কর্পোরেটের পকেটে ব্রয়লার মুরগির বাজার, সিন্ডিকেটে নাকাল ভোক্তা

প্রথমবারের মতো মাস ও সপ্তাহের ব্যবধানে দফায় দফায় দাম বেড়ে এর কেজি দাঁড়িয়েছে ২৮০-২৯০ টাকায়।
প্রথমবারের মতো মাস ও সপ্তাহের ব্যবধানে দফায় দফায় দাম বেড়ে এর কেজি দাঁড়িয়েছে ২৮০-২৯০ টাকায়।  © © টিডিসি ফটো

দেশের বিপুল পরিমাণ মানুষের প্রাণীজ আমিষের সহজ যোগান হিসেবে ধরা হয়ে থাকে ব্রয়লার মুরগিকে। মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্তের হাতের নাগালে দাম থাকায় অনেক সময় ‘গরীবের গরুর মাংস’ হিসেবেও আখ্যা পায় ব্রয়লার মুরগি। তবে সম্প্রতি দেশের বাজারে মুরগির দামে তৈরি হয়েছে নতুন ইতিহাস। প্রথমবারের মতো মাস ও সপ্তাহের ব্যবধানে দফায় দফায় দাম বেড়ে এর কেজি দাঁড়িয়েছে ২৮০-২৯০ টাকায়। উৎপাদন খরচ ১৪৫-১৬৫ টাকা হলেও খুচরা বাজারে ভোক্তা পর্যায়ে দ্বিগুণেরও বেশি দামে কেন ব্রয়লার মুরগী বিক্রি হচ্ছে সেটি নিয়ে ওঠেছে নানা প্রশ্ন। 

অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, ব্যবসায়ীদের সাথে বৈঠক করে এবং আগেই বাজার মূল্য নির্ধারণ করেও দর নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেছেননা জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। গতকাল বৃহস্পতিবার (২৩ মার্চ) বিকেলে কারওয়ান বাজারে জাতীয় ভোক্তা-অধিকারের দপ্তরে মহাপরিচালক এবং ব্রয়লার মুরগীর ফার্মের মালিকদের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। এই বৈঠকে কাজী ফার্মস, প্যারাগন পোল্ট্রি এন্ড হ্যাচারী, আফতাব বহুমুখী ফার্মস এবং সিপি বাংলাদেশ এর মালিকরা উপস্থিত ছিলেন।

হঠাৎ কেন টালমাটাল ব্রয়লার মুরগির বাজার ?

হঠাৎ রমজানের আগে থেকেই কেন দফায় দফায় দাম বেড়ে অস্থির হয়ে ওঠলো ব্রয়লার মুরগির বাজার এমন প্রশ্নের সদুত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছে দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস। অনুসন্ধান বলছে, যথাযথ তদারকি না থাকায় পোল্ট্রি সেক্টর স্পষ্ট দুটি ভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে। যার একদিকে রয়েছে কর্পোরেট কোম্পানি এবং অপরদিকে রয়েছে প্রান্তিক পর্যায়ের খামারিরা। সাধারণ খামারিরা বলছেন, অনেক সময়ই কর্পোরেট কোম্পানির উচ্চ লগ্নি আর একচেটিয়া বাজার নিয়ন্ত্রণের পলিসির কাছে হার মানতে হচ্ছে তাদের।

বাংলাদেশ পোল্ট্রি এসোসিয়েশন (বিপিএ)-এর পরিসংখ্যান বলছে, এখন প্রতিদিন দেশের বাজারে ব্রয়লার মুরগির চাহিদা ৩ হাজার ৫শ টন। তাঁরা বলছেন, ব্রয়লার মুরগির উৎপাদনে প্রান্তিক পর্যায়ে খরচ হচ্ছে  প্রতি কেজিতে ১৬০-১৬৫ টাকা এবং কর্পোরেট কোম্পানীদের উৎপাদন খরচ হচ্ছে ১৩০-১৪০ টাকা। গত দুই মাসে সেসব ব্রয়লার মুরগি পাইকারী পর্যায়ে বিক্রি হয়েছে সর্বোচ্চ ২৩০ টাকা দামে। অর্থাৎ ২ হাজার টনে প্রতি কেজিতে যদি অতিরিক্ত ৬০ টাকা মুনাফা ধরা হয় তবে একদিনেই অতিরিক্ত মুন্ফা হয়েছে প্রায় ৬ কোটি  টাকা। সে হিসেবে চলতি বছরের ৩১ জানুয়ারি থেকে ২৩ মার্চ পর্যন্ত মোট ৫২ দিনে মুনাফা হয়েছে ৬২৪ কোটি টাকা। যা পুরোদমে প্রভাব ফেলেছে সাধারণ ভোক্তাদের ওপর।

নিউমার্কেটে মুরগির বাজার তদারকি করছেন জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা। 

অপরদিকে, একটি মুরগির বাচ্চা উৎপাদন খরচ বলা হচ্ছে ২৮-৩০ টাকা। যা জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে ছিলো ১০-১৫ টাকা। আর ৩১ জানুয়ারির থেকে ২৩ মার্চ পর্যন্ত সেসব ব্রয়লার মুরগির বাচ্চা বিক্রি করা হয়েছে ৮০-৮৫ টাকা। এর মানে হলো প্রতিটি মুরগির বাচ্চায়ও ৩০ টাকা অতিরিক্ত মুনাফা ধরা হয়েছে। কর্পোরেট কোম্পানি ব্রয়লার মুরগির বাচ্চার সিন্ডিকেটেও নিয়েছে  ৩শ ১২ কোটি টাকা। অর্থাৎ মুরগির বাচ্চা এবং মুরগির সিন্ডিকেটে এই ৫২ দিনে কর্পোরেট কোম্পানিগুলো হাতিয়ে নিয়েছে ৯৩৬ কোটি টাকা।  (পোল্ট্রি এসোসিয়েশনের তথ্য অনুযায়ী)

আরও পড়ুন : রাবির হলে ‘খরচ কমাতে’ মুরগির পরিবর্তে গরুর মাংস

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক প্রান্তিক খামারি বলেন, ব্রয়লার মুরগির অস্বাভাবিক দামের কারণ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি আমাদের মতো ছোট খামারিরা। লস করতে করতে খামার বন্ধ করে উৎপাদন থেকে ছিটকে পড়েছি। দেশের পোল্ট্রি শিল্পের নিয়ন্ত্রণ একচেটিয়াভাবে কর্পোরেট গ্রুপগুলোর হাতে ইতোমধ্যেই চলে গিয়েছে। তাদের স্বেচ্ছাচারিতায় সে বিষয়টি স্পষ্ট। তারা চাইলেই পোল্ট্রিফিড ও মুরগির বাচ্চার দাম বাড়িয়ে দেয়। প্রান্তিক খামারিরা বাচ্চা উৎপাদন করলে বাজারে দাম কমিয়ে দিয়ে লসে ফেলে দেয়। আবার উৎপাদনে না থাকলে ভোক্তাদের পকেট ফাঁকা করে দেয়।

এই খামারি আরও বলেন, পোল্ট্রি ফিড ও মুরগির বাচ্চা শতভাগ উৎপাদন করে কর্পোরেট গ্রুপ। তারাই আবার আংশিক ডিম ও মুরগি উৎপাদন করে এবং চুক্তি ভিক্তিক খামার করেন, এতে করে বাজার তার দখলে চলে যাচ্ছে। পোল্ট্রি ফিড ও মুরগির বাচ্চার দাম নিয়ন্ত্রণ এবং কর্পোরেট গ্রুপের মুরগি ডিম উৎপাদন বন্ধ করতে না পারলে কোনদিন বাজার সিন্ডিকেট বন্ধ হবে না।

এসব বিষয়ে বাংলাদেশ পোল্ট্রি এসোসিয়েশনের সভাপতি সুমন হাওলাদার দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, কর্পোরেট কোম্পানিগুলো চুক্তিভিত্তিক মুরগি পালনের খামার গড়ে তোলার নামে প্রান্তিক খামারিদের ওপর নিয়ন্ত্রণ নিচ্ছে। এই মুহূর্তে খামারের সংখ্যা প্রায় এক লাখ ৬০ হাজার। এরমধ্যে কোম্পানির সাথে  চুক্তিভিত্তিক খামার রয়েছে ১৯ হাজার ২০০টি।

তিনি অভিযোগ করেন, প্রান্তিক খামার বন্ধ থাকলেও কোম্পানির সাথে চুক্তিভিত্তক খামার কখনো বন্ধ থাকেনা। অনেকসময় চুক্তিভিত্তিক খামারে বাচ্চা দিলেও প্রান্তিক খামারে কোম্পানিগুলো বাচ্চা দিচ্ছে না। এমন অবস্থা থেকে উত্তোলনের পথ বের করতে হবে। সেজন্য প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, কৃষি মন্ত্রণালয় বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের পোল্ট্রি সাইন্স বিভাগের প্রফেসরগণ এবং পোল্ট্রি স্টোক হোল্ডারদের সমন্বয়ে পোল্ট্রি উন্নয়ন ডেভলপমেন্ট বোর্ড গঠন করে পোল্ট্রি সকল পণ্যের উৎপাদন খরচ সমন্বয় করে ন্যায্য মূল্য নির্ধারণ করতে হবে। একইসাথে  কর্পোরেট গ্রুপের উপর নির্ভর না করে সরকারি হ্যাচারি ও ফিড মিল চালু করে মুরগির বাচ্চা ও পোল্ট্রি ফিড খামারিদের কাছে ন্যায্য মূল্য সরবরাহ করার নেয়া প্রয়োজন বলেও উল্লেখ করেন তিনি।

সিন্ডিকেট ঠেকাতে ডিম-মুরগি আমদানির পরামর্শ

অপরদিকে ভোক্তা পর্যায়ে মুরগির এমন দামে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন ব্যবসায়ী নেতারাও। বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন বলেন, ব্রয়লার মুরগির দাম এমন বাড়ার কোনো যৌক্তিকতা নেই। আমরা সর্বাত্মক চেষ্টা করি যেন রমজানে সকল পণ্যের দাম সহনীয় পর্যায়ে থাকে।  আমরা দেশীয় শিল্প উদ্যোক্তাদের সুযোগ করে দিয়েছি তার মানে এই নয় যে তারা যা ইচ্ছা তা করবে। যদি এ ধরনের সিন্ডিকেট অব্যাহত থাকে তাহলে আমি সরকার কাছে অনুরোধ করব যেন বিদেশ থেকে ব্রয়লার মুরগি ও ডিম আমদানি করা হয়। এর মাধ্যমে তাদের সিন্ডিকেট ভেঙে যাবে।

যা বলছে ভোক্তা অধিদপ্তর

ব্রয়লারের দামের বর্তমান অবস্খা সম্পর্কে জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ. এইচ. এম.  সফিকুজ্জামান বলেন, ভোক্তা পর্যায়ে ব্রয়লার মুরগির দাম ২০০ টাকার ওপরে হওয়ার কোনো যৌক্তিকতা নেই। এ বিষয়টি নিয়ে আমরা বৈঠক করেছি এবং সরকারের কাছে আটটি সুপারিশ জমা দিয়েছি। আশা করব সংশ্লিষ্ট যারা রয়েছেন তারা অবশ্যই ভোক্তাদের কষ্ট লাঘবের জন্য ব্রয়লার মুরগির বাজার নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসার চেষ্টা করবেন।

আরও পড়ুন : রোজায় ভোগ্যপণ্যের সংকট কি এড়ানো যাবে?

একইসঙ্গে যে সব কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের বাজার অস্থির করার প্রবণতা রয়েছে তাদের বিষয়টি আমলে নিয়ে কাজ করা হচ্ছে বলে জানান জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের প্রশাসন ও অর্থ বিভাগের পরিচালক মনজুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার। তিনি দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ব্রয়লার মুরগি উৎপাদনে খরচ পড়ে ১৪০-১৬৫ টাকা। অপরদিকে ১৬০ টাকায় উৎপাদিত পণ্য ভোক্তা কেন ২৮০ টাকায় কিনবে সেটি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। আমরা সরকারের কাছে ইতোমধ্যেই একটি রিপোর্ট দিয়েছি। ভোক্তা অধিদপ্তরের পক্ষ থেকেও বিষয়টি ভালোভাবে দেখা হচ্ছে। আমাদের আইন রয়েছে, মামলা করার বিধান রয়েছে। আশা করছি দ্রুতই ব্রয়লার মুরগির বাজার ক্রেতাদের হাতের নাগালে চলে আসবে।


সর্বশেষ সংবাদ