দেশের ১০০ হোটেলের মধ্যে মানসম্পন্ন মাত্র চারটি

দেশের ১০০ হোটেলের মধ্যে মানসম্পন্ন মাত্র চারটি
দেশের ১০০ হোটেলের মধ্যে মানসম্পন্ন মাত্র চারটি  © সংগৃহীত

বাংলাদেশের হোটেল-রেস্তোরাঁর খাবারের মানসহ নানা দিক দেখার জন্য ১১টি প্রতিষ্ঠান থাকলেও বাস্তবে তেমন কেউ দেখছে বলে মনে হয় না। তাই খাবারের মান নিয়ে প্রায়ই অভিযোগ ওঠে, অভিযোগ ওঠে পঁচা-বাসি খাবারের। মাঝে মাঝে অভিযান হয়, কিন্তু পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয় না।

২০১৮ সালে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ একটি উদ্যোগ নেয়। তারা হোটেলের মান অনুয়ায়ী হোটেলগুলোতে ফুড স্টিকার লাগানোর প্রক্রিয়া চালু করে। ভালো মানের হোটেলের জন্য সবুজ, যেগুলোতে সমস্যা আছে, কিন্তু একটু চেষ্টা করলে উন্নয়ন সম্ভব সেগুলোতে হলুদ এবং যেগুলো নিম্ন মানের সেগুলোতে লাল স্টিকার লাগানোর উদ্যোগ নেয়।

ওই বছর প্রাথমিকভাবে ১০০টি হোটেল নিয়ে জরিপ করা হয়। সেখানে মাত্র চারটি হোটেল-রেস্তোরাঁ সবুজ স্টিকার পায়। ৪৫টি হলুদ এবং ৫১টিতে লাল স্টিকার লাগিয়ে দেয়া হয়। ছোট আকারে হলেও ঢাকার হোটেল-রেস্তোরাঁ নিয়ে এটাই ছিল প্রথম জরিপ। আর তাতে দেখা যায় শতকরা ৫১ ভাগ একদম হোটেলই নিম্নমানের। কিন্তু উদ্যোগ তেমন এগোয়নি।

তারপরের চার বছরে সারা দেশে আর মাত্র ১৫০টি হোটেল রোস্তোরাঁয় তারা স্টিকার লাগাতে পেরেছেন তারা। তাতেও তাদের অভিজ্ঞতা খারাপ। ১০ ভাগও মানসম্পন্ন হোটেল পাওয়া যাচ্ছে না। বাংলাদেশে সরকারি হিসাবে বাংলাদেশে হোটেল-রেস্তোরাঁ মোট চার লাখ ৮১ হাজার। এটা ট্রেড লাইসেন্সের হিসাব ধরে। কিন্তু বাস্তবে এই সংখ্যা আরো অনেক বেশি। কারণ, দেশে প্রচুর অনুমোদনহীন ছোট ছোট হোটেল-রেস্তোরাঁ আছে।

নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের পরিচালক ড. সহদেব চন্দ্র সাহা বলেন, ‘‘আমরা হোটেলের খাবার মান দেখি খাদ্য উপাদান, রান্নার পরিবেশ ও মাছ মাংসসহ কাঁচা খাবার সংরক্ষণ পদ্ধতি এবং পরিবেশ, পরিবেশন ও কর্মচারীদের পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা দিয়ে। সেই বিবেচনায় শতকরা ১০ ভাগ হোটেলও মানসম্পন্ন নয়।’’

তার কথা, ‘‘আমরা অভিযানও পরিচালনা করি, অর্থদণ্ড দেয়ার ক্ষমতা আছে। কিন্তু আমরা হোটেল মালিকদের সচেতন করার ওপরেই জোর দিচ্ছি বেশি। প্রশিক্ষণ দিচ্ছি। তিন মাস থেকে ছয় মাস সময় বেধে দেই, তারপরও উন্নতি না হলে ব্যবস্থা নিই।’’

নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের এখন সব মিলিয়ে জনবল আছে ১৫০ জনের মতো। উপজেলা তো দূরের কথা, সব জেলায়ও তাদের অফিস নেই।

নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের সচিব আব্দুন নাসের খান বলেন, ‘‘শুধু হোটেল নয়, সব ধরনের খাদ্যই আমরা দেখি। তবে জেলা পর্যায় পর্যন্ত আমরা যেতে পেরেছি। তা-ও জেলায় একজন কর্মকর্তা ও একজন অফিস সহায়ক নিয়ে কাজ করতে হয়। আমরা অন্যান্য দপ্তরের সহায়তা নিই। সেটাও সব সময় পাওয়া যায় না।’’

আরও পড়ুন: আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে দেশের জনপ্রিয় ১০ খাবার-রেস্টুরেন্ট

বাংলাদেশে সব ধরনের হোটেল-রেস্তোরাঁর খাবারের মান নিয়ে কোনো গবেষণা নেই। তবে ২০১৯ সালে আইসিডিডিআরবির গবেষণায় দেখা যায়, পথের পাশের সাধারণ হোটেল ও খাবার দোকানের শতকরা ৭১.৫ ভাগের খাবারই মানহীন এবং অস্বাস্থ্যকর। পথখাবারের ৫৫ ভাগেই পাওয়া গেছে জীবাণু। আর খাবার বিক্রেতা ৮৮ ভাগের হাতে থাকে জীবাণু। এসব খাবার দোকানে সাধারণত নিম্নবিত্ত লোকজন খেয়ে থাকেন।

এই সময়ে ঢাকায় আলোচিত ঘটনা ছিল একটি বিরিয়ানির দোকানের খাশির মাংস নিয়ে বিতর্ক। একজন গ্রাহকের অভিযোগের ভিত্তিতে ভোক্তা অধিদপ্তর অভিযানও চালায়। পরে তারা শুনানি করে সিদ্ধান্ত দেয় যে খাশি ছাড়া অন্য কোনো প্রাণীর মাংসের প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

তবে ঢাকার বিভিন্ন হোটেলে প্রায়ই অভিযানের খবর এবং মানহীন খাবারের জন্য জরিমানার খবর পাওয়া যায়। হোটেলে তালা লাগিয়ে দেয়ার খবরও পাওয়া যায়। কিন্তু এসব অভিযান এবং ‘শাস্তিমূলক’ ব্যবস্থার কয়েকদিন পর আবার একই অবস্থায় ফিরে যায় সব কিছু। 

ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তরের পরিচালক মনজুর মোরশেদ শাহরিয়ার বলেন, ‘‘আমরা প্রায়ই অভিযোগ পাই। কেউ কেউ সরাসরি খাবার নিয়েও আমাদের কাছে হাজির হন। অভিযোগ নিয়ে পরীক্ষা ও শুনানি করে আমরা সিদ্ধান্ত দিই। কয়েকদিন আগেই একজন হোটেলের রান্না করা গরুর মাংস নিয়ে হাজির হন। তার ওই মাংস নিয়ে সন্দেহ ছিল। পরে আমরা পরীক্ষা করে দেখি আসলে ওটা গরুর মাংসই। তবে হোটেলগুলো যে জর্দা বিক্রি করে, সেখানে ফুড গ্রেড না দিয়ে কাপড়ের রঙ ব্যবহার করা হয়, যা ভয়াবহ।’’

তার কথা, ‘‘আমরা অভিযোগের ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেয়ার পাশাপাশি নিজ উদ্যোগেও অভিযান পরিচালনা করি। হোটেলের পরিবেশ, কর্মচারীদের পরিষ্কার-পরিচ্ছনতা, খাদ্য সংরক্ষণ পরিবেশ সবই দেখি। তবে আমরা প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো ল্যাবরেটরিতে টেস্ট করে সিদ্ধান্ত দিই।’’

তার মতে, ‘‘আগের চেয়ে হোটেলগুলোতে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বেড়েছে। কিন্তু অন্যদিকে অগ্রগতি নেই। আর এর জন্য আসলে মূল কাজ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের। আমরা ভোক্তার দিকটা দেখি। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়েরও দায়িত্ব আছে। তারা চাইলে মামলা করতে পারে।’’

তবে হোটেল মালিকদের অভিযোগ, সরকারের নানা দপ্তর ছাড়াও সিটি কর্পোরেশন ও পৌরসভার এগুলো দেখার কথা থাকলেও তারা দেখার নামে হয়রানি করে। বাংলাদেশ রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির সভাপতি ইমরান হাসান বলেন, ‘‘আমরা চেয়েছিলাম বিজিএমইএর মতো আমাদের কাজ করতে দেয়া হোক। তাহলে আমরাই হোটেল-রোস্তারাঁগুলো মনিটরিং করতে পারতাম। আমাদের সরকারের প্রকিষ্ঠানগুলো সহায়তা করতো, তাহলে মান ভালো হতো, অভিযোগ কম থাকতো।’’

তিনি অভিযোগ করেন, ‘‘বিরিয়ানির ব্যবসায় এখন বড় দুইটি কর্পোরেট গ্রুপ ঢুকতে চাইছে। তাই বিরিয়ানি নিয়ে এখন নানা গুজব ছাড়ানো হচ্ছে। আমাদের ব্যবসা হলো, ওয়ান ম্যান শো। কিন্তু কর্পোরেট গ্রুপ তা দখল করতে চাইছে। হোটেল ব্যবসা বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় মার্কেট, ১৮ কোটি মানুষের মার্কেট। এখানে অবশ্যই শৃঙ্খলা থাকা দরকার। আমাদের সংগঠনের সদস্য ৬০ হাজার। এর বাইরে কে কেথায় কী করছেন আমরা কীভাবে বলবো?’’

বাংলাদেশের পাঁচতারা বা যারা আন্তর্জাতিক মান দাবি করেন, তাদের ওপর নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণ নেই বললেই চলে। তারা দাবি করেন, তারা আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখেন। সেখানে কোনো অভিযান পরিচালনা করতেও দেখা যায় না। খাদ্য কর্তৃপক্ষ প্রথমে হোটেলের গ্রেডিং বাধ্যতামূলক করার কথা চিন্তা করলেও এখন সেখান থেকে সরে এসেছে।

নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের মনিটরিং অফিসার ইমরান হোসেন মোল্লা বলেন, ‘‘এখন আমরা গ্রেডিং করার জন্য আহ্বান জানাই। তবে তাতে তেমন সাড়া মেলে না। যখন অভিযানে যাই, তখন আমরা গ্রেডিং করে দিই। অভিযানের জন্য আমাদের চারজন ম্যাজিষ্ট্রেট আছেন।’’

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)-এর সহ-সভাপতি এস এম নাজের হোসেন মনে করেন, ‘‘হোটেল রেস্তোরাঁর গ্রেডিং করার উদ্যোগটি ছিল আশাব্যঞ্জক। কিন্তু সেটা অজ্ঞাত কারণে থেমে গেছে। এটা চালু রেখে আরো জোরদার করা উচিত। তাহলে ভালো ফল পাওয়া যাবে।’’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্য বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. শেখ নজরুল ইসলাম বলেন, ‘‘এমনিতেই হোমমেইড খাবারের চেয়ে হোটেলের খাবারের মান খারাপ হয়। তারপর বাংলাদেশের হোটেল-রোস্তারাঁর খাবারের যে মান, তা নিয়মিত খেলে অবশ্যই শরীরের ক্ষতি হয়।’’

আর মেডিসিনের অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ বলেন, ‘‘হোটেলের নিম্নমানের খাবার খেয়ে অনেকেই পেটের পীড়া, ডায়রিয়া, আমাশয়, জন্ডিসে আক্রান্ত হচ্ছেন। কাপড়ের রঙ ব্যবহার করা হয় যেসব খাবারে, সেসব খেয়ে ক্যান্সারও হতে পারে।’’

তিনি বলেন, ‘‘হোটেলের খাবারের মান কী তা চোখে দেখে তো সব সময় বোঝা যায় না। পরিবেশ দেখে কিছুটা বোঝা যায়। তাই নিয়মিত হোটেলের খাবার খাওয়া উচিত নয়। তবে অনেকে নিয়মিত খেতে বাধ্য হন। বিশেষ করে শহরের নিম্নবিত্ত মানুষ।’’ [সূত্র: ডয়চে ভেলে বাংলা]


সর্বশেষ সংবাদ