্যম এবং এক্সে অপতথ্য ছড়ানো হয়। এ জন্য ব্যবহার করা হয় চটকদার গ্রাফিক ছবি ও ভিডিও। যার সব তথ্যই ভুয়া। পুরো প্রতিবেদন দেখতে এখানে ক্লিক করুন।


সর্বশেষ সংবাদ