চাল-গম আমদানিতে আগ্রহ নেই ব্যবসায়ীদের

খাদ্যশস্য ঘাটতির শঙ্কা

চাল-গম আমদানি এখন তা শূন্যের কোটায় নেমেছে
চাল-গম আমদানি এখন তা শূন্যের কোটায় নেমেছে  © সংগৃহীত

দেশের মানুষের খাদ্যশস্য চাল, দ্বিতীয় গম। বিভিন্ন দেশ থেকে আগে চাল আমদানি হলেও এখন তা শূন্যের কোটায় নেমেছে। তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে মজুদ বাড়ানোর পাশাপাশি দাম সহনীয় রাখতে শুল্ক কমিয়ে আমদানির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এর পরও দেশের প্রধান খাদ্যশস্যটি আমদানিতে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না ব্যবসায়ীরা। ডলারের সংকটের কারণে ঋণপত্র (এলসি) জটিলতায় কমছে গম আমদানিও। বাজারে তাই খাদ্যপণ্য দুটির দাম ঊর্ধ্বমুখী। 

ব্যবসায়ীরা বলছেন, চাল আমদানি করা হলে সেটি বর্তমানে দেশের বাজারে যে দাম তার চেয়েও বেশি দাম দিয়ে ক্রেতাদের কিনতে হবে। আর বেশি দামের কারণে দেশের ব্যবসায়ীদেরও মুনাফা হবে না।

তারা মনে করেন, শুল্ক কমানো হলেও এ মুহূর্তে দেশে চালের দামে প্রভাব পড়বে না।

খাদ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে দেশে মোট গম আমদানি হয়েছিল ৬৬ লাখ ২৮ হাজার ৫৮০ টন। এর মধ্যে সরকারি পর্যায়ে আসে ৭ লাখ ৮৪ হাজার ২৮০ টন ও বেসরকারি পর্যায়ে ৫৮ লাখ ৪৪ হাজার ৩০০ টন। চলতি অর্থবছরে গত ৩ নভেম্বর পর্যন্ত আমদানি হয়েছে কেবল ১৭ লাখ ৪৮ হাজার টনের মতো। সরকারি পর্যায়ে এ চার মাসে বিশ্ববাজার থেকে গম আনা হয়েছে ২ লাখ ৪৫ হাজার ১৮০ টন, আর বেসরকারি পর্যায়ে ১৫ লাখ ২ হাজার ৫০০ টন। অন্যদিকে এ সময়ে কোনো চালই আমদানি করা হয়নি।

আরও পড়ুন: রাজধানীজুড়ে তীব্র যানজট, ভোগান্তি মানুষের

দেশে গমের চাহিদা বছরে ৭০-৭৫ লাখ টন। এর মধ্যে স্বাভাবিক সময়ে ইউক্রেন থেকে মোট চাহিদার ৬০ শতাংশ আমদানি হলেও বর্তমানে তা কমে ৪০ শতাংশে নেমেছে বলে জানান সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটি থেকে বিগত কয়েক বছর গম আমদানি অব্যাহতভাবে বাড়লেও ২০২২-২৩ অর্থবছর থেকে তা কমতে শুরু করে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ইউক্রেন থেকে গম আমদানি হয় মোট ১ হাজার ৬৫৮ মিলিয়ন ডলারের, ২০২১-২২ অর্থবছরে হয়েছিল ২ হাজার ৬৫ মিলিয়ন ডলারের। তার আগের অর্থবছর আনা হয়েছিল ১ হাজার ৫৫৮ মিলিয়ন ডলারের গম, ২০১৯-২০ অর্থবছরে যা ছিল ১ হাজার ৪৯১ মিলিয়ন ডলারের।

গম আমদানি কমেছে অন্যান্য উৎস দেশ থেকেও। রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাতের কারণে ভারতে গত দুই বছর গমের চাহিদা ব্যাপক হারে বেড়েছে। তাই খাদ্যপণ্যটির রফতানিতে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে প্রতিবেশী দেশটি। রফতানিকারক দেশ পাকিস্তানেও গম দুর্নীতি নিয়ে চলছে টানাপড়েন।

আরও পড়ুন: খাগড়াছড়ি ভ্রমণে নেই বাধা, আজ থেকে যাওয়া যাবে সাজেক

চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ পাইকারি বাজারের আমদানিকারক ও পাইকারি ব্যবসায়ীরা জানান, ইউক্রেন থেকে গম ছাড়াও ডাবলি (অ্যাংকর), ভুট্টা, ভুসিসহ বেশকিছু নিত্য খাদ্যপণ্য আমদানি হয়। অনেকে গম আমদানি কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে ভারতের সরবরাহ সংকট ও মূল্যবৃদ্ধি কিংবা ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধকে দায়ী করলেও ব্যবসায়ীরা মূলত ডলার সংকট, এলসি খুলতে জটিলতাসহ ব্যাংকগুলোর তারল্য সংকটকে সামনে আনছেন। এ কারণে দেশের সার্বিক খাদ্যশস্য মজুদ (চাল ও গম) অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় এখন কম।

এদিকে গত আগস্টে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ভয়াবহ বন্যায় আমনের ক্ষতি ও আমদানি না হওয়ায় খাদ্যশস্য ঘাটতির শঙ্কা দেখা দিয়েছে। বর্তমান মজুত দিয়ে সরকার সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে পারবে কি না, তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে। কারণ গত বছর এই সময়ে সরকারি গুদামে যে পরিমাণ খাদ্যশস্য মজুত ছিল, চলতি বছর একই সময়ে তার চেয়ে প্রায় ৪ লাখ মেট্রিক টন চাল-গম কম মজুত রয়েছে। বর্তমান মজুত দিয়ে সংকট মোকাবিলা দুরূহ হয়ে পড়বে বলে মনে করছেন খাদ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।

আরও পড়ুন: সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ইসলামী মহাসম্মেলনে আলেম-ওলামাদের ঢল

জানা গেছে, বর্তমানে সরকারি গুদামে চাল ৯ লাখ মেট্রিক টন এবং গম ৪ লাখ মেটিক টন অর্থাৎ ১৩ লাখ মেট্রিক টন মজুত রয়েছে। বিগত এক বছর আগে একই সময়ে মজুত ছিল প্রায় ১৭ লাখ মেট্রিক টন। প্রতি মাসে ওএমএস ও রেশনিংয়ে (বাহিনীগুলোর জন্য চাল ও আটা), খয়রাতি সাহায্য (জিআর), কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচি (কাবিখা), টিসিবির ট্রাক সেল ও ফেয়ার প্রাইস নিয়মিত সরবরাহে মাসে প্রায় ৩ লাখ মেট্রিক টন খাদ্যশস্য প্রয়োজন। সেই হিসাবে বিদ্যমান মজুত দিয়ে সরবরাহ বেশ কঠিন হবে।

আবার আমন চাল বাজারে আসতে আরও প্রায় দুই মাস অপক্ষো করতে হবে। সরকার পরিস্থিতি উপলব্ধি করতে পেরে ইতোমধ্যে চাল আমদানির ওপর থেকে সব ধরনের শুল্ক প্রত্যাহার করেছে। কিন্তু ব্যবসায়ীদের মধ্যে চাল আমদানির অনাগ্রহ লক্ষ্য করছেন খাদ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।

সেপ্টেম্বর মাসে আবার উত্তরাঞ্চলে বন্যায় ফসল উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে। ফলে আমনের উৎপাদন কম হবে প্রায় ১০ থেকে ১২ লাখ মেট্রিক টন। অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ধান-চাল সংগ্রহ করতে হলে সরকারকে ধান-চালের দাম বাড়াতে হবে। আমন ধান ও চালের মূল্য না বাড়ালে সরকারি অভ্যন্তরীণ উৎসে চাল পাবে না।

আরও পড়ুন: মেয়ের বাবা হলেন ছাত্র আন্দোলনে শহীদ রনি

বিবিএসের তথ্য অনুযায়ী, বছরে দেশে চার কোটি টনের মতো চাল উৎপাদিত হয়। এর মধ্যে দেড় কোটি টন আসে আমন মৌসুমে। দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম ফসলের ফলন কমে যাওয়ায় চালের দাম যেন আর বেড়ে না যায় তার জন্য অন্তর্বর্তী সরকার শুল্ক কমিয়ে আমদানিকে উৎসাহিত ও স্থানীয় মজুদ বাড়ানোর চেষ্টা করছে। গত ২০ অক্টোবর জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) চালের আমদানি শুল্ক ৬২ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২৫ শতাংশ নির্ধারণ করে।

তাতে অবশ্য খুব বেশি সাড়া দেননি ব্যবসায়ীরা। কারণ হিসেবে তারা বলছেন, বিশ্ববাজারেই চালের দাম বেশি। ফলে আমদানীকৃত চাল বর্তমানে দেশের বাজারে যে দাম, তার চেয়েও বেশি দিয়ে কিনতে হবে ক্রেতাদের। তাই লোকসান হওয়ার আশঙ্কা থেকেই সাড়া দিচ্ছেন না ব্যবসায়ীরা।


সর্বশেষ সংবাদ