অনন্ত জলিলের পরিবেশিত খাবার এট লিস্ট অখাদ্য নয়!

ইফতেখায়রুল ইসলাম
ইফতেখায়রুল ইসলাম  © সংগৃহীত

কারো কারো অতি সমালোচনার কারণেই কি না জানি না,  দিন- The Day  চলচ্চিত্র দেখতে যেয়ে আমি কোনো প্রত্যাশা রাখি নাই।

৭ টায় শো শুরু হয়েছে, হলে ঢুকলাম ৭:০৫ এ! শুরুতেই দেখি মিস্টার জলিল মারামারি শুরু করে দিয়েছেন ইস্তাম্বুলে! এর আগে কিছু ছিল কি না জানি না! প্রথমেই চোখ গেলো নায়কের আলগা চুলের দিকে। বরাবরের মতই বাংলা সিনেমায় যেভাবে উইগ ফিট হয় না, এখানেও তাই হয়েছে। হতে পারে ফিট হওয়ার চেয়ে তার Covert Operation -ই মুখ্য ছিল তাই তার এরূপ ছদ্মবেশ!

পুলিশ বলেই কি না জানি না, পুলিশ সম্পর্কিত ছোটখাটো ভুল খুব চোখে লাগে। এই চলচ্চিত্রে অনন্ত জলিল ‘দ্য এজে’ কে ওয়্যারলেসে বারবার এজে বলে কল করা হচ্ছিল। নাম ধরে কাউকে সেটে ডাকা হয় না, অফিসারের একটা কল সাইন থাকে। আর সাধারণ ছিনতাইকারী ধরতে সোয়াট টিম ও তার লিডারকে যেতে হয় না, স্থানীয় পুলিশরাই এই কাজ সারে। বাংলাদেশ পুলিশকে দেখিয়ে সোয়াটের অফিসারকে ছিনতাইকারী ধরার কাজে নামিয়ে দেওয়া কাজের কথা নয়, তবে ভারী অস্ত্রে সজ্জিত থাকায় এরূপ দৃশ্যায়নে একটা যৌক্তিকতা চাইলেই আনা যায়! 
সাধারণ দর্শক এটা বুঝবে না তাই ধরে নিলাম এই অসামঞ্জস্যতা বড় কিছু নয় আম দর্শকের কাছে। কমিশনার চরিত্রে মিশা সওদাগরকে দেখিয়ে তার বাম পাশের চেয়ারে এসপি পদমর্যাদার একজনকে প্রথমে বসিয়ে পরে ডিআইজি পদমর্যাদার একজন অফিসারকে বসানো হয়েছে, যেটি ভুল। সাধারণ দর্শক এটিও বুঝবেন না তবে রিসার্চ এখানেও হয়নি বরাবরের মত! দেশের বাইরের অপারেশন বুঝাতে ইন্টারপোলকে রিলেট করা হয়েছে যেটি ভাল লাগার বিষয়।

নায়কের উচ্চারণ বিষয়ে আসা যাক, মৃত্যু উচ্চারণ নায়ক যদি না-ই করতে পারে সেক্ষেত্রে তাকে সুবিধা দিতে ‘মৃত্যুর’ পরিবর্তে ‘মরণ’ তো বলানো যায়। মৃত্যু না বললে কি এমন মহাভারত অশুদ্ধ হয়? নায়কের চ, ছ উচ্চারণে জটিলতা রয়েছে। Stop (স্টপকে নায়ক বারবার ইস্টপ বলেন)! গাড়ি থামানোর ক্ষেত্রে তাকে দিয়ে হল্টও বলানো যেতো! নায়কের প্রচুর টেল ড্রপ হয়! শব্দের শেষ অক্ষর উচ্চারণের আগেই নাই হয়ে যাওয়া সমস্যাকে টেল ড্রপ বলা হয়। যাই হোক এসব বাদ দিয়ে চলচ্চিত্রের একজন সাধারণ দর্শক হিসেবে কথা বলি!

আমি অনন্ত জলিলের আগের কোনো মুভি দেখিনি। বিভিন্ন চলচ্চিত্রের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ক্লিপ দেখেছি, দেখে হেসেছি কারণ ফানি পার্টের ক্লিপগুলোই কেটে কেটে সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়ানো হয়েছে। এই চলচ্চিত্র মূলত অনন্ত জলিল ওরফে এজে’র চলচ্চিত্র। বর্ষাকে রাখা হয়েছে নিয়ম রক্ষার্থে। বিরতির পর একটা কঠিন মুহূর্তে তাকে হাজির করে তার চরিত্রের যথার্থতা দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে এবং শেষ মুহূর্তে আরও একবার তার যথার্থতা আনার চেষ্টা করা হয়েছে।

অনন্ত জলিলের কিছু জায়গায় উচ্চারণের ঘাটতি, দুই তিনটি ইংরেজিতে ভুল বাক্যের সংলাপ বাদ দিলে এবং কিছু জায়গায় মুখভঙ্গি মাফ করে দিলে অনন্ত অনেক পরিণত হওয়ার চেষ্টা করেছেন এই চলচ্চিত্রে। এ্যাকশান ঘরানার এই চলচ্চিত্রে তার মারপিট বেশ ভালই ছিল। চলচ্চিত্রের দ্বিতীয়ার্ধে কিছু জায়গায় নায়কের ডায়ালগ থ্রোয়িং এবং রাগান্বিত মুখভঙ্গি মুগ্ধ করেছে আমাকে। প্রত্যাশা ছাড়া যাওয়ার কারণে এই মুগ্ধতা কি না আমি জানি না। তবে বলতেই হবে তার প্রচেষ্টা ছিল অনেক স্বাভাবিক অভিনয় করার।

নায়িকা বর্ষা চলচ্চিত্রে তার এন্ট্রি শটে শ্যানেলের টপস পরে স্কুলে মারামারি করে একটি বাচ্চাকে রক্ষা করে, বাচ্চার মাকে হঠাৎ করেই পরকীয়া থেকে বিরত থাকার লেসন দিয়ে আচমকাই চমকে দিয়েছেন। পরিচালক কি বুঝাতে চেয়েছেন, আমি আসলে বুঝে উঠিনি! বর্ষা একজন পুলিশই নন, আদর্শ স্ত্রীও বটে, এটিই কি বুঝাতে চেয়েছেন?  তিনি নিজে একজন পুলিশ কর্মকর্তা হওয়া সত্ত্বেও এই পুরো চলচ্চিত্রে তার বিশ্বাসযোগ্যতা তিনি ফুটিয়ে তুলতে পারেননি! দুটি গানে তার হাসি মাখা মুখ ও পোশাক প্রদর্শনই তার জন্য প্রাপ্তি ছিল বোধ করি! একজন পুলিশ হয়ে অপারেশনে যেয়ে অন্য নারীদের ন্যায় যদি বলে উঠেন এসব কি হচ্ছে আমি বুঝতে পারছি না, তবে পুলিশ চরিত্র বিশ্বাসযোগ্যতা হারাবেই! তবে শেষ দিকে ভিলেনের সাথে নায়িকার কথোপকথনে বর্ষা বেশ ভাল উৎরে গেছেন, এই জায়গাতে তার অভিনয় আমার ভাল লেগেছে। আরও উন্নতি করার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে।

আরও পড়ুন: ঢাবি ছাত্র রনির পাশে মাহবুব কবীর মিলন

এই চলচ্চিত্রের শেষ গানটি যথোপযুক্তভাবে ফিল্মের কোথাও সেট করতে পারলে ভাল হতো। এই গানটির দৃশ্যায়ন দেখার মত ছিল কিন্তু এই গানটিকেই ফিল্মের শেষে সেট করে অযথাই আবারও চমকে দিয়েছেন পরিচালক। গান দেখে মনে হচ্ছিল মুভি তো শেষ আবার গান কেন?

মুভির শেষ দৃশ্যে নায়ক যখন তার নায়িকা তথা চলচ্চিত্রের স্ত্রী তথা বাস্তবের স্ত্রীকে আই লাভ ইউ বলে উঠেন, সেটি বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছে, কারণ করুণ দৃশ্যের এই ভালবাসা প্রকাশ দর্শককে হাসিয়েছে। ভালবাসা বলায় বা করায় খাদ ছিল কি না আমি জানি না! কিন্তু তা দর্শককে কানেক্ট করতে পারেনি।

এই চলচ্চিত্রের লোকেশন, কোরিওগ্রাফি, গানসহ মাজদী ও ভিলেন খালিদের অভিনয় ভাল লাগার ছিল। অন্য টেকনিক্যাল বিষয়ে কথা বলা থেকে বিরত থাকছি আমার নিজ সীমাবদ্ধতার কারণে! তবে অনন্ত জলিলের চেষ্টা চোখে পড়ার মত ছিল এটা মানতেই হবে। অনেকেই তার নানা ভাল কাজকে সামনে এনে ফিল্মের বিষয়ের সাথে সম্পর্কিত করার চেষ্টা করেছেন। মাথায় রাখুন দুটি ভিন্ন জায়গা। তিনি অভিনয় বহুদিন ধরেই করছেন এখনো তার প্রথম দিককার মত খামতি চোখে পড়লে দর্শক কথা বলবেই। তিনি অনেক উন্নত প্রযুক্তির সূচনা ঘটিয়েছেন বা ঘটাচ্ছেন বলেই তাকে নিয়ে কিছু বলা যাবে না, এটি যথার্থ নয়। উন্নতি চোখে লাগার মত হলেও তিনি অভিনয় করতে চাইলে ডাবিং অন্য কাউকে দিয়ে করাতে পারেন। আর নয়তো ভাল কোথাও নিজে চর্চা করে নিতে পারেন।

অনেকেই ফিল্মের আগামাথা বুঝেন নাই বলেছেন, আমার কাছে তেমনটা মনে হয় নাই। নায়ক একটি নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যে বের হয়েছিলেন এবং তিনি শেষ পর্যন্ত সেই পারপাস সার্ভ করেছেন। তবে এত সুদক্ষ একজন অফিসার আফগানিস্তানের মত জায়গায় মাত্র একজন পুলিশ নিয়ে খালিদের মত এত বড় অপরাধীকে ধরতে গেলেন এটি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়! এরকম কিছু ঘাটতি চলচ্চিত্রে ছিল। নিজেদের একমাত্র সন্তানকে এই চলচ্চিত্রে দারুণভাবে উপেক্ষা করা হয়েছে। স্বামী, স্ত্রী দু’জনেই ব্যস্ত পেশায় আছেন বলেই এমনটা দেখিয়েছেন কি না আমি জানি না।

এই চলচ্চিত্রের শেষ ফাইটকে অযথাই লম্বা করা হয়েছে! প্রথমে খুব অবাক হয়েছিলাম ইরানি পুলিশের মৃত্যুতে অনন্তের কান্না দেখে, কিন্তু পর মুহূর্তেই এই কান্না তিনি কেন করছেন তা পরিস্কার করা হয়েছে এটি ভাল লেগেছে! এই গাঁথুনিগুলোই গুরুত্বপূর্ণ যেগুলো কিছু কিছু জায়গায় স্পষ্ট ছিল না, তা সত্ত্বেও এই চলচ্চিত্র মানুষ দেখতে যাচ্ছে। আমাদের সামনের ৪টা সারি খালি ছিল বাকি পুরোটাই ভর্তি ছিল।

হাসতে যাক, বিনোদিত হতে যাক, যাই করুক না কেন মানুষ যাচ্ছে। আমি বিশ্বাস করি পূর্বে মানুষ তাকে নিয়ে যত হাসার চেষ্টা করেছেন এই চলচ্চিত্রে সেই সুযোগ কম পেয়েছেন। মানে তিনি অনেকটাই উৎরে গেছেন।

আমার কাছে এই চলচ্চিত্রের দৈর্ঘ্য কোনোভাবেই ২ ঘণ্টা ৪০ মিনিটের হওয়া যথার্থ মনে হয়নি! এটি ২ ঘণ্টা ২০ মিনিটে শেষ হলে টানটান বিষয়টা টিকে থাকতো। অযথাই ২০-২৫ মিনিট দীর্ঘ করা হয়েছে।

সর্বোপরি আমি, আমার পরিবার এই চলচ্চিত্র দেখে মোটামুটি বিনোদিত হয়েছি। যেসব দারুণ দারুণ লোকেশনে এই চলচ্চিত্রের শ্যুট করা হয়েছে সেসব আগে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে খুব কমই দেখেছি আমরা বা দেখা হয়নি বললেই চলে! 

অনন্ত জলিলের অভিনয়, পরিচালনা, প্রযোজনা নিয়ে নানামুখী কথা হলেও তিনি থামবেন বলে মনে হয় না! ওপেন প্ল্যাটফর্মের কারণে নানা অখাদ্যও আমাদের গলাধঃকরণ করতে হয়। অনন্ত জলিল অতীব সুস্বাদু খাবার পরিবেশন না করলেও তার পরিবেশিত খাবার এট লিস্ট অখাদ্য নয়! তিনি চলচ্চিত্রে ব্যবসার চেয়েও নতুন বিষয় প্রদর্শনে বেশি আগ্রহী বলে মনে হয়। তাই তার সমালোচনাটুকু যথাযথ উপায়ে হলে হয়তো দুই দিকের সেতুবন্ধন সঠিকভাবে রচিত হবে।

লেখক: এডিসি, ক্যান্টনমেন্ট ও খিলক্ষেত, ডিএমপি।

(ফেসবুক থেকে সংগৃহীত)


সর্বশেষ সংবাদ

×
  • Application Deadline
  • December 17, 2025
  • Admission Test
  • December 19, 2025
APPLY
NOW!
GRADUATE ADMISSION
SPRING 2026!
NORTH SOUTH UNIVERSITY
Center of Excellence