সমাজসেবা কর্মকর্তার রোষানলে চাকুরিচ্যুত গার্ড, বিপাকে ফ্ল্যাট মালিকরা
- রাকিবুল হাসান তামিম
- প্রকাশ: ১৯ এপ্রিল ২০২৩, ০৪:১০ PM , আপডেট: ১৯ এপ্রিল ২০২৩, ০৬:০৪ PM
মৌখিক অভিযোগ ও তদন্ত ছাড়াই তড়িঘড়ি করে রাজধানীর সেন্ট্রাল রোডের ইস্টার্ন মফিজবাগের এক সিকিউরিটি ইনচার্জকে চাকুরিচ্যুত করার অভিযোগ ওঠেছে। এতে বিপাকে পড়েছেন ফ্ল্যাট মালিকরা। অভিযুক্ত সেই কর্মকর্তার নাম এস. এম. রফিকুল হায়দার। তিনি সমাজসেবা অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক এবং ইস্টার্ন মফিজবাগ ফ্ল্যাট কল্যাণ সমিতির নির্বাচনের জন্য সমাজসেবা অধিদপ্তর গঠিত তত্ত্বাবধায়ক বডির আহবায়ক।
শুধু তাই নয় বরং ৩ মাসের জন্য গঠিত আহবায়ক কমিটির সময় বৃদ্ধি করা, সাধারণ সভা না করা, নির্বাচনের আয়োজন না করা, নিজের পছন্দমত ম্যানেজার নিয়োগ দেওয়া এবং সিকিউরিট ইনচার্জকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়ে চাকরিচ্যুত করার মতো অভিযোগও রয়েছে এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে।
কর্মকর্তা রফিকুল হায়দারের রোষানলে পড়ে চাকরি হারানো ভুক্তভোগী সিকিউরিটি ইনচার্জের নাম সোহরাব হোসেন। ভবনের নিচ তলায় কর্মরত কর্মচারীদের জন্য নির্ধারিত ডাইনিং রুমে তালা দিয়ে রাখেন এমন মৌখিক অভিযোগে তদন্ত ছাড়াই কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়ে তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেন তিনি। এ সংক্রান্ত নথিপত্রের সকল কপি দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসের হাতে এসেছে।
ঘটনার শুরু যেভাবে: জানা গেছে, বিগত নির্বাহী কমিটির আবেদনের প্রেক্ষিতে গত বছরের ১৩ নভেম্বর ইস্টার্ন মফিজবাগ ফ্ল্যাট মালিক কল্যাণ সমিতির কার্য নির্বাহী পরিষদকে সাময়িক বরখাস্ত করে ৩ সদস্য বিশিষ্ট তত্ত্বাবধায়ক কমিটি গঠন করে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সমাজসেবা অধিদফতর। অধিদফতরের পরিচালক মোহাম্মদ সাব্বির ইমামের সই করা এক আদেশে সংস্থাটির সহকারী পরিচালক এস. এম. রফিকুল হায়দার কে আহবায়ক এবং গবেষণা, মূল্যায়ন, প্রকাশনা, জনসংযোগ শাখার এস এম কামরুল এহসান ও ভবঘুরে কার্যক্রম শাখার মোঃ আবু নাঈমকে সদস্য করা হয়। এই তত্ত্বাবধায়ক কমিটিকে অনুমোদিত গঠনতন্ত্র অনুসারে ৯০ দিনের (৩ মাস) মধ্যে ভোটার তালিকা হালনাগাদসহ নির্বাচন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে নির্বাচিত কমিটির কাছে দায়িত্ব হস্তান্তরে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়।
তবে ফ্ল্যাট মালিকরা বলছেন, এই আহবায়ক কমিটি নিয়মিত এখানে না এসেই আগারগাঁও থেকে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করেন। এতে করে বিভিন্ন সময় নানা বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়েছে। আবার নির্ধারিত ৯০ দিনের মধ্যে কোন নির্বাচনী শিডিউল বা সাধারণ সভা না করে আরও ৯০ দিন মেয়াদ বাড়িয়ে নিয়েছেন। অবশ্য এমন দাবির সত্যতাও মিলেছে।
গত ১১ ফেব্রুয়ারি এই আহবায়ক কমিটির ২ মাস ২৯ দিনের মাথায় ৩ মাসের জন্য সময় বৃদ্ধি করে আবারও নতুন নির্দেশনা প্রকাশ করা হয়। পরিচালক মোহাম্মদ সাব্বির ইমামের সই করা আদেশে বলা হয়, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নির্বাচন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা সম্ভব না হওয়ায় নির্বাচন কার্যাদি সম্পাদনের নিমিত্তে আরও ৯০ দিন (৩ তিন) মাস সময় বৃদ্ধি করা হলো।
মৌখিক অভিযোগে সিকিউরিটি ইনচার্জকে চাকুরিচ্যুত করলেন যেভাবে: ইস্টার্ন মফিজবাগ ফ্ল্যাট মালিক কল্যাণ সমিতির তত্ত্বাবধায়ক বডির আহবায়ক ও সমাজসেবা অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক এস. এম. রফিকুল হায়দার গত ১৪ মার্চ সিকিউরিটি ইনচার্জ সোহরাব হোসেনকে কারণ দর্শানোর নোটিশ পাঠান। যেখানে অভিযোগ করা হয়, আপনি দীর্ঘদিন ধরে সিকিউরিটি ইনচার্জ হিসেবে কর্মরত আছেন। সমিতির বর্তমান আহবায়ক কমিটির কাছে ফ্ল্যাট মালিক কল্যাণ সমিতির সদস্যদের ১১ (এগার) জন গাড়ি চালক (ড্রাইভার) আপনার ব্যাপারে মৌখিক অভিযোগ করেছেন। আপনি ইস্টার্ন মফিজবাগ বিল্ডিং এর নীচ তলার ডাইনিং রুম তালাবদ্ধ করে রাখেন ফলে তাদেরকে অনেক সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়।উল্লেখ্য, ইতোপূর্বে ডাইনিং রুম খোলা অবস্থায় থাকত।
আরও বলা হয়, বর্তমান আহবায়ক কমিটির উপস্থিতিতে গত ১১ মার্চ সন্ধ্যায় আপনাকে নির্দেশ প্রদান করা হয়। কিন্তু আপনি আহবায়ক কমিটির কথায় কর্ণপাত না করে পুনরায় ডাইনিং রুমে তালা দিয়ে রাখেন এবং দাম্ভিকতার পরিচয় দেন। এছাড়া বিশ্বস্ত সূত্রে জানতে পারি আপনি গেটে ঠিকমত দায়িত্ব পালন করেন না। তাই আপনার বিরুদ্ধে কেন প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে না সে বিষয়ে আগামী ৩ কর্মদিবসের মধ্যে সন্তোষজনক জবাব প্রদানের জন্য নির্দেশ প্রদান করা হলো।
নোটিশের জবাবে যা বলেন চাকরিচ্যুত সিকিউরিটি ইনচার্জ সোহরাব: সোহরাব হোসেন কারণ দর্শানোর জবাবে বলেন, বিগত ৪-৫ বছর ধরে বিশ্বস্ততার সাথে এ ভবনে আমি কর্তব্যরত। এ যাবত আমার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি। আমার বিরুদ্ধে ৩ টি অভিযোগের যথাযথ জবাব আমি দিয়েছি।
প্রথমত, ১১ জন গাড়ি চালকের (ড্রাইভার) মৌখিক অভিযোগের বিষয়টি আমার জানা নেই। তবে ২৮ জন গাড়ি চালকের স্বাক্ষরে ‘কর্মকর্তার কাছে কোনো অভিযোগ করেননি’ মর্মে প্রত্যয়ন পত্র জমা দিয়েছি।
দ্বিতীয়ত, খাবার ঘরে তালা দেওয়া প্রসঙ্গ এসেছে। ভবনে শুধুমাত্র সিকিউরিটি কর্মচারীদের জন্য রান্না ও খাওয়ার ঘর আলাদা ভাবে বরাদ্দ। বিপরীতে গাড়ি চালকদের বিশ্রাম ও খাবার জন্য আরও একটা ঘর বরাদ্দ। সম্প্রতি বিড়ালের উৎপাত ও সার্বিক নিরাপত্তার স্বার্থে সম্মানিত ফ্লাট মালিকদের পরামর্শে তালা-চাবি ব্যবহার করা হয়। এখানে ফ্লাট মালিকদের ব্যক্তিগত কর্মচারী ড্রাইভারদের বিশ্রাম ও খাবারের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই।
তৃতীয়ত, আমি সামান্য গরীব কর্মচারী। পেটের দায়ে চাকরি করি। আমার মতো কর্মচারীর দাম্ভিকতা দেখানোর সুযোগ নেই। আমাকে ২-১ জন ব্যতীত সবাই পছন্দ ও বিশ্বাস করে এবং ভালো জানে। কারণ কখনো কর্তব্যের অবহেলা করিনি। দৈনিক(সকাল ৭ টা থেকে ১১টা পর্যন্ত এবং দুপর ১টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত মোট ১৪ ঘন্টা) নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করি।
পরের নোটিশেই চাকুরিচ্যুত হন সোহরাব: কারণ দর্শানোর নোটিশের জবাব দেওয়ার পরে ২০ মার্চ পুনরায় অব্যাহতি প্রদান করে নোটিশ পাঠান এস. এম. রফিকুল হায়দার। নোটিশে তিনি বলেন, সমিতির বর্তমান আহবায়ক কমিটির নির্দেশনা সত্ত্বেও আপনার উপর অর্পিত দায়িত্ব সঠিক ভাবে পালন করেননি। এছাড়া আপনার নিয়োগ সংক্রান্ত কোন তথ্যাদি পাওয়া যায়নি। আপনার কারণ দর্শানোর জবাব সন্তোষজনক নয় বলে আহবায়ক কমিটি মনে করে।
এ অবস্থায়, আগামী ২২ মার্চ থেকে আপনাকে সিকিউরিটি ইনচার্জ এর দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি প্রদান করা হলো। এতে আরও বলা হয়, সকল দায়িত্ব ‘ইস্টার্ণ মফিজবাগ ফ্ল্যাট মালিক কল্যাণ সমিতি'র ম্যানেজার আব্দুল্লাহ আল এলাহীর কাছে আগামী ২১ মার্চের মধ্যে হস্তান্তর করার জন্য নির্দেশ প্রদান করা হলো।
ম্যানেজারকেই দেওয়া হয় নতুন দায়িত্ব: ২২ মার্চ ইস্টার্ণ মফিজবাগ ফ্ল্যাট মালিক কল্যাণ সমিতির ম্যানেজারকে সিকিউরিটি ইনচার্জ হিসাবে অতিরিক্ত দায়িত্ব প্রদান করা হয়। এস এম রফিকুল হায়দার স্বাক্ষরিত ওই আদেশে বলা হয়, আপনি জনাব আব্দুল্লাহ আল এলাহী মিনা, ‘ইস্টার্ণ মফিজবাগ ফ্ল্যাট মালিক কল্যাণ সমিতিতে ম্যানেজার হিসাবে কর্মরত আছেন। সমিতির বর্তমান আহবায়ক কমিটির নির্দেশনা মোতাবেক আপনাকে ম্যানেজার এর দায়িত্বের পাশাপাশি সিকিউরিটি ইনচার্জ হিসাবে অতিরিক্ত দায়িত্ব প্রদান করা হয়েছে।
এ অবস্থায়, আগামী ২৩-০৩-২০২৩ তারিখ হতে আপনাকে ম্যানেজার এর দায়িত্বের পাশাপাশি সিকিউরিটি ইনচার্জ হিসাবে অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করার জন্য নির্দেশ প্রদান করা হলো।
যা বলছেন তত্ত্বাবধায়ক বডির আহবায়ক এস. এম. রফিকুল হায়দার: সিকিউরিটি ইনচার্জ সোহরাব হোসেনের কোন নিয়োগপত্রই নেই বলে দাবি করেন ইষ্টার্ণ মফিজবাগ ফ্ল্যাট মালিক কল্যাণ সমিতির বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক বডির আহবায়কও সমাজসেবা অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক এস. এম. রফিকুল হায়দার।
মৌখিক অভিযোগের উপর ভিত্তি করে তদন্ত ছাড়াই চাকরিচ্যুত করার বিষয়ে তিনি বলেন, আমরা তার নিয়োগপত্রের কোন কপি খুঁজে পাইনি।
তাহলে কি তিনি দীর্ঘদিন ধরেই নিয়োগপত্র ছাড়াই এখানে কাজ করছিলেন এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন ,আমারও তাই মনে হচ্ছে। আমরা কাগজপত্র ছাড়া কথা বলতে পারিনা। তার কাছে যদি কোন কাগজ থেকে থাকে সেই সেগুলো সাবমিট করুক।
মালিক সমিতির নির্বাচন তিনমাসের মধ্যে কেন হলো না জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা নির্বাচন কমিশনের ব্যাপার। আমরা ভোটার তালিকা দিয়ে দিয়েছি।
মৌখিক অভিযোগের ভিত্তিতে কিভাবে চাকুরিচ্যুত করলেন এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা তদন্ত করেই কাজ করেছি। সে তো আমার কথাই শুনেনা। বাকি কিছু জানতে হলে আপনি অফিসে আসেন ।
অন্যায়ভাবে চাকরিচ্যুত করার অভিযোগ সোহরাবের: সব কাগজপত্র থাকার পরও সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে বলে মন্তব্য করেন সোহরাব হোসেন। তিনি বলেন, চাকরি হারিয়ে মানবতার জীবনযাপন করছি। আমার সব কাগজপত্র বৈধ ভাবে থাকার পরও অন্যায় ভাবে আমাকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। ডাইনিং রুমে খাবারে নিরাপত্তার জন্যই মালিকদের সাথে কথা বলে তালা লাগিয়ে ছিলাম।
তিনি বলেন, আমার ব্যাপারে অভিযোগের বিপরীতে সকল স্পষ্ট প্রমাণ সহ আবেদন জমা দিয়েছি। কিন্তু এর পরও আমাকে চাকরীচ্যুত করা হয়েছে। আমি চাই যেন সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে পুনরায় আমাকে স্বপদে বহাল করা হয়।